রানা প্লাজা ট্রাজেডি: আরো ১১টিসহ ৫৪৩ মৃতদেহ উদ্ধার

    0
    422

    সাভার, ০৪ মে : সাভারে ধসে পড়া রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে আজ শনিবার সকালে ১১ জনের গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে গত ১১ দিনে উদ্ধার করা মৃতদেহের সংখ্যা দাঁড়ালো ৫৪৩টি। আজ শনিবার ভোর ৬টা থেকে সকাল সোয়া ১১টা পর্যন্ত ১১টি গলিত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব লাশের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি।
    এখনো অনেক লাশ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আটকে রয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে স্থাপন করা সেনাবাহিনীর কন্ট্রোল রুম থেকে জানানো হয়, দুর্ঘটনার ১১তম দিন আজ শনিবার সকাল ১১টা পর্যন্ত ৫৪৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৪৪ জনের মরদেহ হস্তান্তর করা সম্ভব হয়েছে। এদিকে, রানা প্লাজার সামনে ও অধরচন্দ্র স্কুল মাঠে শোকাহত স্বজনেরা এখনো অপেক্ষা করছেন তাদের প্রিয় মানুষটির মৃতদেহ ফিরে পাওয়ার আশায়।
    ভবন ধসে পড়ার ঘটনায় বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের পরিবেশ ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনা হয়, এখনো হচ্ছে। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভবন ধসের ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনা করে।
    সাভারে রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনাকে সাম্প্রতিক ভয়াবহতম ভবনধস হিসেবে উল্লেখ করেছে আন্তর্জাতিক এক গণমাধ্যম। এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৫৪৩ জনে দাঁড়িয়েছে। সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে বসানো অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ কক্ষের বোর্ডে আজ শনিবারৎ সকাল ১১টায় লিখে দেয়া হয় এই সংখ্যা। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ফায়ার সার্ভিস ও রেড ক্রিসেন্টের উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপ থেকে কংক্রিট সরানোর পাশাপাশি লাশের সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন।
    ভবন ধসের ঘটনায় আন্তর্জাতিক এ গণমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলায় টুইন টাওয়ার ধসের ঘটনা বাদ দিলে সাম্প্রতিক বিশ্বের ইতিহাসে সাভারেই বাণিজ্যিক ভবন ধসে সবচেয়ে বেশি মানুষ হতাহত হয়েছে।  এর আগে ১৯৯৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে ডিপার্টমেন্ট স্টোর স্যামপুং ধসে ৫০২ জন নিহত হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় আহত হয়েছিলেন প্রায় এক হাজার মানুষ। 
    রানা প্লাজায় লাশ উদ্ধারের পর পরই স্বজনদের সনাক্ত করার জন্য সেগুলো নেয়া হচ্ছে সাভারের অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে। সেখানে অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ কক্ষে দায়িত্বরত পুলিশ উপ পরিদর্শক ফরিদ উদ্দিন জানান, আজ শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত তারা ৪৪৪ জনের লাশ হস্তান্তর করেছেন। পচন ধরায় কিছু লাশ আগেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়, যাদের মধ্যে পরিচয় না পাওয়া ৩২ জনকে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।  
    উদ্ধার অভিযানের দশম দিনে ক্রেন, ডোজার ও লোডার ব্যবহার করে উদ্ধারকর্মীরা ভবনের চারপাশ থেকে কংক্রিটের স্তূপ সরিয়ে নিচ্ছেন। ছাদের অংশও টুকরো টুকরো করে সরিয়ে নেয়ার কাজ চলছে। ট্রাকে করে এসব কংক্রিটের স্তূপ সরিয়ে  নেয়া হচ্ছে বংশী নদীর তীরে। উদ্ধার অভিযানের নেতৃত্বে থাকা নবম পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী বৃহস্পতিবারই সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ধসের এতো দিন পর আর কাউকে ধ্বংসস্তূপে জীবিত পাওয়ার আশা তারা করছেন না। লাশ গুম করা হচ্ছে এমন অভিযোগ অস্বীকার করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবাইকে উদ্ধার কাজে শামিল হতে আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। গতকাল শুক্রবার সকালে তিনি বলেন, অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে আমাদের মৃতদেহগুলো উদ্ধার করতে হচ্ছে। না হলে সেগুলো অক্ষত অবস্থায় বের করে আনা সম্ভব না।ধ্বংস্তূপ থেকে সব লাশ উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত অভিয়ান চলবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
