‘সুচি বেঈমান’ তাকে বিশ্বাস করা যায়না নির্যাতিত রোহিঙ্গারা

    0
    190

    “অং সান সু চি রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে যে ভাষণ দিয়েছেন তার সমালোচনার ঝড় বইছে আন্তর্জাতিক নেতাদের মধ্যেও”

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,২১সেপ্টেম্বর,ডেস্ক নিউজঃ  প্রত্যাখ্যান করেছেন রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সংগঠন ও নেতৃবৃন্দ।মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে যে ভাষণ দিয়েছেন তার সমালোচনার ঝড় বইছে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় থেকে। মঙ্গলবারের ওই ভাষণে সু চি রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা করেছেন, কিন্তু মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিষয়ে কিছু বলেননি। অথচ রাখাইনে ভয়াবহ নির্যাতনের জন্য সেনাবাহিনীকেই দায়ী করছে রোহিঙ্গারা। আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। বাংলাদেশে আসতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে শত শত রোহিঙ্গার, আবার অনেকে এসেছেন গুলিতে আহত হয়ে কিংবা বয়ে এনেছেন নিজের অগ্নিদগ্ধ শরীর। অথচ সু চি বলেছেন, অধিকাংশ মুসলিমই রাখাইনে অবস্থান করছে। তিনি মুসলিমরা সেখান থেকে পালাচ্ছে কেন সেটিও খুঁজে বের করার কথা বলেছেন। রোহিঙ্গা স¤প্রদায়ের নেতারা ইতোমধ্যেই সু চির বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে এ বক্তব্যকে সেনাবাহিনীর বক্তব্য বলে আখ্যায়িত করেছেন।
    মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন সু চিকে ফোন করে বলেছেন, তার বক্তব্যকে তিনি স্বাগত জানাচ্ছেন যে, শরণার্থীদের যাচাই করে ফিরিয়ে নেয়া হবে। কিন্তু তিনি একই সাথে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার দিকেও নজর দিতে বলেন।
    জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেসও সামরিক অভিযান বন্ধ করে রোহিঙ্গাদের ক্ষোভের দিকে দৃষ্টি দেয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
    তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান সঙ্কট নিরসনে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে সক্রিয় হওয়ার আহবান জানিয়েছেন যতক্ষণ না পর্যন্ত মিয়ানমারের ট্র্যাজেডির অবসান হয়।
    ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, রাখাইনে সামরিক অভিযান অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। মানবিক সহায়তার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। জাতিগত নিধন বন্ধে আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি বলেন, সহিংসতা বন্ধ করে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য তারা নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে একটি উদ্যোগ নেবেন।
    ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন মুখপাত্র বলেছেন, আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের মিয়ানমার পরিদর্শনে যে আহবান সু চি জানিয়েছেন তা এক ধাপ অগ্রগতি, কারণ আগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যাওয়ার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মেও রাখাইনে সামরিক অভিযান বন্ধ করার কথাই বলছেন। আর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সু চির সমালোচনা করে বলেছে তিনি বালিতে মাথা গুঁজে আছেন।
    এদিকে মিয়ানমারে নেত্রী অং সান সু চিন ভাষণ প্রত্যাখ্যান করেছেন রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সংগঠন ও নেতারা। তারা বলছেন, সূ চি সব জেনেও না জানার ভান করেছেন এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মনে করে, এই ভাষণে সেনাবাহিনীর বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি করা হয়েছে।
    জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচাতে চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা গত তিন সপ্তাহে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। এখনো প্রতিদিন আরও ১০ থেকে ১৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসছে।
