সাসপেন্সে ভরে উঠেছে রাজনীতি

    0
    315
    মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
    মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

    ।।  মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ।।

    প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক অ্যালফ্রেড হিচ্কক হলেন ‘সাসপেন্স ফিল্মের’ বিশ্বনন্দিত মহারাজ। তার পরিচালিত সিনেমাগুলো দেখার সময় দর্শক মাত্রকেই থাকতে হয় নিরন্তর টেনশনে—কি হয়, কি হয়! কিন্তু যা নিয়ে টেনশন, তার বাইরের কোনো অপ্রত্যাশিত ভিন্নরকম ঘটনার আকস্মিক আবির্ভাব দ্বারা তিনি আঁতকে তুলতে সক্ষম হন দর্শককুলকে। হিচ্ককের ছবির বৈশিষ্ট্য হলো, এক ধরনের সাসপেন্সের মধ্যে ভিন্ন স্কেলের অন্য আরেক সাসপেন্সের আবির্ভাব ঘটানো—অর্থাত্ ডবল সাসপেন্স। হিচ্ককের ‘সাসপেন্স ফিল্মগুলো’ তাই সব সময়ই অনন্য।

    বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অনিশ্চয়তা, টেনশন ও সাসপেন্স বিরাজ করছে, তা হিচককের ‘সাসপেন্স ফিল্মের’ নাটকীয়তাকেও ছাড়িয়ে গেছে। কে নিশ্চিতভাবে বলতে পারে যে, আগামীকাল দেশে কি ঘটতে যাচ্ছে। অথবা তার পরের দিনে বা পরের মাসে। বাতাসে ভাসছে নানা গুজব। কোনটা সত্য, কোনটা বিশ্বাস করার মতো—তা ভেবে মানুষ দিশাহারা। সংঘাত, সংঘর্ষ, সন্ত্রাস পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে রেখেছে। এমনকি সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা বজায় থাকা নিয়েও চলছে অনিশ্চয়তা। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের মুখে হামেশাই নবরূপে সেনা-সমর্থিত ওয়ান-ইলেভেনের পুনঃমঞ্চায়নের আশঙ্কার যে কথা শোনা যায়, তা কি নিছক ভয় দেখিয়ে রাজনৈতিক দর কষাকষির জন্য কথার কথা, না কি তা প্রকৃতই একটি বাস্তব আশঙ্কা? কে তার সঠিক জবাব দিতে পারবে? তলে তলে চলছে ষড়যন্ত্রের খেলা। তাছাড়া, চলছে নানা হিডেন এজেন্ডা নিয়ে গোপন তত্পরতা। তাই, কে বলতে পারবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আসলে কি ঘটতে চলেছে? সবকিছু যেন হিচ্ককের ‘ডবল সাসপেন্সের’ চেয়ে এক কাঠি এগিয়ে ‘ট্রিপল সাসপেন্সের’ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে।

    বর্তমানে মহাজোট সরকারের মেয়াদের আর মাত্র ৭ মাস বাকি। সংবিধান অনুসারে এই সরকারের পক্ষে এর পরে আর ক্ষমতায় থাকার কোনো সুযোগ নেই। এই সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে তাতে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদদের সমর্থনপুষ্ট দল বা জোটের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এই সময়সীমার মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান একটি পূর্বশর্ত। এই বাধ্যবাধকতার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বড় দুটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজ-নিজ মতো জোট গঠন করে ক্ষমতার-রাজনীতির জুয়া খেলায় লিপ্ত হয়েছে। নির্বাচনের আগেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য, কোন্ সরকার ও ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন হবে, তা নিয়ে দু’পক্ষ প্রবল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে, ১৯৯৬ সালে প্রবর্তিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে একটি ৩ মাসের অন্তর্বর্তী নির্দলীয় সরকারের বিধান রাখা বা না রাখাটা বিতর্ক ও দ্বন্দ্বের একটি প্রধান ইস্যু হয়ে উঠেছে।

    আপাতঃভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটিকে বিএনপি মহল ‘অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের’ জন্য পূর্বশর্ত বলে হাজির করার চেষ্টা করলেও তাদের আসল উদ্দেশ্য অন্যরকম। এটি পরিষ্কার এ কারণে যে, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আরো ১/২ মেয়াদ নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যে কর্তব্যটি আরো বেশি জরুরি তা হলো নির্বাচনকে টাকার খেলা, পেশিশক্তির দাপট, প্রশাসনিক কারসাজি, সাম্প্রদায়িক ধূম্রজাল ইত্যাদি থেকে মুক্ত করা। অথচ এসব বিষয়ে বিএনপি মহল একেবারেই নীরব। বরঞ্চ তারা ‘মানি-মাসল-ম্যানিপুলেশন’-এর সমাবেশ ঘটানোর জন্য আওয়ামী শিবিরের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে।

    নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে তারা ‘সংগ্রাম’ করছে আসলে যে কারণে তা হলো, এই ইস্যুতে বেশ কিছুটা জনসমর্থন থাকায় তা নিয়ে মাঠ গরম করে একটি অচলাবস্থার ‘পরিস্থিতি’ সৃষ্টি করতে পারলে আন্তর্জাতিক শক্তির সহায়তায় তারা এক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন দ্বারা নির্বাচনের আগেই একটি বড় মনস্তাত্ত্বিক বিজয় অর্জন করতে পারবে বলে মনে করে। এই ইস্যুতে বিজয় আনতে পারলে তা তাদের জন্য নির্বাচনে বিজয়ের ক্ষেত্রে একটি বাড়তি বোনাস পয়েন্ট হবে। তারা বলে রেখেছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না, নির্বাচন হতেও দিবে না। নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়সীমা সম্পর্কে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাকে বিবেচনায় নিয়েই তারা এই ইস্যুতে অচলাবস্থা ও সহিংস নৈরাজ্য সৃষ্টি করে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রের’ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে তত্পর রয়েছে। তাতে শেষ মুহূর্তে সরকার তাদের দাবি মেনে নিলে তাদের লক্ষ্য অর্জিত হবে। আর না মানলে অচলাবস্থার ফলশ্রুতিতে যদি সেনা সমর্থিত ওয়ান-ইলেভেন বা তার অনুরূপ কিছু আসে তাতেও তাদের আপত্তি নেই। সাজানো নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসাটা তাদেরকে ঠেকাতেই হবে। সেজন্য ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ’ করতেও তারা প্রস্তুত। দেশ তাতে রসাতলে যাক না কেন।

    নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুকে শর্ত করে বিএনপির রাজনৈতিক জুয়ার চালের পেছনে আরেকটি অঘোষিত উদ্দেশ্য হলো, দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক জিয়াকে আইনী বিচার প্রক্রিয়া থেকে রক্ষা করে ‘সগৌরবে’ ও ‘বিজয়ীর বেশে’ দেশে ফিরিয়ে আনা। একটি ‘ভিন্নতর নেতৃত্বের’ সরকার ছাড়া এটি কোনমতেই যে হবার নয়, সে কথা বুঝেই বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে এতো অনড় রয়েছে। এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়াও রয়েছে জিয়া পরিবারকে বিচার ও দণ্ডের হাত থেকে রক্ষার দায়িত্ব। এটি প্রধানতঃ ম্যাডাম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত এজেন্ডা হলেও তা তার দলের সব কৃতজ্ঞ অনুসারীদের ‘নৈতিক’ দায়িত্ব হয়ে উঠেছে। তারেক জিয়ার ইস্যুটি হলো বিএনপির লুকায়িত ‘হিডেন এজেন্ডা’। এই ইস্যুতে গোপন সমঝোতা ও লেনদেন রাজনীতিতে নতুন দৃশ্যপট তৈরি করতে পারে।

    পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত এমনও হয়ে উঠতে পারে যে, বিএনপি যদি দেখে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের জনসমর্থন এতোটাই নেমে গেছে, যাতে করে নানা ছল-চাতুরি ও কারসাজির আশ্রয় নিয়েও তার পক্ষে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় ফিরে আসা কোনোমতেই সম্ভব হবে না, সেই অবস্থায় ‘কোনো কিছুই বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেয়া হবে না’ ঘোষণা দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়াই শেষ মুহূর্তে সে নির্বাচনে অংশ নেয়ার পথ গ্রহণ করতে পারে। বয়কটের ধোঁয়াসায় আওয়ামী লীগকে আচ্ছন্ন রেখে এ ধরনের সারপ্রাইজ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটা বিএনপির ক্ষেত্রে অসম্ভব নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তারেক জিয়াকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্ল্যানটি নির্বাচনের আগের বদলে নির্বাচনের পরে বাস্তবায়নের জন্য সময়সূচি পরিবর্তন করা হতে পারে। অন্যদিকে, যদি দেখা যায় যে, বিএনপির পরিকল্পিত কোনো অপশনই শেষ পর্যন্ত কার্যকর হচ্ছে না, তখন পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতায় সে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদে তার আসনসংখ্যা বাড়ানোর পথ গ্রহণ করতে পারে। কিম্বা প্রকারান্তরে নির্বাচন বয়কট করার মাধ্যমে সেই একতরফা নির্বাচনকে জাতীয় ও বিশেষকরে আন্তর্জাতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করে, ভবিষ্যত্ সরকারের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে, তাকে অকার্যকর করে, অল্পদিনের মধ্যে তাকে নতুন নির্বাচন দিতে বাধ্য করার লক্ষ্যে নৈরাজ্যমূলক আন্দোলন চালানোর পথ গ্রহণ করতে পারে।

