আজ হজ্জ ! সমস্ত প্রশংসা,সম্পদরাজি,আধিপত্য আল্লাহ্‌র,তিনি অংশীদার মুক্ত

0
850
আজ হজ্জ ! সমস্ত প্রশংসা,সম্পদরাজি,আধিপত্য আল্লাহ্‌র,তিনি অংশীদার মুক্ত

‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়াল-মুলক’

“আমি উপস্থিত হে আল্লাহ! আমি উপস্থিত, আপনার ডাকে সাড়া দিতে আমি হাজির। আপনার কোন অংশীদার নেই। নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রশংসা ও সম্পদরাজি আপনার এবং একচ্ছত্র আধিপত্য আপনার। আপনার কোন অংশীদার নেই”

করোনা মৌসুমের পুর্বের ছবি

মিনহাজ তানভীরঃ মুসলিম জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.) ও মা হাওয়ার (আ.) মিলনের স্মৃতিবিজড়িত আরাফাতের ময়দানে ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়াল-মুলক’-এ তালবিয়ায় মুখর ১৫০টি দেশের ৬০ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে আজ পালিত হবে পবিত্র হজ।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আরাফাতই তো হজ্জ’। যে লোক মুযদালিফায় যাপন করা রাত্রির ফজরের নামাযের পূর্বে আরাফাতের ময়দানে এসে পৌঁছবে তার হজ পূর্ণ হয়ে যাবে। ইমাম তিরমিজী (রহ.) ‘আরাফাতই তো হজ’ কথাটির মর্ম এভাবে বিশ্লেষণ করেছেন : যে ব্যক্তি মুজদালিফায় অবস্থান করা রাত্রির ফজরের পূর্বে আরাফাত ময়দানে অবস্থান করেনি, তার হজ হয়নি। এ ব্যাপারে সমগ্র মুসলিম উম্মত একমত। ইমাম শাফেয়ী (রহ.) ও ইমাম আহমাদ (রহ.)-এর মতে তাকে পরবর্তী বছর হজ করতে হবে।
আজ ২০২১ সালের ১৯ জুলাই আরাফা দিবসে মসজিদে নামিরা থেকে হজের খুতবা দেবেন কাবার ইমাম ও খতিব শায়খ ড. বানদার বালিলাহ। বাংলাসহ ১০টি ভাষায় অনুবাদ করে প্রচার করা হবে এটি। খুতবার বাংলা অনুবাদ করবেন মক্কা ইসলামী সেন্টারে দাঈ হিসেবে কর্মরত বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার মাওলানা আ.ফ.ম ওয়াহীদুর রহমান।