    রোহিঙ্গারা বলছে, নির্যাতনের কারণেই তারা তাদের নিজের গ্রাম ও ভিটেমাটি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছেন এবং সু চি সেটি ভালো করেই জানেন। তারপরেও কেন এতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে, সে সম্পর্কে জানা নেই বলে সু চির দেয়া বক্তব্য ক্ষুব্ধ করেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে।
    রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠন -আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম লন্ডন থেকে সংগঠনটির কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। তিনি বলেছেন, রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে অং সান সূ চি পুরোপুরি অসত্য বক্তব্য তুলে ধরেছেন।
    তিনি বলেন, ‘সু চি তার বক্তব্যে যা বলেছেন তা মোটেও সঠিক নয়। তার না জানার মতো কোন কারণ নেই। সময়ে সময়ে রোহিঙ্গারা তাকে সব জানিয়েছে- কী হচ্ছে আর না হচ্ছে। আর সু চি জেনেও না জানার মতো করছেন। শি ইজ অ্যা প্রিটেন্ডার। একই সময়ে তিনি মিথ্যা কথা বলেছেন। আমরা তো খালি হয়ে গেছি সেটা আপনারা দেখছেন তো। ওখানে আছে কি এখন? মানুষ তো একদমই নাই হয়ে গেছে সেখানে। আমার মন্তব্য হলো উনি ভনিতা করছেন ও মিথ্যা কথা বলছেন। জেনেও না জানার মতো আচরণ করছেন। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা মূলত অবস্থান করছেন কক্সবাজার জেলার শরণার্থী শিবিরগুলোতে। এই দফাতে নতুন করে আসা শরণার্থীদেরও একটি বড় অংশকে এসব শিবিরে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
    এমনই একটি কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গাদের একজন নেতা মোহাম্মদ নূর বলেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের কারণেই লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। কিন্তু সূ চি এই সত্যকে গোপন করেছেন।
    ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা বলেছেন সু চি। অত্যাচার না করলে, নির্যাতন না করলে, গুলি না করলে, কাটাছেঁড়া না করলে মানুষ কেন আসবে এখানে। জীবনেও আসতো না। মিয়ানমারে মুসলিম ছিলো ১২ লাখ। এর মধ্যে সাত লাখই তো এখানে এসে পড়েছে। মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে থাকতে পারলে কি একদেশ থেকে আরেক দেশে পালিয়ে আসে? সূ চি সামরিক বাহিনীর লোকজনকে ভয় পান। সেজন্যই এভাবে বলেছেন, বলেন তিনি।
    সু চি তার ভাষণে কী বলবেন তা নিয়ে অনেক আগ্রহ ছিলো রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সংগঠনের। কিন্তু তার ভাষণ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াই তৈরি করেছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে।
    অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক রোহিঙ্গা ইন্টেলেকচুয়াল কমিউনিটির প্রেসিডেন্ট ড: লা মিন্ট বলেছেন, অং সান সূ চি-র বক্তব্য আর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বক্তব্যকে তারা আলাদা করতে পারছেন না। তিনি বলেন, তার বক্তব্য আর সেনাবাহিনীর বক্তব্যের সাথে কোন পার্থক্য নেই। একই কথা বলেন তারা। এটা সেনাবাহিনীরই বক্তব্য। উনি যা বলেছেন তার বক্তব্যের ৯০ ভাগই মিথ্যা কথা। রোহিঙ্গাদের নিয়ে তিনি যা বলেছেন সবাই আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি।
    এর আগে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি ও তার সরকার রাখাইন রাজ্যের ভয়াবহ রোহিঙ্গা পরিস্থিতির বিষয়ে বালিতে মাথা গুঁজে রেখেছেন বলে সমালোচনা করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। লন্ডন-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক জেমস গোমেজ মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বিস্ময় প্রকাশ করেন। অন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সু চির বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছেন। গোমেজ বলেন, অং সান সু চি তার বক্তব্যের মাধ্যমে আবারও দেখিয়েছেন যে, তিনি ও তার সরকার রাখাইন রাজ্যের ভয়াবহ পরিস্থিতির বিষয়ে বালিতে তাদের মাথা গুঁজে রেখেছেন।এএফপি ও বিবিসি।

