উগ্রপন্থী আরেকটি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ সক্রিয়

    0
    883

    জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের চেয়েও উগ্রপন্থী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ নামের আরেকটি গোষ্ঠী আল-কায়েদার মতাদর্শ অনুসরণ করে সক্রিয় হয়েছে।
    ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পাঁচ ছাত্র এই গোষ্ঠীর অনুসারী। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তাঁদের দেওয়া তথ্য থেকেই কট্টরপন্থী এই গোষ্ঠীর বিষয়ে জানতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
    আল-কায়েদা নেটওয়ার্কের অন্যতম ওয়েবসাইট ‘আনসার আল মুজাহিদীন ইংলিশ ফোরাম এএমইএফ’-এ বাংলাদেশে রাজীব হত্যায় গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচ ছাত্রকে ‘উম্মার সিংহ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ২ মার্চ সকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই পাঁচজনের গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশিত হয়। ওই দিনই বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ৩৬ মিনিটে ‘ফাইভ লায়ন অব উম্মা’ শিরোনামে খবরটি এএমইএফের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। তাতে এই পাঁচজনের প্রশংসা করা হয়।
    আনসারুল্লাহ বাংলা টিমও রাজীব হত্যার পর তাঁর লাশ, জানাজা, ব্লগে তাঁর কথিত লেখা—এসব তুলে ধরে এ ধরনের হত্যার পক্ষে উসকানিমূলক ভিডিও তৈরি করে নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রচার করে। এই ওয়েবসাইটে এর আগে থেকেই এ ধরনের হত্যার পক্ষে প্রচারণা চালানো হয়। এই ভিডিওতে ব্লগ, ফেসবুকে যারা কটাক্ষ করছে বলে তারা মনে করছে, তাদের শনাক্ত করে পেশা, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা ইত্যাদি জোগাড় করে অনলাইন তথ্যভান্ডার তৈরি করার জন্য ‘বাংলাদেশি মুজাহিদীন’দের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এর উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়, ‘যাতে পরবর্তীকালে যেকোনো মুজাহিদীন তাদের খতম করে দিতে পারে’।
    জানা গেছে, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে বাংলাদেশে সক্রিয় এই গোষ্ঠীর ওয়েবসাইট ও একাধিক ব্লগে আল-কায়েদার মতাদর্শ নিয়ে প্রচার, উদ্বুদ্ধকরণমূলক লেখা, অডিও-ভিডিও বক্তৃতা, আলোচনা, পরামর্শ, প্রশ্নোত্তর ইত্যাদির চর্চা করা হয়। বিদেশি জঙ্গিনেতাদের লেখা, বক্তৃতা-বিবৃতি বাংলায় অনুবাদ করে এই সাইটে প্রচার করা হয়।
    আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামটিও ইরাকি আল-কায়েদার আনসার উল ইসলাম-এর অনুকরণে নেওয়া। বাংলাদেশি এই গোষ্ঠী আধ্যাত্মিক নেতা মানেন ইয়েমেনভিত্তিক আল-কায়েদার নেতা আনওয়ার আওলাকিকে। আল-কায়েদা ইন অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা নামে সক্রিয় এই গোষ্ঠীর প্রধান আওলাকি ২০১১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মার্কিন ড্রোন হামলায় ইয়েমেনে নিহত হন।
     গ্রেপ্তার এই তরুণদের বক্তব্যে এই গোষ্ঠীর বাংলাদেশে সক্রিয়তার বিষয়টি প্রকাশ পেলেও দেশের নামকরা একাধিক সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক এই গোষ্ঠীর যাত্রা ২০০৮ সালে। তখন রাজধানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক ক্যাম্পাসের কাছাকাছি বনানীর একটি মসজিদকে ঘিরে আল-কায়েদার মতাদর্শে বিশ্বাসী এ গোষ্ঠীর কার্যক্রম শুরু হয়। প্রধানত ইংরেজি মাধ্যম বা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে তাদের মতাদর্শ প্রচার ও উদ্বুদ্ধকরণ চলত। পরবর্তী সময়ে ফেসবুক, ব্লগসহ তথ্যপ্রযুক্তিকেন্দ্রিক কার্যক্রম শুরু করা হয়। শুরুতে এ দল বা গোষ্ঠীর নির্দিষ্ট কোনো নাম ছিল না। এর সদস্যরা ঘনিষ্ঠজনদের কাছে নিজেদের আল-কায়েদাপন্থী বলে পরিচয় দিতেন বলে নর্থ সাউথের শিক্ষার্থীদের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। কিন্তু একই সময়ে হিযবুত তাহ্রীরের ব্যাপক কার্যক্রম থাকায় নতুন এ গোষ্ঠীর তৎপরতা আলাদাভাবে নজরে পড়েনি।