গতকাল মিনাতে উপস্থিতির মাধ্যমে এবারের হজ পালনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। গতকাল সূর্যোদয়ের পর মিনার উদ্দেশে রওয়ানা দেন হাজিরা। বৈশ্বিক মহামারির কারণে তাদের ৩ হাজার বাসে করে ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিটি বাসে ২০ জন হাজযাত্রী বহন করে। সেখানে যোহর থেকে আজ ফজরের সালাত পর্যন্ত সেখানেই আদায় করেছেন।
আজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে মহান আল্লাহ তা‘আলার কাছে কায়-মনোবাক্যে মোনাজাতের মাধ্যমে জীবনের সব গুনাহের ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। ক্ষমা পাবার মাধ্যমেই হাজীরা এমন নিষ্পাপ হবেন যেন আজই তার মা তাকে ভূমিষ্ট করেছে। এদিন হাজীরা মসজিদে নামিরা থেকে প্রদত্ত হজের খুতবা শ্রবণ ও যোহর-আসর এক আজান দুই ইকামাতে আদায় করবেন। অবশ্য মসজিদে নামিরার বাইরে কেউ তাঁবুতে অবস্থানকার করলে তারা স্ব স্ব তাঁবুতে নামাজ আদায় করবেন।
আজ সূর্য অস্ত যাবার পর মাগরিব আদায় না করেই রওনা করবেন মুজদালিফার উদ্দেশে। এ বছর সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত গাড়ির ব্যবস্থা থাকায় হয়তো কাউকে পায়ে হেঁটে মুজদালিফায় যেতে হবে না। তবে যারা স্বেচ্ছায় হেঁটে যেতে চান তাদের কথা ভিন্ন।
মুজদালিফায় পৌঁছে হজযাত্রীরা মাগরিব ও এশা আদায় এবং খোলা ময়দানে রাত্রী যাপন করবেন। পরের দিন সূর্যোদয়ের পর মিনায় গিয়ে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাবার আগেই বড় জামরায় ৭ টি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। সরকার জীবাণুমুক্ত কঙ্কর প্রত্যেক হজযাত্রীকে উপহার দেয়ায় তাদের মুজদালিফা থেকে সংগ্রহ করতে হবে না।
হজযাত্রীরা ছাড়া বাকি সবাই আগামীকাল ঈদুল আজহা উদযাপন করবেন। হজযাত্রীদের বড় জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করা ছাড়াও কাবায় গিয়ে তাওয়াফে যিয়ারাহ তথা ফরজ তাওয়াফ আদায় করতে হবে।
এদিন না করে ফরয তাওয়াফ ১১ বা ১২ যিলহজও করা যায়। এদিনের আরো একটি কাজ হল মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করা। এরপর থেকে হজযাত্রীরা ইহরাম ছেড়ে স্বাভাবিক পোশাক পরবেন।
১১ ও ১২ যিলহজ হজযাত্রীরা সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাবার পর তিনটি জামারাত তথা জামরাতুল উলা, জামরাতুল উসত্বা ও জামরাতুল আকাবা বা বড় জামরাতে প্রতিদিন ৭টি করে ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। এরপর যারা সংক্ষেপ করতে চান তারা ১২ যিলহজ কঙ্কর নিক্ষেপের পর সূর্যাস্তের পূর্বেই মিনা ত্যাগ করবেন। মিনায় সূর্যাস্ত হয়ে গেলে ১৩ যিলহজ ৩ টি জামরাতে আরো ৭ টি করে ২১ টি কঙ্কর নিক্ষেপ করে হজ সম্পন্ন করবেন। পরিশেষে মক্কা ত্যাগের সময় বিদায়ী তাওয়াফ করবেন।
করোনাভাইরাস বিস্তারের শঙ্কা রোধে এবার হজযাত্রীদের সংখ্যা ৬০ হাজারে সীমিত করে দেয়া হয়েছে। অনলাইনে সাড়ে ৫ লাখের বেশি আবেদন থেকে লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত হন তারা। সবাইকে দেয়া হয় দুই ডোজের ভ্যাকসিন। গত বছর সউদীতে অবস্থানকারী বিভিন্ন দেশের ১০ হাজার মুসল্লি হজ্জ আদায়ের সুযোগ পেয়েছিলেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে তথা সামাজিক দূরত্ব বজায়সহ স্বাস্থ্য সুরক্ষার নানা ব্যবস্থার পাশাপাশি তা মানা নিশ্চিত করতে হজযাত্রীদের পাশাপাশি অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
