জেলহত্যা মামলার আসামি খায়রুজ্জামান মালয়েশিয়া থেকে গ্রেফতার

0
472
জেলহত্যা মামলার আসামি খায়রুজ্জামান মালয়েশিয়া থেকে গ্রেফতার
জেলহত্যা মামলার আসামি খায়রুজ্জামান

আমারসিলেট ডেস্কঃ বাংলাদেশের অনুরোধে সাবেক হাইকমিশনার এবং জেলহত্যা মামলার অন্যতম আসামি মেজর (অব.)এম খায়রুজ্জামানকে গ্রেফতার করেছে মালয়েশিয়ান পুলিশ। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজা জাইনুদ্দিন মালয়েশিয়ার দ্য স্টার পত্রিকায় বৃহস্পতিবার ১০ ফেব্রুয়ারি এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, প্রক্রিয়া মেনে বুধবার ৯ ফেব্রুয়ারি খায়রুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি ১০ বছরের বেশি সময় মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছিলেন। জেলহত্যা মামলার আসামি সাবেক এই হাইকমিশনারকে ঢাকায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

এদিকে মালয়েশিয়ায় আটক সাবেক এই রাষ্ট্রদূতকে শীঘ্রই দেশে ফিরিয়ে আনা হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহরিয়ার আলম। জেলহত্যা মামলায় পুনরায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেছেন, মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ আছে কি না, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় তা খতিয়ে দেখবে। বৃহস্পতিবার দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানিয়েছেন। জনকণ্ঠ থেকে

জেলহত্যা মামলার অন্যতম আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল ও জেলহত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাহার আকন্দ সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, জেলহত্যা মামলায় নিম্ন আদালত মেজর (অব.) এম খায়রুজ্জামানকে খালাস দিয়েছিলেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, শুধু এটা নয়, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের আমরা অব্যাহতভাবে খুঁজি। আপনাদের সবসময় বলাও হয় না, বলার প্রয়োজনও নেই সুনির্দিষ্ট অবস্থান জানা না থাকলে। আমরা জানতাম তিনি মালয়েশিয়ায় আছেন, মালয়েশিয়া থেকে বের হতে পারেনি। পশ্চিমা বিশ্বের কিছু দেশ যেমন এ ধরনের অপরাধীদের আশ্রয় দিয়েছে মালয়েশিয়ায় সে সুযোগ নেই।

বুধবার মালয়েশিয়ার আমপাং, সেলাঙ্গর এলাকার একটি এ্যাপার্টমেন্ট থেকে পুলিশ খায়রুজ্জামানকে গ্রেফতার করে। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজা জাইনুদ্দিন বলেন, ‘একটি অভিযোগ থাকায়’ খায়রুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ বিষয়ে ‘তার দেশের একটি অনুরোধ রয়েছে।’

এদিকে জেলহত্যা মামলার কারণেই তাকে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে কি-না, বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘যে কোন প্রবাসী যদি কোন অপরাধ করেন, আপনারা জানেন যে, একজন প্রবাসী যদি প্রবাসে ওভার স্টে করে বা ইরেগুলারিটিজের মধ্যে পড়েন, তাকে আমরা ফিরিয়ে আনি যে প্রক্রিয়ায়, সেই প্রক্রিয়ায় তাকে ফিরিয়ে আনা হবে। এর সঙ্গে এ মামলাটির সম্পর্ক রাখার বা দেখানোরও কোন প্রয়োজন নেই।’ ইমিগ্রেশন ল ভায়োলেট করেছে, মালয়েশিয়া সরকার আমাদের বলেছে, আমরা বাংলাদেশের একজন নাগরিককে ফিরিয়ে আনছি, এটুকুই।

আওয়ামী লীগের সময় গ্রেফতার হলেও বিএনপির সময়ে মুক্তি পেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি পাওয়া এবং পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে খায়রুজ্জামানের হাই কমিশনারের দায়িত্ব পাওয়া প্রসঙ্গেও কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘তিনি জেলহত্যার একজন আসামি ছিলেন এবং আওয়ামী লীগের প্রথম মেয়াদে যে মামলাটি চালু হয়, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।’ পরবর্তীতে ২০০১ সালে খালেদা জিয়া সরকার তাকে প্যারেলে মুক্তি দেয় এবং মুক্তি দেয়ার পরে তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতিও দেয়। ‘ওয়ান-ইলেভেনে তত্ত্ববধায়ক সরকারের শেষ দিন পর্যন্ত এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হবার দিনও তিনি মালয়েশিয়াতে ছিল হাই কমিশনার হিসেবে, আমরা তখন তাকে রিকল করেছিলাম। কিন্তু তিনি তখন থেকে পলাতক।’

