কোটি টাকার প্রকল্পে অভিযোগ করলেই মামলাঃহবিগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর তীর প্রকল্পে অনিয়ম সংক্রান্ত অভিযোগে

0
224

নূরুজ্জামান ফারুকী,বিশেষ প্রতিনিধিঃ হবিগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর তীর রক্ষায় মেগা প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নদীতীরের বাসিন্দারা।কোটি টাকার প্রকল্পে অভিযোগ করলেই মামলা লাগিয়ে দিবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।

তারা বলছেন, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করায় কাজ শেষ হওয়ার আগেই প্রকল্পের বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় ব্লক দেবে গেছে। হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) আওতায় ৫৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের কাজ চলছে।

পাউবো এবং সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ফাটল ও দেবে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছে। পাউবো বলছে, ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে পুনরায় কাজ করা হবে। তারা বিষয়টি নিয়মিত তদারকি করছে বলেও জানায়।

জানা যায়, হবিগঞ্জের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ‘কুশিয়ারা ডাইক’ প্রতিবছর বর্ষায় ভেঙে যায়। এতে জেলার নবীগঞ্জ, সিলেটের ওসমানীনগর ও মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামসহ ভাটি ও হওড়াঞ্চলের বাড়িঘর এবং কয়েক হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে যায়।

নদীতীরের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কুশিয়ারার উভয় তীর রক্ষায় প্রায় সাড়ে ৭ কিলোমিটার এলাকায় প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণে ৫৭৩ কোটি টাকার প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে কাজ পায় ৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো গোলাম রব্বানী কনস্ট্রাকশন, এএইচ ট্রেডিং করপোরেশন, আরএফএল, নেশন টেক কমিউনিকেশনস ও আবুল কালাম করপোরেশন। তারা ১১টি প্যাকেজে কাজ শুরু করে। ওই বছরের ডিসেম্বর থেকে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এর মধ্যে এএইচ ট্রেডিং, আরএফএল ও নেশন টেকের কাজে ফাটল দেখা দিয়েছে। তবে আরএফএল-এর পরিচালক রাসেল আহমদের দাবি, শুধু তাদের নয়, সবার কাজেই ফাটল দেখা দিয়ে নিচে দেবে গেছে। তারা সবাই কাজের সংশোধনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, কাজ শুরুর পর থেকে কুশিয়ারার তীর প্রতিরক্ষায় ব্লক নির্মাণে মাটিযুক্ত বালু, নুড়ি পাথর, ছোট পাথরের জায়গায় বড় পাথর, গোটা পাথর, মরা পাথর ও পাথরের সঙ্গে ধুলোবালিযুক্ত অবস্থায় ঢালাই, ইটের খোয়া মিশ্রণ, অধিকাংশ স্থানে সিমেন্টের তুলনায় অতিরিক্ত বালি ব্যবহারসহ নানা অনিয়ম হয়েছে। তদারকির দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের জোগসাজশেই এমন অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, নবীগঞ্জের পাহাড়পুর অংশে এএইচ ট্রেডিংয়ের শ্রমিকরা ব্লক নির্মাণ করছেন। সেখানে গুণগত মানের সিমেন্ট ব্যবহার করা হলেও মরা পাথর ও অতিরিক্ত বালু ব্যবহার করতে দেখা যায়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট কর্মকর্তা আরাফাত খান কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এছাড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশন টেক ও আরএফএল নিম্নমানের মালামাল দিয়ে ব্লক নির্মাণের ফলে লামা তাজপুর এলাকার খোয়াজ উল্লাহ, জিলু মিয়া ও বাছিত মিয়ার বাড়ির সামনেসহ বেশ কিছু স্থানে ব্লক দেবে গেছে। বড় বড় ফাটলও দেখা দিয়েছে।

শেরপুর এলাকার জুয়েল আহমদ বলেন, বন্যা নিয়ন্ত্রণে প্রতিরক্ষা প্রকল্প নির্মাণ ছিল সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার করায় প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আগেই ব্লক দেবে যাচ্ছে।

তাজপুর এলাকার তফুর আলী বলেন, নিম্নমানের বালি ও মরা পাথর দিয়ে শুরু থেকেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্লক নির্মাণ করে আসছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা আসেন সবকিছুই দেখেন কিন্তু কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও অফিসাররা মিলেমিশেই দুর্নীতি করে আসছে। তাই এলাকার মানুষ মামলার ভয়ে প্রতিবাদ করে না।

লামা তাজপুরের খোয়াজ উল্লাহ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রতিবাদ কে করবে, কোথায় করবে। ৫০০-৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প, আমরা প্রতিবাদ করলে অল্পকিছু টাকা খরচ করলেই আমাদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা যাবে। এছাড়া অফিসাররা সবকিছু জানেন; কিন্তু চুপ হয়ে আছেন। কেন চুপ, সেটা তো সবাই জানেন।

ওই এলাকার জিলু মিয়া বলেন, নিম্নমানের পাথর ব্লক তৈরি করা হচ্ছে। কাজে বালু-পাথর ও সিমেন্ট মিশ্রণের সঠিক অনুপাত মানা হচ্ছে না।

নবীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হক চৌধুরী সেলিম বলেন, ব্লক নির্মাণে অনিয়ম-দুর্র্নীতির বিষয়ে দ্রুত কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই।

হবিগঞ্জ-১ আসনের সংসদ-সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ মিলাদ বলেন, এত কষ্ট করে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় প্রকল্প নিয়ে এলাম; কিন্তু ব্লক নির্মাণে বিভিন্ন অভিযোগ উঠছে, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ বলেন, কিছু স্থানে ব্লক নির্মাণে নিম্নমানের পাথর ও বালি ব্যবহারের অভিযোগ এবং কিছু স্থানে নরম মাটি থাকার কারণে ব্লক দেবে গেছে বলে জেনেছি। এরপর আমরা সরেজমিনে ওইসব স্থান পরিদর্শন করেছি এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেবে যাওয়া ব্লক পুনরায় বালি ও জিও টিউব দিয়ে বসানোর নির্দেশনা দিয়েছি। আমরা নিয়মিত তদারকি করছি