আশুরার শিক্ষাঃআহলে বায়াতের ভালোবাসাই প্রিয় নবীর প্রতি ভালোবাসা

0
1583
আশুরার শিক্ষাঃআহলে বায়াতের ভালোবাসাই প্রিয় নবীর প্রতি ভালোবাসা

নূর মোহাম্মদ সাগর (মৌলভীবাজার) শ্রীমঙ্গলঃ কারবালা’ ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রান্তর, ইসলামিক পঞ্জিকা হিসেবে ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ ১০ অক্টোবর ৬১ হিজরী মোতাবেক বর্তমান ইরাকের কারবালা নামক প্রান্তরে সংগঠিত হয়েছিল, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর ওফাতের ৫০ বছর পর আরবী বর্ষপরিক্রমার প্রথম মাস পবিত্র মহররম, মহররম মাসের ১০ তারিখ শুক্রবারে নবী দৌহিত্র হজরত হুসাইন (রা.) অত্যন্ত করুণভাবে শাহাদত বরণ করেছিলেন তারই নানা যিনি ইসলাম ধর্ম প্রচার করে লাখো লাখো মানুষকে ধর্মের দিকে আহ্বান করেছিলেন আর সেই ধর্মের আল কেল্লা পড়েই একদল ছদ্মবেশী লোভী পথভ্রষ্টরা তৈরি করেছিলো মানব ইতিহাসে এক হৃদয়বিদারক ঘটনার সূত্রপাত।

কারবালার ঘটনা মানবতার ইতিহাসে এটি অত্যন্ত বিয়োগান্ত ঘটনা। কারবালা যেন আরবি ‘কারব’ ও ‘বালা’–এর সরল রূপ। ‘কারব’ মানে সংকট, ‘বালা’ মানে মুসিবত। তাই কারবালা সংকট ও মুসিবতের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

কারবালার এই হৃদয়বিদারক ঘটনা মহিমাময় মহররম মাসের ঐতিহাসিক মহান আশুরার দিনে সংঘটিত হওয়ায় এতে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। এতে এই শাহাদতের মাহাত্ম্য যেমন বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি আশুরা ইতিহাসে নতুন পরিচিতি পেয়েছে। আজ আশুরা ও কারবালা বা কারবালা ও আশুরা সমার্থক; একে অন্যের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘ফোরাত’ কুফার একটি সুপ্রাচীন নদী, এই নদীর কূলে অবস্থিত কারবালার প্রান্তর। হুসাইনি কাফেলা যখন কারবালায় অবস্থান করছে, তখন তাদের পানির একমাত্র উৎস এই ফোরাত নদী কুফার শাসক উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের বাহিনী ঘিরে রাখে, অবরুদ্ধ করে রাখে নিরস্ত্র অসহায় আহলে বাইতের সদস্যদের। এই নদী থেকে পানি সংগ্রহ করতে গেলে ফুলের মতো নিষ্পাপ দুগ্ধপোষ্য শিশু আলী আসগর সিমারের বাহিনীর তিরের আঘাতে শহীদ হয়।

হিজরি সালের ইতিহাস মহানবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের দিন থেকে হিজরি বছর গণনা করা হয়। পৃথিবীর সব মুসলিম দেশ অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে বরণ করে এ মহরমকে। এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ মাস। ইসলামের ইতিহাসে এ মাসে স্মরণীয় নানা ঘটনা রয়েছে। এ মাসে শোহাদায়ে কারবালাসহ কিছু মহিমান্বিত রজনী রয়েছে। এ মাসের ইবাদতের তাৎপর্যও অনেক বেশি। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা আরবি সালের প্রথম মাস মহরমকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে।

আল্লামা ইকবাল বলেছেন ১০ মহররম কারবালার ময়দানে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র তৌহিদী নকশা এঁকেছেন। সে নকশা আঁকার জন্য হযরত হুসাইন (রা.) কাছে কাগজ, কলম, কালি কিছুই ছিল না। কারবালার জমিনকে  বানিয়েছে কাগজ, হাত কে বানিয়েছে কলম, বুকের তাজা রক্ত কে বানিয়েছে কালি।এমন এক নকশা অঙ্কন করেছেন যা সত্য ও ন্যায়ের অনুসারীদের দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা, আর অনাগত মুসলমানদের মনজিলে মাকসুদে পৌঁছার আলোকবর্তিকা।

