কেবলমাত্র সংযমকারী বিশ্বাসীদের কুরবানীই কবুল হয়ে থাকে

    0
    319

    “পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম (’আলাইহিস সালাম) তার সন্তান হাবিল ও কাবিল থেকেই কুরবানীর এই মহান ত্যাগের সুচনা” 

    “তাঁর কাছে কুরবানীর রক্ত ও গোশত পৌঁছে না; পৌঁছে কেবল কুরবানিদাতার তাকওয়া বা ধার্মিকতা। ইবাদত কবুলের প্রধানতম শর্ত হচ্ছে, হালাল-রুজি। তাই, হারাম মাল থেকে কুরবানী করা বিলকুল হারাম”

    পবিত্র ঈদুল আযহা বা কুরবানীর (আরবি: قربانى ) ঈদ হচ্ছে, ত্যাগের বিনিময়ে আনন্দ লাভের ঈদ। সামর্থ্যবান ঈমানদারগণ (বিশ্বাসীরা) শরীয়তে নির্ধারিত গৃহপালিত সুস্থ ও সার্বিক সক্ষম পশু ক্রয় করে বা পালন করে কুরবানী করে তাদের স্রষ্টা মহামহিম আল্লাহ জাল্লা শানুহু’র দরবারে নিজেদের ত্যাগ সুনিপুণভাবে পেশ করে থাকেন।

    কুরবানীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:  যারা বলে ইসলাম এর বয়স মাত্র ১৫০০ বছর এবং কুরবানীর ত্যাগের ইতিহাস আরও কম;তারা ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ। কুরবানীর ত্যাগ  প্রথম মানব হযরত আদম’র (’আলাইহিস সালাম) সময় থেকেই চালু হয়েছে। আল-কোরআনে রয়েছে, আদমের দু’ ছেলের (হাবিল ও কাবিলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদের যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও। যখন উভয়ে কুরবানী করলো – তখন একজনেরটা কবুল হলো এবং আরেকজনেরটা কবুল হলো না। তাদের একজন বললো: আমি তোমাকে হত্যা করবোই। আরেকজন বললো: আল্লাহ তো সংযমীদের কুরবানিই কবুল করে থাকেন (সূরা আল-মায়িদা)।

    আরেক জায়গায় বলা হয়েছে, ইব্রাহীম যখন আমার কাছে দোয়া করলো: হে আমার প্রভু! তুমি আমাকে একটি নেককার ছেলে দান করো।” তখন আমি তাকে একটি ধৈর্যশীল ছেলের সু-সংবাদ দিলাম। অতঃপর সে যখন তার বাবার সঙ্গে চলাফিরা করার বয়সে পৌঁছলো – তখন ইব্রাহীম বললো: বাছা, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবাই করছি! এখন বলো যে, তোমার মত কী ? সে বললো: বাবা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে – আপনি তা-ই করুন। আল্লাহ্ চাইলে, আপনি আমায় ধৈর্যশীলই পাবেন। দু’ জনেই যখন আনুগত্যে মাথা নুইয়ে দিলো এবং ইব্রাহীম তাকে কাত করে শুইয়ে দিলো – তখন আমি তাকে ডাক দিলাম: হে ইব্রাহীম! তুমি স্বপ্নাদেশ বাস্তবায়ন করলে।এভাবেই আমি নেককারদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। এটি ছিলো নির্ঘাত একটি স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি এক মহান কুরবাণীর বিনিময়ে ছেলেটিকে ছাড়িয়ে নিলাম। আর আমি তাঁকে পরবর্তীদের কাছে স্মরণীয় করে রাখলাম। ইব্রাহীমের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক! আমি এভাবেই নেককারদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। সে আমার ঈমানদার বান্দাদের অন্তর্গত ছিলো (সূরা সাফফাত:১০০-১১১)।