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, খায়রুজ্জামানকে ডিপোটেশন সেন্টারে কারাঅন্তরীণ করে রাখা হয়েছে। আমি যতদূর বুঝি, আবারও তাকে সশরীরে জিজ্ঞাসাবাদ করার এবং মামলাটিকে খতিয়ে দেখার সুযোগ আছে। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চিঠিতে অভিবাসন সংক্রান্ত একটি আইন ভাঙ্গার কথা জানিয়েছে। এটা দূতাবাস জানে আমার এই মুহূর্তে জানা নেই। হয়তো ওভার স্টে, যে প্রক্রিয়ায় তিনি ছিলেন হয়তো সেটা এক্সপায়ার করে গেছে। কোন আইন তিনি ভেঙ্গেছেন, সেটার আওতায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত খায়রুজ্জামানকে ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর কারাগারে নিহত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামান হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল। জেলহত্যার পর খায়রুজ্জামানকে সেনাবাহিনী থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দিয়ে কায়রোতে বাংলাদেশ দূতাবাসে নিযুক্ত করা হয়। সেখানে তিনি ১৯৭৬-১৯৮৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তাকে গ্রেফতার করে এবং ওই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর তাকে অবসরে পাঠায়। গ্রেফতার ও অবসরের আগে তিনি ফিলিপিন্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতা এলে তিনি জামিনে মুক্তি পান। ২০০৩ সালে তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মহাপরিচালক হিসেবে পুনর্বহাল করা হয়। পরে ২০০৪ সালে বিচারিক আদালতের মাধ্যমে তিনি জেলহত্যার অভিযোগ থেকে খালাস পান। খালাস পাওয়ার পর তাকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। ২০০৫ সালে তিনি মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন। এরপর ২০০৭ সালে পূর্ণাঙ্গ সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে প্রথম শ্রেণীর রাষ্ট্রদূতের পদমর্যাদা ও মর্যাদাসহ মালয়েশিয়ায় হাইকমিশনার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে খায়রুজ্জামানকে ঢাকায় ফিরে আসতে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু তিনি কুয়ালালামপুরে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থায় (ইউএনএইচসিআর) গিয়ে আবেদন করেন। পরে ইউএনএইচসিআরের একটি পরিচয়পত্র পান তিনি এবং উদ্বাস্তু হিসেবে দেশটিতে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করছিলেন। খায়রুজ্জামান হলেন জিয়াউর রহমানের সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী প্রয়াত মশিউর রহমান যাদু মিয়ার জামাতা। যাদু মিয়ার ছোট মেয়ে রিটা রহমানের স্বামী তিনি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট সহচর এবং স্বাধীন বাংলার প্রথম সরকারকে নেতৃত্ব দেয়া জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের পর ২১ বছর হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জেলহত্যা মামলা পুনরুজ্জীবিত করে।
এ মামলায় ২০০৪ সালে পলাতক তিন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তাদের মধ্যে একজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ২০০৮ সালে হাইকোর্ট রায় দেয়, বাকি দুজনকে খালাস দেয়া হয়। রাষ্ট্রপক্ষের আপীলে ২০১৩ সালে আপীল বিভাগের রায়ে তিনজনকেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তবে পলাতক থাকায় তাদের কারও সাজা কার্যকর করা যায়নি।

সাবেক হাইকমিশনার খায়রুজ্জামান গ্রেফতার ‘ঢাকার অনুরোধেই’
মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজা জয়নুদ্দিন বৃহস্পতিবার দেশটির প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রজায়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রক্রিয়া অনুযায়ী সাবেক এ হাইকমিশনারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাংলাদেশে সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার জন্য তাকে (খায়রুজ্জামান) আটক করতে বাংলাদেশ অনুরোধ জানিয়েছিল।
বৃহস্পতিবার দুপুরে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চিঠিতে অভিবাসন সংক্রান্ত একটি আইন ভাঙ্গার কথা জানিয়েছে। কোন আইন তিনি ভেঙ্গেছেন, সেটার আওতায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আরেক প্রশ্নের জবাবে শাহরিয়ার আলম বলেন, শরণার্থী কার্ড তার আছে কি না আমি জানি না। মালয়েশিয়া সরকার বলেছে, নির্দিষ্ট করে, অভিবাসন সংক্রান্ত আইন ভাঙ্গায় তাকে আটক করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, খুব দ্রæত তাকে ফিরিয়ে আনতে পারব। তারপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইন মন্ত্রণালয় মিলে সিদ্ধান্ত নেবে মামলাটির কোন পার্যায়ে তাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। অথবা মামলাটি কীভাবে পুনরুদ্ধার করা হবে।