ইতিহাস সুত্রে জানা যায়, সৈয়্যদুশ শোহাদা হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) চতুর্থ হিজরীর শাবান মাসের ৫ তারিখ পবিত্র মদীনা শরীফে জন্ম গ্রহন করেন। জন্মের পর আল্লাহর প্রিয় হাবিব হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাঁর কানে আযান দিয়ে দোয়া করেছিলেন। সাত দিন পর আকীকা করে ‘হুসাইন’ নাম রাখা হয়েছিল। হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে, হাসান ও হুসাইন জান্নাতী নাম সমূহের মধ্যকার দুটি নাম। এর আগে আরবের জাহিলিয়াত যুগে এ দু’নামের প্রচলন ছিল না। হযরত হাসান ও হুসাইন (রাঃ) কে মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর খুবই প্রিয় পাত্র ছিলেন। তাঁদের ফযীলত সম্পর্কে অনেক হাদীছ বর্ণিত আছে। মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,নিশ্চয়ই হাসান-হুসাইন দুনিয়াতে আমার দুটি ফুল। আপন সন্তান থেকেও তাঁদেরকে আল্লাহর রাসূল (দরুদ) অধিক ভালবাসতেন।

হযরত আল্লামা জামী (রহ) বর্ণনা করেন, একদিন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম,হযরত ইমাম হোসাইন (রাঃ) কে ডানে ও স্বীয় সাহেবজাদা হযরত ইব্রাহিম (রাঃ) কে বামে বসিয়েছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত জিব্রাইল (আ:) উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন- ইয়া রাসুলাল্লাহ! সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আল্লাহ এ দু’জনকে আপনার কাছে এক সঙ্গে রাখতে দেবেন না। ওনাদের মধ্যে একজনকে ফিরিয়ে নিবেন। অতএব আপনি এ দু’জনের মধ্যে যাকে ইচ্ছে পছন্দ করুন। মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ফরমালেন, যদি হুসাইনকে নিয়ে যায়, তাহলে ওর বিরহে ফাতেমা ও আলীর খুবই কষ্ট হবে এবং আমার মনটাও ক্ষুন্ন হবে আর যদি ইব্রাহিমের ওফাত হয়, তাহলে সবচে বেশী দুঃখ একমাত্র আমিই পাব। এজন্য নিজে দুঃখ পাওয়াটাই আমি পছন্দ করি। এ ঘটনার তিন দিন পর হযরত ইব্রাহিম (রাঃ)ইন্তেকাল করেন। এরপর থেকে যখনই হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর সমীপে আসতেন, হুযুর নাতি হুসাইনকে মুবারকবাদ দিতেন, এবং হুসাইন (রাঃ) কপালে চুমু দিতেন এবং উপস্থিত লোককদেরকে করে বলতেন- আমি হুসাইনের জন্য আপন সন্তান ইব্রাহিমকে কুরবানী দিয়েছি। (শওয়াহেদুন নবুয়াত)।

প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যই ইমান। আল্লাহর আসমানী কিতাব কোরআন কারিমে বলেন, (হে নবী সা.) আপনি বলুন, ”তোমরা যদি আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও, তবে আমাকে অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন, তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন”’ (সুরা-৩ আল ইমরান, আয়াত: ৩১)।এইজন্য তো কাজী নজরুল ইসলাম কবিতায় বলেন- আল্লাহ কে যে পাইতে চায় হযরত কে ভালবেসে

আরশ কুর্সী লওহ কালাম না চাইতেই পেয়েছে সে।

রসুল নামের রশি ধ’রে

যেতে হবে খোদার ঘরে,

নদী তরঙ্গে যে পড়েছে, ভাই

দরিয়াতে সে আপনি মেশে।

তর্ক করে দুঃখ ছাড়া কী পেয়েছিস অবিশ্বাসী,

কী পাওয়া যায় দেখনা বারেক হযরতেমোর ভালবাসি?