    বিএনপির দিক থেকে তাই অনেক রকম বিবেচনা ও পথ খোলা রয়েছে। এসবের মধ্যে বিএনপি কোন্ পথ বেছে নিবে, তা কেউ এখনো নিশ্চিত বলতে পারে না। রাজনীতির এসব উত্তেজনাপূর্ণ অনিশ্চয়তা হিচ্ককের ‘সাসপেন্স ফিল্মের’ চেয়ে টেনশনপূর্ণ কম কিসে?

    এদিকে আওয়ামী লীগের সামনে জীবন-মরণ প্রশ্নটি হলো ক্ষমতায় তার দ্বিতীয় মেয়াদ নিশ্চিত করা। এর অন্যথা হলে, জামাতকে সাথে নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া ক্ষুণ্ন করাসহ নানা পদক্ষেপ নিতে পারে বলে ধরে নেয়া যায়। এই বিষয়টিকে আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক যুক্তির ট্রাম্প কার্ড হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। এ ধরনের আরো কিছু যুক্তিও তাদের হাতে আছে। কিন্তু তাদের জন্য দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি প্রধান বাধ্যবাধকতা হলো—পাঁচ বছরের শাসনকালের অপকর্মের বিচার থেকে রেহাই পাওয়া, বিএনপির শোধ তোলার অভিযান থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করা এবং উপরে-নিচের দুর্নীতি ও লুটপাটের ‘সোনালী দিনগুলো’ অব্যাহত রাখা। তাছাড়া রয়েছে শেখ হাসিনার উত্তরাধিকারের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করার কাজ।

    আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা যদি পাঁচ বছর আগের অবস্থায় বা তার কাছাকাছি থাকতো তাহলে তার জন্য দ্বিতীয় মেয়াদ নিশ্চিত করা তেমন কঠিন কোনো ব্যাপার ছিল না। কিন্তু সেই জনপ্রিয়তায় ক্ষয় ধরেছে। দ্বিতীয় মেয়াদ নিশ্চিত করার জন্য তাকে তাই এখনো নানা ফন্দি-ফিকিরের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। এসব বিবেচনায় সে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাদ দিয়েছে। বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে পারলে তার দ্বিতীয় মেয়াদ নিশ্চিত হয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বড় বাধা হলো সেরূপ একতরফা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা। এই সমস্যা উতরানোর জন্য এরশাদকে বিরোধী দল সাজানো, জামাতকে কনসেশন দিয়ে ফুসলিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো, বিএনপিতে বিদ্রোহী গ্রুপ লালন করে তাদের দিয়ে ধানের শীষ মার্কায় নির্বাচন করানো ইত্যাদি নানা প্রজেক্ট নিয়ে তারা খেলা করে চলেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তারা মানবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। সংলাপের মুলা ঝুলিয়ে রাখলেও সমঝোতার পথে তারা এগোচ্ছে না। নির্বাচনে কেউ আসুক আর না আসুক, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই যথাসময়ে নির্বাচন করে ফেলার পথেই তারা শেষ পর্যন্ত থাকতে পারে। আবার, বিএনপিকে অনিশ্চয়তা ও অপ্রস্তুতির মাঝে রেখে একেবারে শেষ সময়ে হঠাত্ করে কিছু কনসেশন দিয়ে তারা সকলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার পথও গ্রহণ করতে পারে। অবশ্য এসবের পরেও দ্বিতীয় মেয়াদ সম্পর্কে আগেভাগেই নিশ্চিত না হতে পারলে তারাও ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গের’ পথ গ্রহণ করতে পারে।

