হবিগঞ্জে প্রবাসীর দুই সন্তান রেখে স্ত্রীর আত্মহত্যা !

0
524
হবিগঞ্জে প্রবাসীর দুই সন্তান রেখে স্ত্রীর আত্মহত্যা !

নূরুজ্জামান ফারুকী, বিশেষ প্রতিনিধিঃ স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নির্যাতন ও নিজের দুই শিশু সন্তানকে স্বামীগৃহে আটকে রেখে বিতাড়িত করে দেয়ায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে লিবিয়া প্রবাসীর স্ত্রী জলি বেগম (২৮)। হবিগঞ্জ শহরের বদিউজ্জামান খান সড়কের এক বাসায় নিজের নানির কাছে এসে আত্মহত্যা করেন জলি। হবিগঞ্জ সদর থানা পুলিশ জলির লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য হবিগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করে।

নিহতের পারিবারিক সূত্র জানায়, নবীগঞ্জ উপজেলার পানিউমদা ইউনিয়নের বড়চর গ্রামের শাহ কদ্দুছ আলীর কন্যা জলি বেগমকে ২০০৯ সালে একই উপজেলার আউশকান্দি ইউনিয়নের মরহুম এলাছ মিয়ার ছেলে নজরুল আমিনের কাছে বিয়ে দেয়া হয়। বিয়ের পর তাদের দাম্পত্য জীবন অনেকটা সুখেই চলছিল। এরই মধ্যে জলির গর্ভে মাহিয়া আক্তার ও মরিয়ম বেগম নামের দুই কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। বর্তমানে মাহিয়ার বয়স ৭ বছর ও মরিয়মের বয়স ৫ বছর। দুই সন্তান নিয়ে জলি ও নজরুল অনেকটা সুখে জীবন যাপন করলেও হঠাৎ করে নজরুল মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়ে। মাদক সেবনের বিষয়টি জলি আঁচ করতে পেরে নজরুলকে মাদক ছাড়ার জন্য প্রথমে অনুরোধ করেন। কিন্তু নজরুল তা না শুনে মাদক সেবন করে যাচ্ছিল। পরবর্তীতে জলি এ বিষয়টি তার অভিভাবক ও শাশুড়িকে অবগত করেন। কিন্তু জলির শ্বশুরবাড়ির লোকজন নজরুলকে কোন ধরণের শাসন করেননি। উল্টো জলিকে তারা গালি-গালাজ করে। এক সময় নেশাগ্রস্ত নজরুল ঋণে জর্জরিত হয়ে যায়। আর এই ঋণ পরিশোধ করার জন্য জলিকে তার পিত্রালয় থেকে টাকা এনে দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। শ্বশুর বাড়ির চাপে জলি বিভিন্ন সময় তার পিত্রালয় থেকে টাকা নিয়ে দেয়।

৭/৮ মাস পূর্বে জলির স্বামী নজরুল লিবিয়ায় চলে যায়। জলি তার দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে তার স্বামীর বাড়িতেই বসবাস করছিল। এরই মধ্যে পারিবারিক তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে তার শাশুড়ি, ভাসুর নূরুল আমিন তাকে গালি-গালাজ করতো। এ বিষয়টি জলি স্বামী নজরুলকে ফোন করে জানালেও নজরুল কোন পদক্ষেপ গ্রহন না করে উল্টো নিজের স্ত্রীকে ফোনে গালি-গালাজ করতো। প্রায় ৩ মাস পূর্বে জলির শাশুড়ি ও ভাসুর নূরুল আমিন তার সাথে ঝগড়া করে। এক পর্যায়ে নূরুল আমিন জলির ভাই ইমনকে ফোন করে বলে তোর বোনকে এসে নিয়ে যা। পরবর্তীতে ইমন জলির শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বোনকে তার বাসায় নিয়ে আসে। এ সময় জলি তার দুই মেয়েকে সাথে আনতে চাইলে ভাসুর নূরুল আমিন জোরপূর্বক তাদের আটকে রাখে। জলি সেখানে কিছু সময় কান্নাকাটি করে তার ভাইয়ের সাথে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসে।