    কুরবানি সুন্নতে ইব্রাহীম: দুনিয়ায় প্রথম কুরবানি হাবিল ও কাবিল দিয়েছিলো। মহানবীর (আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম) আগেকার নবীগণের (’আলাইহিমুস সালাম) প্রতি উম্মতে মুহাম্মদীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শন হচ্ছে, প্রধানতম ধর্মীয় উৎসব কুরবানির ঈদ। মুসলিম জাতির জনক হযরত ইব্রাহীম (’আলাইহিস সালাম) কর্তৃক তাঁর ছেলে হযরত ইসমাইলকে (’আলাইহিস সালাম) কুরবানি করার ঘটনা স্মরণ করে মুসলমানগণ তা পালন করে থাকেন। যিলহজের ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত কুরবানি করা যায়। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন: প্রত্যেক উম্মতের জন্যে আমি কুরবানির বিধান রেখেছিলাম যেনো তারা ঐ পশু জবাই করার সময় আল্লাহর নাম এই ভেবে স্মরণ করে যে, তিনি চতুষ্পদ জন্তু থেকে তাদের জন্যে রিজিক রেখেছেন (সূরা হজ)।

    এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা নাসাফী ও যামাখশারী তাদের তাফসীরে লিখেছেন: আদম থেকে মুহাম্মাদ (’আলাইহিমুস সলাতু ওয়াস সালাম) পর্যন্ত প্রত্যেক জাতিকে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর নৈকট্য পেতে কুরবানির বিধান দিয়েছেন; অর্থাৎ প্রত্যেক শরীয়তে কুরবানির বিধান ছিলো এবং এখনো ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মে তা দেখা যায়। অবশ্য সেসব কুরবানির কোন বর্ণনা কোনো কিতাবে নির্দিষ্টভাবে পাওয়া যায় না। তাই, ওগুলোর নিয়ম-কানুন জানা যায়নি। আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সালাম এ ব্যাপারে ভালো জানেন।

    আল্লাহর কাছে কুরবানী দাতার তাকওয়াই শুধু পৌঁছে: আমরা কুরবানির গোশত খেলেও কুরবানির লক্ষ্য আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা। তাঁর কাছে কুরবানির রক্ত ও গোশত পৌঁছে না; পৌঁছে কেবল কুরবানিদাতার তাকওয়া বা ধার্মিকতা। ইবাদত কবুলের প্রধানতম শর্ত হচ্ছে, হালাল-রুজি। তাই, হারাম মাল থেকে কুরবানি করা বিলকুল হারাম। নবীজী যেভাবে কুরবানির নিয়ম শিখিয়ে গেছেন, সেভাবে কুরবানি করলেই আল্লাহ্পাক খুশি হবেন। নবীজী ফরমান: কুরবানির দিনে (কুরবানির পশুর রক্ত) বইয়ে দেয়ার চেয়ে আদম সন্তানের আর কোনো আমল আল্লাহর কাছে প্রিয় নয়। এদিন (কুরবানির পশুর) রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহ’র কাছে কবুল হয়ে যায়। কাজেই, তোমরা সানন্দে কুরবানি করো। কুরবানির পশুর প্রতিটি লোমের বদলে একটি করে সাওয়াব পাওয়া যায়। আর রোজ হাশরে কুরবানির পশু কুরবানিদাতাকে পিঠে করে নিয়ে পুলসিরাত পার করিয়ে জান্নাতে পৌঁছিয়ে দেবে।

    যার উপর কুরবানী ওয়াজিবঃ স্বাধীন, মুকিম ও মালেকে নেসাব, অর্থাৎ যতোটুকু সম্পদের মালিক হলে, ফেতরা দেয়া ওয়াজিব হয়। মালেকে নেসাবের ব্যাখ্যা হচ্ছে, যিনি মৌলিক চাহিদা বা প্রয়োজনীয় খরচের অতিরিক্ত সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা এ পরিমাণ অর্থ বা জিনিসপত্রের মালিক (ফতওয়ায়ে আলমগীরী)।

    মাসয়ালা: কেউ যদি বলে যে, আমার অমুক কাজ হয়ে গেলে, কুরবানি করবো বা আল্লাহর কসম! এ পশুকে আমি অবশ্যই আল্লাহর ওয়াস্তে কুরবানি করবো – তাহলে, তারা ধনী বা গরীব হলেও তাদের উপর কুরবানি ওয়াজিব (বাদায়ে-৫৬২)।

