খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গৌরবদীপ্ত আয়োজন

    0
    450

    গতকাল চৈত্রের শেষ বিকেলে সোনারগাঁও হোটেলের বলরুম আলো করেছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তাঁদের নিয়েই ছিল গৌরবদীপ্ত আয়োজন। বাঙালির বীর নায়কদের নিয়েই ছিল আয়োজন।
    একাত্তরে রণাঙ্গনে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করেছিলেন যাঁরা। যাঁরা বীরত্বের জন্য খেতাব পেয়েছিলেন, তাঁদের সংগ্রামী ভূমিকা গত ২০১১ সালের ২৭ মার্চ থেকে প্রকাশিত হতে থাকে প্রথম আলোতে। পরে সেগুলো প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় প্রথম আলো ও এইচএসবিসির যৌথ উদ্যোগে। বীরত্বের জন্য ৬৭৬ জনকে খেতাব দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে তিন শ জনের সংগ্রামী কাহিনি নিয়ে একাত্তরের বীরযোদ্ধা নামের প্রথম খণ্ডটি প্রকাশিত হয়েছিল গত বছর। গতকাল ৩১৬ জনের কাহিনি নিয়ে প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় খণ্ড। এই বইটিরই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন দেশের এই বীর সন্তানেরা।
    অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীরা। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানিয়েই শুরু হয়েছিল আনুষ্ঠানিকতা। প্রধান অতিথি মুক্তিবাহিনীর উপ-সর্বাধিনায়ক ও পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার। বিশেষ অতিথি ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রী মিলি রহমান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন শহীদ ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে নুজহাত চৌধুরী।
    প্রধান অতিথি এ কে খন্দকার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের শতকরা ৮০ জনই ছিলেন গ্রামের সাধারণ মানুষ। তাঁদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। কিন্তু দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা নিয়ে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে সবাই অংশ নিয়েছিলেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এই সংগ্রামীদের বীরত্বের কাহিনি জাতির ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। বাঙালি চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁদের স্মরণ করবে।’ তিনি বলেন, ‘বিগত সময়ে প্রত্যাশিত অনেক কিছুই অর্জন করা যায়নি। তবে যে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে উঠে এসেছে, তাদের সঙ্গে মিলে ভবিষ্যতে দেশকে নিয়ে আমরা যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, তা বাস্তবায়িত করতে পারব। এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
    সেই কঠিন সংগ্রামের দিনগুলোর স্মৃতিই আলোচনায় ঘুরেফিরে আসছিল। বিশেষ অতিথি মিলি রহমান বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বললেন, ‘আমি মনে করি, মতিউর রহমানসহ কেবল সাতজনই বীরশ্রেষ্ঠ নন; মুক্তিযুদ্ধে যে ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ হয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই বীরশ্রেষ্ঠ।’ তিনি বলেন, ‘আজ এখানে শুধু বইয়ের মোড়ক উন্মোচন নয়, ইতিহাসের উন্মোচন ঘটছে। মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবগাথার এই ইতিহাস নতুন প্রজন্মের জন্য খুবই প্রয়োজন।’ তিনি একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানকে তুলে ধরার আহ্বান জানান।
    এইচএসবিসির করপোরেট ব্যাংকিং প্রধান মাহবুব-উর-রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলেন, ‘প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গৌরব করবে। আপনাদের প্রতি আমাদের ঋণ কোনো দিন শোধ হবে না।’ FF with organised
    প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘এই বইটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি আকর গ্রন্থ হিসেবে ভবিষ্যতে বিবেচিত হবে।’
    এরপর যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে কবি শামসুর রাহমানের কবিতা ‘আমি অভিশাপ দিচ্ছি’ আবৃত্তি করেন সাংসদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর। আবৃত্তির শুরুতেই তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে গ্রামবাংলার অসংখ্য মানুষ অংশ নিয়েছিলেন, যাঁরা কোনো কিছুই প্রত্যাশা করেননি। তাঁদের অনেকেই দুঃখ-কষ্টে জীবন যাপন করছেন। এর পরপরই অতিথিরা একাত্তরের বীরযোদ্ধা গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন। সবাই আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে করতালির মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানান।
    একাত্তরের বীরযোদ্ধা দ্বিতীয় খণ্ডে সাত বীরশ্রেষ্ঠ, ৩৯ বীর উত্তম, ৭৮ বীর বিক্রম এবং ১৯২ জন বীর প্রতীকের সংগ্রামী কাহিনি প্রকাশিত হয়েছে। সম্পাদনা করেছেন মতিউর রহমান, সংগ্রহ ও গ্রন্থনা করেছেন রাশেদুর রহমান। বইটির প্রচ্ছদ অলংকরণ করেছেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, সহযোগী শিল্পী ছিলেন অশোক কর্মকার।
    শেষে ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের গান। আবদুল জব্বার গেয়ে শোনান ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’। পরে তাঁর সঙ্গে শাহীন সামাদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, তিমির নন্দী, কাদেরি কিবরিয়া, মালা খুররম ও ডালিয়া নওশীন সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশন করেন ‘নোঙ্গর তোলো তোলো,’ ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’। ‘ছোটদের বড়দের সকলের’ গেয়ে অনুষ্ঠান শেষ করেন রথীন্দ্রনাথ রায়।