হজ্জ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম এবং সক্ষম মুসলমানদের জন্য জীবদ্দশায় কমপক্ষে একবার ফরজ। এটি বিশ্বে মুসলিমদের বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ। ২০১৯ সালে বিশ্বের প্রায় ২৫ লাখ মুসলিম এতে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির কারণে দু’বছর ধরে সীমিত পরিসরে হজ্জ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
২০২১ সালের ২৩ মার্চ সউদী সরকার করোনা মহামারি সংক্রমণ রোধে ২৩ দিনের জন্য হারাম শরীফ এলাকায় কারফিউ জারি করে। তবে কাবা এলাকা সুরক্ষা প্রাচীর দিয়ে ঘিরে সীমিত আকারে তাওয়াফের অনুমতি দেয়া হয়। এর আগে ১৭ মার্চ থেকে দুই পবিত্র হারাম শরীফ ছাড়া সউদী আরবের সব মসজিদ বন্ধ ঘোষণা করে। সেই থেকে মক্কার হারাম শরীফ অনেকটা মুসল্লিশূন্য হয়ে গিয়েছিল। গতকাল তাওয়াফে কুদুম করতে আসা হজযাত্রীদের পদভাবে আবার অনেকটা ভরে ওঠে মাতাফ চত্তর। বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়াতে সরাসরি সম্প্রচারিত এ দৃশ্য দেখে অনেকের চোখে আবেগের পানি দেখা যায়।
বিশেষভাবে এ বছর হজ পালনের জন্য নির্বাচিত হজযাত্রীরা চলমান করোনভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারিতে পবিত্র অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত। এ বছর হজের জন্য নির্বাচিতদের বেশ কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে হয়েছে, যার মধ্যে ফাইজার, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মোডার্না বা জনসন ও জনসন ভ্যাকসিনের মধ্যে যে কোন একটি গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।
গত পাঁচ বছরে যারা হজ্জ পালন করেননি এ বছর সেসব ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এছাড়া হজ্জ করেননি ৫০ বছর বয়সী বা তার চেয়ে বেশি বয়সী ব্যক্তিদেরও অগ্রাধিকার দেয়া হয় এ বছর। এমনকি এবারই প্রথমবারের মতো পুরুষ অভিভাবক ছাড়া হজের নিবন্ধন করেছে সউদী নারীরা।
করোনাভাইরাসের ফলে হজযাত্রার ওপর নির্ভরশীল ব্যবসায়েও প্রভাব পড়েছে। এসব ব্যবসায় জড়িত রয়েছেন মক্কার হাজার হাজার মানুষ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে পানি,যানবাহন, স্যুভেনির তথা জায়নামাজ-তসবিহসহ অন্যান্য পণ্যের দোকান। হজ ও বছরব্যাপী ওমরাহযাত্রীদের থেকে সউদী আরব বছরে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার আয় করে।
আরাফাত ময়দানের সীমা:
‘আরাফাত’ দক্ষিণমুখী একটি বিশাল প্রান্তর। এর পূর্বে তায়েফের পাহাড়, উত্তরে মিনার পাহাড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এর ‘আরাফাত’ নামকরণ হয়েছে চতুর্দিকের পরিবেশের অবস্থা অনুসারে। কেননা, এর সমগ্র পরিবেশটি বহুদূর বিস্তৃত সমতল ভূমি সমন্বিত। এই সমতল ভূমি দক্ষিণ দিকে ‘আল ঈসা’ পাহাড় শ্রেণি পর্যন্ত প্রলম্বিত। এই বিশাল প্রান্তরের নাম আরাফাত রাখা হয়েছে এই কারণে যে, এখানে বিশ্বের জনগণ একত্রিত হয়ে একে অপরের সাথে পরিচিতি লাভ করে। কেননা, আরবি ‘আরাফ’ শব্দ হতে ‘আরাফাত’ শব্দটি গঠিত হয়েছে। ‘আরাফ’ শব্দের মূল অর্থ পরিচিতি। হযরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে অবতরণ করে দীর্ঘদিন বিচ্ছেদ বেদনা সহ্য করার পর এই ময়দানেই পরস্পরের সাথে একত্রিত ও পরিচিত হয়েছিলেন। ফলে, এই পরিচিতি লাভের দিনটিকে ‘আরাফা দিবস’ এবং স্থানটিকে ‘আরাফাত’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হজ্জ মৌসুমে নবী প্রেমিকরা পবিত্র মদিনা মোনাওয়ারা জিয়ারত করতে কৃপণতা করেন না।