    মাসয়ালা: কোনো ধনী লোকের মানতের কুরবানি দিয়ে ওয়াজিব কুরবানি আদায় হবে না, বরং তাকে আলাদাভাবে দু’টি কুরবানি (মানত ও ওয়াজিব) করতে হবে। অবশ্য কুরবানির দিন শপথ করলে, শপথের কুরবানি দিয়ে ওয়াজিব কুরবানিও আদায় হয়ে যাবে।

    মাসয়ালা: কুরবানির পশু (উট, গরু ও মহিষ) কেনার আগে অংশীদার ঠিক করে নেয়া উত্তম; কেনার পরেও অংশীদার বানাতে পারবে। কিন্তু মাকরূহ হবে।

    মাসয়ালা: গরীব লোক কুরবানির নিয়তে পশু কেনার পর, তা হারিয়ে গেলে এবং পরে পাওয়া গেলে, তাতে অংশীদার নেয়া মাকরূহ।

    মাসয়ালা: কুরবানির পশুতে (উট, গরু ও মহিষ) জীবিত, মৃত ও আক্বিকার অংশীদার হওয়া যাবে। তবে, শর্ত হচ্ছে, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করাটা সবার উদ্দেশ্য হতে হবে; শুধু গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্য হলে, হবে না।

    মাসয়ালা: কুরবানিদাতা তার মৃত মা-বাবা, দাদা-দাদী নানা-নানী, ভাই-বোন প্রমুখের রূহে সাওয়াব পৌঁছাতে আরেক অংশ কুরবানি দিতে পারবে।

    মাসয়ালা: কুরবানি দেয়া ওয়াজিব – এমন কারো অনুমতি ছাড়া তার তরফে কুরবানি দেয়া হলে, তার ওয়াজিব কুরবানি আদায় হবে না। তখন ঐ পশুতে অন্যান্য শরীকের কুরবানিও হবে না। কিন্তু যার প্রতি বছর এভাবে কুরবানি করার অভ্যাস আছে, তার কুরবানি জায়েয হবে। তবে, এক্ষেত্রেও অনুমতি নেয়া উচিত (কাজী খান)।

    মাসয়ালা: কুরবানির পশু হারিয়ে যাওয়ার পর, আরেকটি কেনা হলে এবং তারপর হারানো পশুটি পাওয়া গেলে, ধনীর (মালেকে নেসাব) জন্যে একটি জবাই করলেই কুরবানি আদায় হবে। কিন্তু গরীবের জন্যে দু’টি পশুই কুরবানি করা ওয়াজিব। তবে, প্রথমটির চেয়ে দ্বিতীয়টির দাম যেনো কম না হয়। কম হলে, (ধনীর ক্ষেত্রে) যতো টাকা কম হবে – তা সদকা করে দিতে হবে (বাদায়ে)।

    মাসয়ালা: সমস্যার কারণে কেউ নির্ধারিত সময়ে কুরবানি দিতে না পারলে, পরে একটি ভেড়া বা ছাগল বা দুম্বার দাম সদকা করে দেয়া ওয়াজিব। আর মৃত্যুযাত্রীর (ধনী) জন্যে অসিয়ত করে যাওয়া কর্তব্য।

    মাসয়ালা: কুরবানির সময় চলে যাওয়ার পর, কুরবানির পশু জবাই করলে, তা সদকা করে দেয়া ওয়াজিব।

    মাসয়ালা: কুরবানির সময়ের মাঝে (১০, ১১ ও ১২ই যিলহজ) কুরবানির পশুর দাম সদকা করে দিলে, কুরবানির ওয়াজিব আদায় হবে না, বরং গুনাহগার হবে। কেননা, কুরবানি নামাজ, রোজা, হজ ও যাকাতের মতোই একটি ইবাদত। যেভাবে নামাজ দিয়ে যাকাতের ফরজ আদায় হয় না – সেভাবে (কুরবানির সময়ে) সদকা দিয়েও কুরবানি আদায় হবে না।

    মাসয়ালা: কুরবানির দিনগুলোতে কুরবানীর নিয়তে হাঁস-মুরগী জাতীয় প্রাণী জবাই করা মাকরূহ (আলমগীরী)।