এই দুনিয়ায় দিবা- রাতি

ঈদ হবে তোর নিত্য সাথী;

তুই যা চাস তাই পাবি হেথায়, আহমদ চান যদি হেসে।

হজরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা,মাতা তার সন্তান ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় না হব’ (বুখারি শরিফ, প্রথম খ-, পরিচ্ছেদ: ৮, হাদিস: ১৩-১৪, পৃষ্ঠা: ১৯, ই. ফা.)। নবীজি ( সা.) এর ভালোবাসার পূর্ণতা হলো আহলে বাইতের ভালোবাসায়। আল্লাহ কোরআন কারিমে উল্লেখ করেছেন, ‘ (হে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আপনি বলুন, “আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই না, চাই শুধু আমার স্বজনদের (আহলে বাইতদের) প্রতি ভালোবাসা”’ (সুরা-শুরা, আয়াত:২৩)।

আহলে বাইত হলো নবী পরিবার—মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম, হজরত ফাতিমা (রা.), হজরত আলী (রা.), হজরত হাসান (রা.) ও হজরত হুসাইন (রা.) এই পরিবারের সদস্যগণ। এদের মাধ্যমেই সংরক্ষিত হয়েছে নবী বংশ। নবীবংশেরই ৭০ জন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য শাহাদত বরণ করেছেন আশুরার দিনে, ইরাকের কুফা নগরীর কারবালার প্রান্তরে ফোরাত নদীর তীরে।

রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমি জ্ঞানের নগর, আলী তার সদর দরজা’ (তিরমিজি)। ‘আমি যার বন্ধু আলীও তার বন্ধু’ (তিরমিজি: ৩৭১৩, ইবনে মাজাহ: ১২১)

হযরত আবু হুরাইরা (রাদি আল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে বর্ণিত, রসূলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম একদিন এমন অবস্থায় বাহিরে আসলেন যে, তাঁর এক কাঁধের উপর হযরত হাসান এবং অন্য কাঁধের উপর হযরত হুসাইন (রা) কে বসিয়ে ছিলেন। এ ভাবেই আমাদের সামনে আনলেন এবং বললেন- যে এ দুজনকে মহব্বত করলো সে আমাকে মহব্বত করলো আর যে এদের সাথে দুশমনী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম, সে আমার সাথে দুশমি করলাে।

হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর জন্মের সাথে সাথে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর বদৌলতে তাঁর

শাহাদাতের কথা সবার জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। হযরত আলী, হযরত ফাতেমাতুয যোহরা, অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম ও আহলে বায়তের সংশ্লিষ্ট সবাই হুসাইন (রাঃ) এর শৈশব অবস্থায় জানতে পেরেছিলেন যে, এ ছেলেকে একান্ত নির্মমভাবে শহীদ করা হবে এবং কারবালা ময়দান তার রক্তে রঞ্জিত হবে। তাঁর (রাঃ) শাহাদাতের ভবিষ্যত বানী সম্বলিত অনেক হাদীছ বর্ণিত আছে। হযরত উম্মুল ফজল বিনতে হারেছ (রাঃ) হযরত আব্বাস (রাঃ) এর স্ত্রী) বলেন, আমি একদিন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে ইমাম হুসাইন (রাঃ) কে তার কোলে দিলাম। এরপর আমি দেখলাম, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম এর চোখ মুবারক থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ব্যাপার কি ? তিনি ফরমালেন, আমার কাছে জিব্রাইল (আ) এসে খবর দিয়ে গেল (আমার উম্মত আমার এ শিশুকে শহীদ করবে।) হযরত উমুল ফজল বলেন, আমি আশ্চর্য হয়ে আরয করলাম, “ইয়া রাসুলল্লাহ, এ শিশুকে শহীদ করবে! হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ফরমালেন, হা! জিব্রাইল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ওর শাহাদত স্থলের লাল মাটিও এনেছেন।

হযরত আমীরে মুয়াবিয়া (রাঃ) এর ইন্তেকালের পর ইয়াজিদ সিংহাসনে আরোহণ করার সাথে সাথেই তার মনের মধ্যে সীমাহীন অহংকার ও গর্ববােধের সৃষ্টি হল। যার ফলে সে এমন কাজকর্ম শুরু করলো, যা পবিত্র শরীয়তের সম্পূর্ণ বিপরীত।