এদিকে গত ৬ সেপ্টেম্বর জলি হবিগঞ্জ শহরের বদিউজ্জামান খান সড়কের সালমা কুঠিরে তার নানির কাছে আসে। পরে ৭ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে জলি তার নানির সাথে ঘুমিয়ে পড়ে। রাতের কোন এক সময় বাসার সিলিং ফ্যানের সাথে ওড়না পেছিয়ে আত্মহত্যা করে জলি। সকালে জলির নানি ঘুম থেকে জেগে দেখেন জলি তার পাশে নেই। এ সময় তিনি খোঁজাখুজি করে বাসার ২য় তলায় একটি খালি রুমে সিলিং ফ্যানের সাথে জলির ঝুলন্ত লাশ দেখতে পান। এ সময় তিনি ওই রুমে জলির আত্মহত্যার পূর্বে লেখা একটি চিরকুট দেখতে পান। চিরকুটে লেখা থানার স্যার। তারিখ ০৭/০৯/২০২১ ইং। প্রিয় স্যার আসলামু আলাইকুম, পত্রের আমার সালাম নিবেন। ৬ তারিখ গেছলাম আমার ২টা বাচ্চাদের কারণে। তার বাবা বিদেশ। আমার কাছে আমার বাচ্চাদের দেয় না। তার উপুর কাছে আমার ২ বাচ্চা তাকে। বাচ্চা অনেক কান্না কাটি করছে আমার কাছে আসার লাগি। আমি যদি মারা যাই তাহলে তার দায় নেবে মোঃ নূরুল আমিন। ইতি জলি বেগম।”
পরবর্তীতে জলির নানি এ বিষয়টি তার আত্মীয় স্বজনকে অবগত করেন। তার আত্মীয় স্বজনরা সদর থানা পুলিশকে সংবাদ দেন। পরবর্তীতে সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ মাসুক আলীর নেতৃত্বে একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করেন। বিকেলে ময়না তদন্ত শেষে জলিদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে লাশের দাফন সম্পন্ন করা হয়।

এ ব্যাপারে জলির নানি কুঠি বেগম জানান, আমার নাতনীকে বিয়ের পর থেকে তার স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়িসহ পরিবারের লোকজন নির্যাতন করে আসছিল। তাদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে জলি আমার এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। তারপরই তারা ফোনে তাকে গালি-গালাজ করতো। তার মেয়েদের আটক করে রাখায় সে সব সময় দুঃচিন্তা করতো এবং হতাশায় থাকতো। সর্বশেষ তাদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে আমার নাতনী জলি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এর কারণ জলি তার নোটবুকে লিখে গেছে।
জলির ছোট ভাই ইমন জানান, আপাকে বিয়ে দেয়ার সময় আমরা তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের চাহিদা মোতাবেক জিনিসপত্র দিয়েছি। বিয়ের পর তারা যে সময় যে জিনিসটি চেয়েছে আমরা তা দিয়েছি। কিন্তু তাতেও তারা সন্তোষ্ট ছিল না। আমার বোনকে প্রায়ই মারধোর করতো। তাদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে আমার বোন সেখান থেকে চলে এসেছিল। কিন্তু তারা ফোনে আমার বোনকে বেসামাল কথাবার্তা বলে উত্যক্ত করতো। তাদের নির্যাতনের কারণে আমার বোন আত্মহত্যা করেছে।
এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মাসুক আলী জানান, মেয়েটির লাশ উদ্ধার করেছি। মেয়েটি কি কারণে মারা গেছে তা ময়না তদন্তের রিপোর্টেই জানা যাবে। তবে মৃত্যুর পূর্বে লেখা মেয়েটির একটি নোটবুক পেয়েছি। সেই লেখাটি আমরা তদন্ত করে দেখছি। তিনি আরও জানান, ময়নাতদন্ত শেষে সন্ধ্যায় লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে এটি আত্মহত্যা।