    মাসয়ালা: নবীজী (’আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম) যেমনি তাঁর মৃত উম্মতের তরফ থেকে কুরবানী করেছেন – তেমনি তাঁর তরফ থেকেও কুরবানি করাটা উম্মতের জন্যে সৌভাগ্য ও সওয়াবের ব্যাপার (বাহারে)। তাই, গরু, উট ও মহিষ দিয়ে কুরবানী করলে, নফল হিসেবে একভাগ তাঁর জন্যে কুরবানি দেয়া উত্তম।

    কুরবানীর পশুর বয়স: কুরবানীর ছাগল অন্তত এক, গরু দু’ ও উট পাঁচ বছর বয়সী হতে হবে। সুন্দর ও নিখুঁত পশু বাছাই করা উত্তম। অন্ধ, খোঁড়া, জবাইয়ের জায়গায় যেতে অক্ষম, লেজ, শিং কিংবা কান কাটা বা ভাঙ্গা বা দুর্বল ইত্যাদি পশু দিয়ে কুরবানি হবে না।

    অংশীদারী কুরবানীর নিয়মঃ গৃহপালিত গরু, মহিষ, উট, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দিয়েই শুধু কুরবানি হবে। ভেড়া, দুম্বা ও ছাগল দিয়ে একজন এবং গরু, মহিষ ও উটের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ সাত জন কুরবানী দিতে পারবে। তবে শর্ত হচ্ছে, সবার কুরবানীর নিয়ত শুধু আল্লাহর ওয়াস্তেই হতে হবে; একজনেরও গোশত খাওয়ার নিয়ত থাকলে, কারোই কুরবানী হবে না। অংশীদাররা কুরবানীর গোশত পাল্লা দিয়ে মেপে ভাগ করে নেবেন। মাপে বেশি-কম যেনো না হয়। কয়েক অংশীদার কুরবানীর পশু কেনার পর, কোনো ভাগ বা অংশ বাকি থাকলে, অন্যকেও শামিল করতে পারবে।

    কুরবানীর নিয়ম: জবাই করার সময় বিসমিল্লাহ বলতে হবে এবং তাকবীর বলা মোস্তাহাব। যেমন- হযরত জাবের (রাদ্বিআল্লাহু ’আনহু) বলেন: একটি দুম্বা আনা হলো। আল্লাহ’র রাসুল (সল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা জবাই করলেন এবং বললেন ‘বিসমিল্লাহে ওয়া আল্লাহু আকবর। হে আল্লাহ, এটা আমার তরফ থেকে এবং আমার যেসব উম্মত কুরবানী করতে পারেনি – তাদের তরফ থেকে।

    আরেক হাদীছে এসেছে, নবীজী দু’ শিংওয়ালা ভেড়া জবেহ করার সময়ে বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার বললেন। তিনি আরো বললেন: “হে আল্লাহ্, এটি তোমার তরফ থেকে, তোমারই জন্য” বলা যেতে পারে। যার তরফ থেকে কুরবানি করা হচ্ছে – তার নাম উল্লেখ করে দোয়া করাও জায়েজ।

    এ ভাবে বলা: হে আল্লাহ্, তুমি অমুকের তরফ থেকে কবুল করে নাও। মা আয়েশা (রাদ্বিআল্লাহু ’আনহা) বর্ণনা করেন: আল্লাহ’র রাসুল দুম্বা কুরবানি করার সময় বললেন: আল্লাহ’র নামে, হে আল্লাহ, আপনি মুহাম্মাদ, তার পরিবার-পরিজন এবং তার উম্মতের তরফ থেকে কবুল করে নিন। কুরবানিদাতার নিজের পশু নিজে জবাই করা উত্তম। অবশ্য অন্যকে দিয়েও জবাই করানো যায়। নবীজী তেষট্টিটি কুরবানির পশু নিজে জবাই করে বাকিগুলো মওলা আলীকে জবাই করার দায়িত্ব দেন (মুসলিম)। আর হযরত আবু মুসা আশআরী (রাদ্বিআল্লাহু ’আনহু) তাঁর মেয়েদের নিজ হাতে নিজেদের কুরবানির পশু জবাই করতে নির্দেশ দিয়েছেন (ফতহুল বারী)।