    অপরদিকে আল-জাজিরা অবলম্বণে আমাদের সময় থেকে জানা যায়-অনেকেই ভেবেছিলেন, সারা বিশ্বকেই কাঁপিয়ে দেওয়া গত কয়েক সপ্তাহের রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মিয়ানমারের গণতন্ত্রী নেত্রী অং সান সুচি তার প্রথম ভাষণে হয়তো নতুন কোন দিক নির্দেশনা দেবেন। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বলছেন, তার ওই তিরিশ মিনিটের ভাষণ সময়োপযোগী হয়নি। ভাষণে দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত মারাত্মক সব অভিযোগকে ধামা চাপা দেওয়া হয়েছে বলেও মনে করছেন অনেকে। যদিও সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনার জের ধরে মিয়ানমারে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা সুচির ভাষণকে একটি বিশ্বাসঘাতকতা বলেই মত দিয়েছে। বৃহস্পতিবার কাতার ভিত্তিক সংবাদ চ্যানেল আল-জাজিরার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এমন উপসংহারই টেনেছে।

    সুচি তার বক্তব্যে জানান, সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনার শিকার হয়েছেন যারা তিনি তাদেরকে প্রতি গভীরভাবে অনুধাবন করছেন। এও জানান, যারা ওই ঘটনার জন্য দায়ী তারা অবশ্যই কর্মফল ভোগ করবে। তবে, মিয়ানমারে জাতিগত নিধনযজ্ঞ হচ্ছে বলে জাতিসংঘের একাধিক সংস্থা থেকে দাবি করা অভিযোগকে তিনি পাশ কাটিয়ে গেছেন। মিয়ানমারের সন্ত্রাসীদের সহযোগিতায় কিছু উগ্র বৌদ্ধ সংগঠন নির্বিচার হত্যাকান্ড, ধর্ষণ ও সহিংসতা চালালে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। শরণার্থীদের প্রায় শতভাগই এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছে।

    সুচি বক্তব্যে বলেন, ‘মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ওই গোলযোগপূর্ন এলাকায় এখনো ৫০ শতাংশ সংখ্যালঘুর ঘর-বাড়ি অক্ষত রয়েছে।’ তিনি জানান, উপযুক্ত প্রমাণ দেখিয়ে মিয়ানমারের নাগরিকরা আবারও দেশে ফিরে যাবে।

    এদিকে, শরণার্থী রোহিঙ্গারা বলছেন বাড়ি-ঘর কিছু অবশিষ্ট থাকলেও সেখানে আদতে আর কোন রোহিঙ্গা অবস্থান করছেনা। ৪০ বছর বয়সী খায়রুল আমিন নামে এক শরণার্থী আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আমি আবারও ফিরে যেতে চাই, যদি আমি আমার অধিকারগুলোকে ফিরে পাই। কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছেনা সুচি তার কথা মতো কাজ করবে।’

    খায়রুল বলেন, ‘সুচি একজন বিশ্বাসঘাতক। রোহিঙ্গাদের একটি বিরাট অংশ সুচির দলকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে। আর এর বিনিময়ে আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হবে- এমনটাই কথা ছিলো। কিন্তু নির্বাচয়ে জয়ী হওয়ার পর সে সেনা সমর্থিত দল ইউএসডিপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে আর আমাদের গেছে ভুলে।

    কক্সবাজারের বালুখালি ক্যাম্পে অবস্থান নেওয়া অন্য রোহিঙ্গা সুলতান আহমেদেরও একই মনোভব দেখা গেছে। তিনি বলেন, ‘আমি সব হারিয়েছি। আমার ফিরে যাওয়ার আর কী মানে আছে।’

    তিনি আরও বলেন, ‘সুচি এক বিশ্বাসঘাতক। আমরা তার কথায় আর বিশ্বাস রাখতে পারছিনা। আর সেই দেশে (মিয়ানমারে) সুচি কেবল একটি নাম, কেউ তাকে গুণেনা। সবকিছু সেনারাই নির্ধারণ করে দেয়।’

    ৫৫ বছর বয়সী আমেনা বেগম জানান, তার স্বামী মেহমুদুল হককে এক হামলায় খুন করা হলে তিনি পালিয়ে আসেন। তিনি বলেন, ‘আমি সুচি আর এই হানাহানি সম্পর্কে বেশি কিছু জানিনা। সে যে কি বললো তাও জানিনা। তবে, তার বাবা নাকি আমাদের লোক ছিলো। তিনি আমাদের নিয়ে ভাবতেন এবং সাহায্য করতেন। তার সময়ে আমরা সুখেই ছিলাম। কিন্তু সুচি আসার পর তারা আমাদের লোকজনকে হত্যা করেছে। আমাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে এবং আমরা আমাদের সহায়, সম্বল, সন্তান সব হারিয়েছি। আমাদের এখন কিছুই নেই।’

    আমেনা জানান, যদি সুচি তাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে এবং বৌদ্ধদের মতোই সারাদেশে চলাফেরা করতে দেয় তবেই তিনি ওই দেশে ফিরে যাবেন। সুচি যদি সঠিক পথে থাকতেন তবে এইসব কিছুই হতোনা। কিন্তু তিনি ছিলেন নীরব।

    একই ক্যাম্পে অবস্থান করা ৬০ বছর বয়সী শাহ আহমেদের মুখ থেকেও ঝরে পড়লো একই কথা, ‘সুচি বেঈমান’।