    জানা যায়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে বাব-উল ইসলাম নামের একটি ওয়েবসাইটে ফোরাম আলোচনায় যুক্ত হয়, যা ওই ওয়েবসাইটে ঘোষণাও দেওয়া হয়। বাব-উল ইসলাম ওয়েবসাইটটির যাত্রাও ওই বছরের ৯ মার্চ। এটি পাকিস্তান থেকে পরিচালিত হয়। এতে আরবি, উর্দুর পাশাপাশি বাংলায়ও জিহাদি আলোচনা, পরামর্শ ও প্রচারণা চালানো হচ্ছে। ২০১১ সালের মাঝামাঝি থেকে এর বাংলাদেশি অনুসারীরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নাম ধারণ করে ব্লগে তৎপরতা শুরু করে।
    একই রকম কয়েকটি ওয়েবসাইট ও ব্লগ বাংলাদেশি উগ্রপন্থীরা ব্যবহার করছে। এসব ব্লগ ও ওয়েবসাইটে তাদের মতে যারা ধর্মের অবমাননাকারী, তাদের হত্যা করার ‘ফতোয়া’ প্রচার করা হচ্ছে।
    সংশ্লিষ্ট একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, জিজ্ঞাসাবাদ করে এই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এ দেশে তাঁদের মূল নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক কাঠামো বা জনবল সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য এখনো মেলেনি। তবে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিকেন্দ্রিক কয়েকজন নেতার ব্যাপারে তথ্য পাওয়া গেছে।
    রিমান্ডে এই পাঁচজনের দেওয়া তথ্য, তাঁদের একাধিক সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠজনের পর্যবেক্ষণ, সংশ্লিষ্ট ব্লগ ও ওয়েবক্ষেত্রগুলো পর্যালোচনা করে জানা যায়, আল-কায়েদার মতাদর্শে বিশ্বাসী আনসারুল্লাহ বাংলা টিম একই যোগসূত্রে থেকে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তৎপরতা চালায়। সপ্তাহ ও মাসের নির্দিষ্ট দিনে ‘পাঠচক্রে’ অংশ নেওয়া ছাড়াও ইন্টারনেটে নির্দিষ্ট কিছু ওয়েবসাইটে নিজেদের মধ্যে আলোচনা, পরামর্শ ও গোপন তৎপরতা চালিয়ে থাকে।
    ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, রিমান্ডে ওই পাঁচজন দাবি করেছেন, তাঁদের দলের কোনো নাম নেই। সাংগঠনিক কাঠামো সম্পর্কে তাঁদের ‘বড় ভাইয়েরা’ বলতে পারবেন। এমন কয়েকজন ‘বড় ভাইয়ের’ নামও বলেছেন তাঁরা। তিনি বলেন, ‘তবে তাঁরা আল-কায়েদার মতাদর্শ অনুসরণ করেন বলে অকপটে জানিয়েছেন। ’
    ডিবির একটি সূত্র জানায়, রিমান্ডে পাঁচ শিক্ষার্থী বলেছেন, তাঁদের এই গোষ্ঠীর অধীনে প্রতিটি ছোট ছোট দলে ৮ থেকে ১০ জন করে সদস্য আছেন। তবে, এ রকম মোট কতটি দল আছে, তা তাঁরা জানেন না বলে দাবি করেন।
    বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদ নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন এমন একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, সাংগঠনিক এ পদ্ধতিকে ‘কাট-আউট’ পদ্ধতি বলে। আল-কায়েদা এ পদ্ধতি অনুসরণ করে। এর ফলে একটি দলের কেউ ধরা পড়লে তার দলটি শুধু শনাক্ত হয়। বাকিরা আড়ালে থেকে যায়। পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন লস্কর-ই তাইয়েবাও এই পদ্ধতিতে কর্মকাণ্ড চালায়। বাংলাদেশে নিষিদ্ধঘোষিত জেএমবিও এই পদ্ধতি অনুসরণ করত।
    এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নতুন এ গোষ্ঠীর সহিংসতার দুটি ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে। প্রথম ঘটনাটি ঘটে গত ১৪ জানুয়ারি। ওই দিন রাজধানীর উত্তরায় আসিফ মহিউদ্দীনকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। আসিফ প্রাণে বেঁচে যান। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি একই কায়দায় আক্রমণ করে হত্যা করা হয় রাজীব হায়দারকে। এ ঘটনায় ১ মার্চ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পাঁচজন ছাত্র ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপ (২২), মাকসুদুল হাসান ওরফে অনিক (২৩), এহসান রেজা ওরফে রুম্মন (২৩), নাঈম সিকদার ওরফে ইরাদ (১৯) ও নাফিস ইমতিয়াজকে (২২) গ্রেপ্তার করে ডিবি। এই হত্যার দায় স্বীকার করে গত রোববার এই পাঁচজন আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন।
    ডিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জিজ্ঞাসাবাদে এই শিক্ষার্থীরা বলেছেন, আসিফকেও তাঁদের অপর একটি দল হত্যার চেষ্টা করেছিল। তবে ওই দলের সদস্যদের কেবল তাঁদের ‘বড় ভাইয়েরা’ চেনেন।
    সর্বশেষ ৭ মার্চ রাতে পল্লবীতে সানিউর রহমানের ওপর একই কায়দায় হামলা করা হয়। এটাও একই গোষ্ঠীর কাজ বলে পুলিশের সন্দেহ।
    ২০১০ সালে ইয়েমেনে আল-কায়েদাবিরোধী অভিযানে কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিক গ্রেপ্তার হন। তাঁদের মধ্যে অন্তত তিনজন ছিলেন, যাঁদের বিরুদ্ধে এ দেশেও জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। তাঁরা হলেন তেহজীব করিম, মাইনুদ্দীন শরীফ ও রেজওয়ান শরীফ। তাঁদের এ দেশে ফেরত পাঠানোর পর দেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহায়তায় প্রভাবশালী একটি পশ্চিমা দেশের গোয়েন্দারাও এসে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।
    তেহজীব করিমের ভাই রাজীব করিম ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রগামী ব্রিটিশ এয়ারের বিমান উড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১০ সালে ফেব্রুয়ারিতে গ্রেপ্তার হন এবং পরে ওই দেশের আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন। রাজীব করিম বাংলাদেশে জেএমবির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আল-কায়েদার নেতা আনোয়ার আল-আওলাকির সরাসরি যোগাযোগ ছিল বলে রাজীব করিম যুক্তরাজ্যের আদালতে স্বীকারও করেছেন, যা ২০১১ সালের বিভিন্ন সময় ওই দেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।
    ইয়েমেন-ফেরত এই তিনজনকে রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষার্থীরা চেনেন—পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা বলেছেন বলে জানান ডিবির একজন কর্মকর্তা। ঢাকায় তাঁরা যে আধ্যাত্মিক নেতার কাছে যেতেন, সেখানে ওই তিনজনও যেতেন বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
    রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষার্থীরা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এবং আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তাঁদের নেতা হিসেবে কয়েকজন ‘বড় ভাইয়ের’ নাম বলেছেন।
    এই ‘বড় ভাইদের’ অন্তত একজন এই ইয়েমেনকেন্দ্রিক আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত বলে তথ্য পাওয়া গেছে। ইয়েমেনভিত্তিক আল-কায়েদার সঙ্গে এ দেশের একটি জঙ্গিগোষ্ঠীর যোগাযোগের তথ্য নিয়ে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম আলোতে যে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল, তাতে এই নেতার তৎপরতা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ছিল।
    মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার বলেন, ‘জেএমবি বিপর্যস্ত হওয়ার মনে করছিলাম, ধর্মভিত্তিক উগ্রপন্থীদের পরবর্তী সবচেয়ে হুমকি হয়ে উঠবে হিযবুত তাহ্রীর। কিন্তু রাজীব হত্যার পর গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, দেশে এর চেয়েও কট্টর ও উগ্রপন্থী গোষ্ঠী রয়েছে, যারা আল-কায়েদার মতাদর্শকে ধারণ করে। দেশে ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার একজন “শায়খ”কে আধ্যাত্মিক নেতা মানে তারা।’