    কুরবানীর পশুর সঙ্গে ভালো আচরণঃ জবাই করার সময়ে পশুটির সঙ্গে ভালো আচরণ করতে হবে এবং খেয়াল রাখতে হবে, সে যেনো কষ্ট না পায়। নবীজী ফরমান: আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সকল বিষয়ে সবার সঙ্গে সুন্দর ও কল্যাণকর আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

    সুতরাং তোমরা যখন হত্যা করবে,তখন সুন্দরভাবে করবে এবং যখন জবাই করবে, তখনও তা সুন্দরভাবে করবে। তোমাদের কেউ যেনো ছুরি ধার করে নেয় এবং যাকে জবাই করা হবে,তাকে যেনো প্রশান্তি দেয় (মুসলিম)।

    আর উটকে নহর করতে হবে।নহর হচ্ছে, উটটি তিন পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবে এবং সামনের বাম পাটি বাঁধা থাকবে। ওর বুকে ছুরি চালানো হবে। আল্লাহুতা’লা ফরমান: সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো অবস্থায় ওদের উপরে তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর (মুসলিম)।

    ইবনে আব্বাস (রাদ্বিআল্লাহু ’আনহু) বলেন: এর মানে হলো, তিন পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবে এবং সামনের বাম পা বাঁধা থাকবে (ইবনে কাসির)। উট ছাড়া অন্যান্য জন্তু বাম কাতে শোয়ায়ে ডান হাত দিয়ে গলায় ছুরি চালাতে হবে। বাম হাতে জন্তুটির মাথা ধরে রাখতে হবে। মোস্তাহাব হচ্ছে, জবাইকারী তার পা জন্তুটির ঘাড়ে রাখবে।

    কুরবানীর গোশত কারা খেতে পারবেনআল্লাহুতা’লা ফরমান: অত:পর তোমরা তা থেকে খাও এবং দু:স্থ ও অভাবীকে খাওয়াও (সূরা হজ্ব:২৮)। নবীজী ফরমান: তোমরা নিজেরা খাও, অন্যকে খাওয়াও এবং সংরক্ষণ করো (বোখারি। ‘খাওয়াও’ শব্দটি দিয়ে অভাবীদের দান করা এবং ধনীদের উপহার হিসেবে দেয়াকে বোঝায়। কতোটা নিজেরা খাবে, কতোটা দান করবে এবং কতোটা উপহার হিসেবে দেবে – এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদীছে কিছু বলা হয়নি।

    তবে, উলামায়ে কেরাম বলেছেন: কুরবানির গোশত তিন ভাগ করে একভাগ নিজেদের খাওয়ার জন্যে রাখা, এক ভাগ গরীবদের দান করা এবং এক ভাগ উপহার হিসেবে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের দেয়া মোস্তাহাব। এ গোশত যতোদিন ইচ্ছা সংরক্ষণ করে খাওয়া যাবে। কুরবানির পশুর গোশত, চর্বি ইত্যাদি বিক্রি করা না-জায়েজ। নিজের কাজ নিজেরা করে নিলে ভালো। অন্যের মাধ্যমেও কুরবানির কাজ সমাধা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কসাই বা অন্য কাউকে পারিশ্রমিক হিসেবে কুরবানির গোশত, চামড়া ইত্যাদি দেয়া জায়েজ নয়। পারিশ্রমিক হিসেবে টাকা দিতে হবে। হাদীছে এসেছে, তা প্রস্তুতকরণে তা থেকে কিছু দেয়া হবে না (মুসলিম)। তবে, দান বা উপহার হিসেবে কসাইকে কিছু দেয়া যাবে।

    কুরবানীর পশুর গোশত বিক্রি করা যাবে না: হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (রাদ্বিআল্লাহু ’আনহু) বলেন, নবীজী আমায় তাঁর (কুরবানির উটের) আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করতে বলেছিলেন। তিনি কুরবানির পশুর গোশত, চামড়া ও আচ্ছাদনের কাপড় ছদকা করতে আদেশ করেন এবং এর কোনো অংশ কসাইকে দিতে নিষেধ করেন। তিনি বললেন: আমরা তাকে (তার পারিশ্রমিক) নিজের পক্ষ থেকে দেবো (বুখারী ও মুসলিম)।