যেমন – ফেরাউন প্রথমে গরীব লোক ছিল,কিন্তু ভাগ্যক্রমে বাদশা হয়ে সিংহাসনে আরোহণ করার সাথে সাথে এমন অহংকারী হয়ে বসলো যে, শেষ পর্যন্ত নিজেকে খোদা বলে ঘোষণা এবং বলতে লাগলেন- আমি তােমাদের সবচেয়ে বড় খােদা; আমার পূজা, আরাধনা কর; সে-ই রক্ষা পাবে, যে আমার পূজা করবে; আর যে আমার পূজা করতে অস্বীকার করবে, তাকে আমি খতম করবাে। একমাত্র এ কারণেই সে অনেক লােকের গর্দান দ্বিখন্ডিত করেছিল। ইয়াজিদও যখন সিংহাসনে বসলাে, তখন সে বাবার বর্তমানে যে সব গর্হিত কাজ কর্ম গােপনে করতাে, সে সব এখন প্রকাশ্যে করতে লাগলাে। যেহেতু এখন তাকে নিষেধ করা বা বাঁধা দেয়ার কেউ নেই সেহেতু সে মদ্য পান, জেনা এবং অন্যান্য কু-কর্ম তার নিত্য দিনের অভ্যাসে পরিণত হল। সে মনে মনে ভাবলাে ‘আমার যে চাল-চলন এবং স্বভাব-চরিত্র, তা কেউ সহজে মেনে নিবে না। তারা তার এ রাজত্ব মেনে নিবেন না; তারা তার হাতে বায়াত করবেন না; তাঁদের অস্বীকৃতির কারণে অন্যদের মধ্যেও অস্বীকৃতির প্রভাব বিস্তৃত হবে। এজন্য এটাই সমীচীন হবে যে, আমি তাদের বায়াত তলব করবাে। যদি তারা অস্বীকার করেন, তখন তাদেরকে কতল করাবাে, যাতে আমার রাস্তার এ সব বড় বড় প্রতিবন্ধকতা অপসারিত হয় এবং আমার খেলাফতের রাস্তা যেন মুক্ত হয়ে যায়। তাই সে ক্ষমতায় আরােহণ করার পর পরই হযরত ইমাম হুসাইন (রা.), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রাঃ) হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (রা.) প্রমূখ থেকে বায়াত তলব করলাে। এ সব ব্যক্তিগণ বিশেষ সম্মানিত ছিলেন এবং বিশেষ গণ্যমান্যদের বংশধর ছিলেন। তাই তাঁরা কিভাবে ফাসিক-ফাজির ইয়াজিদের হাতে বায়াত করতে পারেন? সুতরাং তারা অস্বীকার করলেন এবং এটা তাঁদের মর্যাদাগত আচরণই ছিল। অস্বীকার করার পর হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (রা.) ও হযরত আবদুল্লাহ বিন জুবাইর (রা.) মদীনা শরীফ থেকে মক্কা শরীফ চলে গেলেন। হযরত হুসাইন (রা.) মদীনার গভর্ণর ওয়ালিদের আহবানে তার দরবারে তশরীফ নিয়ে গেলেন, তার সঙ্গে আলােচনা করলেন। মদীনার গভর্ণর বললাে, ইয়াজিদ আপনার বায়াত তলব করেছেন। তিনি বললেন, ‘আমি ইয়াজিদের হাতে বায়াত করতে পারিনা। ইয়াজিদ হলাে ফাসিক-ফাজির। এ ধরণের অনুপযুক্ত লােকের হাতে আমি বায়াত করতে পারিনা। আমি কোন অবস্থাতেই ওর হাতে বায়াত করতে রাজি নই।’ তিনি সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করলেন। এটা ছিল তাঁর মর্যাদাগত আচরণ। দেখুন, তিনি যদি বায়াত করতেন, তাহলে নিজের প্রাণ বাঁচতে, পরিবার-পরিজন বাঁচতে, এমনও হয়তাে হত যে, অগাধ সম্পত্তির মালিকও তিনি হয়ে যেতেন। কিন্তু ইসলামের আইন-কানুন ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত এবং কিয়ামত পর্যন্ত ফাসিক-ফাজিরের আনুগত্য বৈধ হয়ে যেত এবং তাদের কাছে।

ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর আনুগত্য প্রধান দলিল হিসাবে পরিণত হত। লােকেরা বলতাে, ইমাম হুসাইন (রাঃ) যখন ফাসিক-ফাজিরের আনুগত্য স্বীকার করেছেন, তাহলে নিশ্চয় এটা জায়েয। কিন্তু ইমাম হুসাইন (রাঃ) অস্বীকারের মাধ্যমে দুনিয়াবাসীর সামনে প্রমাণ করে দিলেন, হুসাইন (রাঃ) শত দুঃখ-কষ্ট ভােগ করতে পারেন, অনেক বিপদ-আপদের মােকাবেলা করতে পারেন, এমন কি আপন পরিজনের শহীদ হওয়াটা অবলােকন করতে পারেন; নিজেও বর্বরােচিত ভাবে শাহাদাত বরণ করতে পারেন, কিন্তু ইসলামের নেজাম ছত্রভঙ্গ হওয়া কিছুতেই সহ্য

করতে পারেন না, নিজের নানাজান (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) এর ধর্ম ধ্বংস হওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। ইমাম হুসাইন (রাঃ) নিজের কাজ ও কর্মপন্থা দ্বারা তা প্রমাণিত করেছেন এবং দুনিয়াবাসীকে এটা দেখিয়ে দিয়েছেন, খােদার বান্দার এটাই শান যে, বাতিলের সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে যান এবং তীর তলােয়ারের সামনে বুক পেতে দেন, কিন্তু কখনও বাতিলের সামনে মাথা নত করেন না।

ইমাম হুসাইন (রাঃ) নিজের আমল দ্বারা তার উচ্চ মর্যাদার পরিচয় দান করেছেন এবং জনগণের সামনে নিজের পদ মর্যাদা তুলে ধরেছেন। সত্য ও ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত কারবালার প্রান্তরে নির্মম নির্যাতন ও নিপীড়নে পরাজিত প্রতারিত হুসাইনি কাফেলা চিরস্মরণীয় ও বরণীয়। প্রতিটি আশুরা ও শোহাদায়ে কারবালা দিবস আমাদের নতুন পথ ও নতুন জীবনের প্রতি অনুপ্রেরণা যোগায়। জীবনের ব্রত, ত্যাগের শিক্ষা, আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত করে; ভয়কে জয় করে, নিজের জীবন উৎসর্গ করে, রক্তলাল মুক্তির পথ তৈরি করে, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সহজ পথ ও সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ করাই শোহাদায়ে কারবালার মহতী শিক্ষা। এজিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য কুফাবাসী হজরত হুসাইনকে (রা.) পত্রের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানায়। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি সেখানে গেলে তারা তাঁকে একাকী বিপদের মুখে ফেলে রেখে নিজেরা নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকে। কারবালা আজও ঘটে চলেছে দেশে দেশে। দুনিয়ার প্রতিটি নদী আজ ফোরাতের কান্না করছে। কুফা যেন সিন্দাবাদের ভূত হয়ে মানবতার ঘাড়ে চেপে বসেছে। দামেস্ক, তুরস্ক ও মিসরের সে খলনায়কদের প্রেতাত্মারা এখনো আমাদের অজ্ঞানতার তমসায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

সত্য ও ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত কারবালার প্রান্তরে নির্মম নির্যাতন ও নিপীড়নে পরাজিত প্রতারিত হুসাইনি কাফেলা চিরস্মরণীয় ও বরণীয়। প্রতিটি আশুরা ও শোহাদায়ে কারবালা দিবস আমাদের নতুন পথ ও নতুন জীবনের প্রতি অনুপ্রেরণা জোগায়। জীবনের ব্রত, ত্যাগের শিক্ষা, আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত করে; ভয়কে জয় করে, নিজের জীবন উৎসর্গ করে, রক্তলাল মুক্তির পথ তৈরি করে, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সহজ পথ ও সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ করাই শোহাদায়ে কারবালার মহতী শিক্ষা।

শোহাদায়ে কারবালা দিবস মুসলিম বিশ্বের আন্তর্জাতিক শোক দিবস। কারবালার শিক্ষা হলো সর্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য প্রয়োজন নবীপ্রেম, আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা, ধর্মনিষ্ঠা, আত্মত্যাগ, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য পালন, মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করা। ভোগ নয়, ত্যাগেই সুখের সন্ধান করা। যেদিন সমগ্র পৃথিবীতে পরিপূর্ণরূপে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, সত্য ও সুন্দরের জয় হবে, সেদিনই কারবালার প্রায়শ্চিত্ত হবে। সার্থক হবে আহলে বাইতের আত্মদান।