    এদিকে ভবন ধসের পর এখনো ঠিক কতজন নিখোঁজ রয়েছে সেই সংখ্য নিয়ে বিভ্রান্তি এখনো কাটেনি। বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া লাশের সংখ্যা কমিয়ে দেখানো হচ্ছে বলে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার পর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, লাশ গুমের প্রশ্নই ওঠে না। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৪৯ জন নিখোঁজ থাকার কথা বলা হলেও রেড ক্রিসেন্টের হিসাবে এই সংখ্যা চারশরও বেশি।
    স্থানীয় প্রশাসন প্রথম দিকে স্বজনদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে নিখোঁজদের তালিকা করা শুরু করলেও গত বুধবারই তা বন্ধ করে দেয়া হয়। সকালে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ পরিদর্শন আসেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ।
    ভবনের স্তম্ভ ধরে হরতালসমর্থকদের ‘টানাহেচড়ায়’ রানা প্লাজা ধসে পড়তে পারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে সরকারের শরিক এরশাদ বলেন, নিজের দলের লোকজনকে বাঁচাতেই মন্ত্রী এমন কথা বলেছেন। 
    সেনা সদস্যরা এ অভিযানে অংশ না নিলে প্রায় আড়াই হাজার মানুষকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হতো না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
    এর আগে শুক্রবার ভোর ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে আরো ৪৬ লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস ও রেডক্রিসেন্ট কর্মীরা। এদের মধ্যে প্রমীলা, মামুন, জাহাঙ্গীর, তাহসান আহমেদের ও সর্বশেষ রাশিদার নাম জানা গেছে।
    গতকাল দুপুর পৌনে ২টায় উদ্ধার করা ৩ মৃতের মধ্যে একজনের নাম রাশিদা। তার কাছে থাকা একটি সাদা কাগজ থেকে নাম ও আইডি (আইডি নং ১৪১৫২) নম্বর জানা যায়। এদিকে দুপুর দেড়টায় উদ্ধার করা চার জনের মধ্যে একজন তাহসান আহমেদ। এসময় সেনাবাহিনী তার পকেট থেকে একটি কাগজ ও সেলফোন উদ্ধার করে। এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় তার বাড়ি রাজশাহী জেলায়।
    এছাড়া গতকাল  সকাল ৬টার পর প্রমীলার মৃতদেহ উদ্ধার করার সময় তার সঙ্গে আইডি কার্ড পায় উদ্ধারকর্মীরা। আইডি কার্ডের তথ্য মতে, প্রমীলা রানা প্লাজার একটি পোশাক কারখানায় সুইং এ সেকশনে কর্মরত ছিলেন। জাহাঙ্গীরের বাড়ি গাজিপুরের জয়দেবপুরে। জাহাঙ্গীর ও মামুনের পকেটে সেলফোন পাওয়া গেছে। গতকাল শুক্রবার সকালে উদ্ধার করা পুরুষ লাশের মধ্যে বেশিরভাগের কাছে সেলফোন পাওয়া গেছে। তবে উদ্ধারকৃত নারী লাশগুলোর সঙ্গে সেলফোন পাওয়া যায়নি। এর আগে বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা থেকে ভবনের ছাদের মূল অংশ ভাঙার কাজ শুরু হয়। বিভিন্ন যন্ত্র দিয়ে কেটে ছাদ খণ্ড খণ্ড করে আলাদা করা হচ্ছে। জীবিত কিংবা মরদেহ উদ্ধারের জন্য সতর্কতার সঙ্গেই ভাঙ্গার কাজ চলছে।তবে ভবন ধসের ৯ দিন পার হয়ে গেলে জীবিত থাকার আশা ছেড়ে দিয়ে রানা প্লাজা ও অধরচন্দ্র স্কুল মাঠে এখনো স্বজনেরা অপেক্ষা করছে তাদের প্রিয় মানুষটির মৃতদেহ ফিরে পাওয়ার আশায়।
    গত ২৪ এপ্রিল বুধবার সকাল পৌনে ৯টার দিকে সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছে সোহেল রানা মালিকানাধীন নয়তলা বাণিজ্যিক ভবন ‘রানা প্লাজা’ ধসে পড়ে। এতে ব্যাপক প্রাণহানির এ ঘটনা ঘটে। এছাড়া আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে কমপক্ষে আড়াই হাজার শ্রমিককে। নবম পদাতিক ডিভিশনের সমন্বয়ে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সে সময় ওই ভবনে থাকা ৫টি পোশাক কারখানায় কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করছিলেন। এর আগের দিন ভবনটিতে ফাটল দেখা দেয়।