    ঈদের নামাজের আগে কুরবানী না করা: কোনো কোনো সাহাবী ভুলে ঈদের নামাযের আগে কুরবানি করলে, নবীজী তাদের পুনরায় কুরবানি করতে আদেশ দেন (বুখারী ও মুসলিম)।

    মৃত ব্যক্তির তরফে কুরবানী : মৃত ব্যক্তিদের তরফে কুরবানি করা সওয়াবের কাজ। কুরবানি এক রকম সদকাও বটে। তাই, মৃত ব্যক্তির নামে যেমনি সদকা করা যায় – তেমনি কুরবানিও দেয়া যায়। মা আয়েশা (রাদ্বিআল্লাহু ’আনহা) বর্ণনা করেন: কেউ আল্লাহ’র রাসুলের (সল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে এসে জিজ্ঞেস করল: হে আল্লাহ’র রাসূল! আমার মা হঠাৎ ইন্তেকাল করেছেন। কোনো অসিয়ত করে যেতে পারেননি। মনে হচ্ছে, তিনি কোনো কথা বলতে পারলে, অসিয়ত করে যেতেন। এখন আমি তার তরফ থেকে সদকা করলে, তিনি কি এর সওয়াব পাবেন? তিনি উত্তর দিলেন: হাঁ (মুসলিম)। তেমনি এক বা একাধিক মৃত ব্যক্তির জন্য সওয়াব পাঠানোর উদ্দেশে কুরবানি দেয়া জায়েজ। আর কোনো কারণে মৃত ব্যক্তির জন্যে কুরবানি ওয়াজিব হয়ে থাকলে, তার জন্যে পূরো একটি কুরবানি করতে হবে।

    অনেক সময় দেখা যায়, অনেকে নিজেকে বাদ দিয়ে মৃত ব্যক্তির জন্যে কুরবানি করেন। এটা মোটেই ঠিক নয়। ভাল কাজ নিজেকে দিয়ে শুরু করতে হয়। এরপর অন্যান্য জীবিত ও মৃত ব্যক্তির জন্যে তা করা যেতে পারে। মা আয়েশা ও আবু হুরাইরা (রাদ্বিআল্লাহু ’আনহুমা) বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ’র রাসুল (সল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরবানির নিয়তে দু’টি দুম্বা কিনলেন – যা ছিলো বড়, হৃষ্টপুষ্ট, শিংওয়ালা, সাদা-কালো বর্ণের ও খাসি। একটি তিনি তাঁর সেসব উম্মতের জন্যে কুরবানি করলেন – যারা আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর রাসুলের রিসালাতের সাক্ষ্য দিয়েছে। অন্যটি তাঁর নিজের ও পরিবারবর্গের জন্যে কুরবানি করলেন (ইবনে মাজা)। মৃত ব্যক্তি তার সম্পদ থেকে কুরবানি করার অসিয়ত করে গেলে, তার জন্যে কুরবানি করা ওয়াজিব হয়ে যাবে।

    অংশীদারী কুরবানী: একে ‘ভাগে কুরবানি দেয়া’ বলা হয়। এর দু’টি পদ্ধতি হতে পারে:

    (এক) সওয়াবের ক্ষেত্রে অংশীদার হওয়া। যেমন-কয়েকজনে মিলে একটি বকরি কিনে একজনকে এর মালিক বানিয়ে দিল। এখন সে বকরিটি কুরবানী করলে, ক্রেতারাও সওয়াব পাবে।

    (দু) মালিকানার অংশীদারীর ভিত্তিতে কুরবানি। যেমন- দু’ বা ততোধিক ব্যক্তি একটি বকরি কিনে সবাই মালিক হয়ে কুরবানি করা। এভাবে কুরবানি শুদ্ধ হবে না। তবে, উট, গরু ও মহিষের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি জায়েজ। কুরবানী আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য লাভের উপায়। তাই, শরীয়তসম্মত সময়, সংখ্যা ও পদ্ধতি অনুসারেই তা আদায় করতে হবে। আল্লাহ ও তার প্রিয় রাসুল অধিক জ্ঞাত।

    লেখক,কলামিষ্ট,কবি,সাহিত্যিক ও সাংবাদিক-আনিছুল ইসলাম আশরাফী,প্রধান সম্পাদক “আমার সিলেট টুয়েন্টি ফোর ডটকম”