    এদিকে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামাতসহ উগ্র ও জঙ্গি সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো বিএনপি ও একই সাথে আওয়ামী লীগের হাতে দুধকলা খেয়ে প্রভাবশালী শক্তি হয়ে উঠেছে। জামাত ছাড়াও এখন তাদের নতুন নতুন দল ও প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া তাদেরকে কিছুটা ব্যাকফুটে ঠেলে দিলেও আত্মরক্ষার্থে তারা আক্রমণাত্মক ও মরিয়া হয়ে উঠেছে। তথাকথিত ইসলামী বিপ্লবের জন্য তারা বাহিনী গঠন করে সহিংস জঙ্গি তত্পরতা চালানোর পাশাপাশি যুদ্ধপরাধীদের বিচার বানচাল করতে সন্ত্রাসী তাণ্ডব পরিচালনা করছে। একই সাথে তারা রাজনৈতিক দেন-দরবার ও কৌশলী রাজনৈতিক ম্যানুভারের পদক্ষেপও গ্রহণ করছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয়ই ক্ষমতার সমীকরণ মিলানোর তাগিদে তাদেরকে পক্ষে আনার বা রাখার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া কিভাবে অগ্রসর হয়, জামাতসহ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো কখন কার সাথে হাত মিলিয়ে কি কৌশল নেয়, বড় দুই বুর্জোয়া দল ও সাম্রাজ্যবাদসহ বিদেশি শক্তির প্রশ্রয় ও মদদে তারা তাদের ‘ইসলামী বিপ্লবের’ জেহাদী আন্দোলনকে কখন কিভাবে চালনা করে—এসব উপাদান রাজনীতির অনিশ্চয়তাকে বাড়িয়ে তুলছে।

    বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমেরিকা, ভারত, পাকিস্তানসহ বিদেশি রাষ্ট্রগুলো গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের পাশাপাশি তারা বাংলাদেশকে তাদের নিজ-নিজ ভূ-রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজিতে অঙ্গীভূত করতে চায়। এসব বিদেশি শক্তিগুলোর স্বার্থে মিল ও অমিল—দু’রকমই আছে। গুরুতর দ্বন্দ্বও আছে। এসব সমীকরণ সব সময় এক থাকে না। ফলে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে তাদের তাত্ক্ষণিক কৌশল কখন কি হবে তা ষোল আনা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এই অনিশ্চয়তার ধাক্কা এসে পড়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও। তাছাড়া, এসব প্রভাবশালী বিদেশি শক্তির অনেকেই বাংলাদেশে এক ধরনের ‘নিয়ন্ত্রিত নৈরাজ্য’ বজায় রাখার স্থায়ী স্ট্র্যাটাজি বহুদিন ধরে অনুসরণ করছে। সবসময় একটি সাসপেন্সের পরিস্থিতি বজায় রাখার জন্য তারাও নানাভাবে কলকাঠি নেড়ে চলছে।

    রাজনীতিতে নীতি-আদর্শের ধারা একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতা কেন্দ্রিক ‘উপযোগিতা’ (expediency)-এর বিবেচনাই এখন প্রধান হয়ে উঠেছে। ফলে কে কখন কি করবে, ঘটনাবলী কোন দিকে প্রবাহিত হবে ইত্যাদি বিষয়ে রাজনৈতিক লজিক ব্যবহার করে নিখুঁত ভবিষদ্বাণী করাটা দুষ্কর। সব সময় বাতাসে ভাসছে, কি যেন একটা কিছু হবে হবে ভাব। অথচ কি হতে যাচ্ছে তা কেউ বলতে পারে না। কখনো গুজবই সত্য হয়ে উঠে। কখনো আবার গুজবের বাইরে অচিন্ত্যনীয় ঘটনা ঘটে যায়। অনেকটা হিচ্ককের ‘সাসপেন্স ফিল্মের’ মতো। কিন্তু পার্থক্য একটাই। হিচ্ককের ‘সাসপেন্স ফিল্মের’ একজন পরিচালক আছে। তিনি অ্যালফ্রেড হিচ্কক। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে এককভাবে তেমন কোনো অ্যালফ্রেড হিচ্কক নেই। নেই কোনো একক পরিচালক। তাই, কে বলতে পারবে যে কি ঘটতে যাচ্ছে রাজনীতির অঙ্গনে।

    লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি

    E-mail : selimcpb@yahoo.com