আমার সিলেট ডেস্ক,২২ আগস্ট : দেশে মোট বিনিয়োগের বেশির ভাগই আসে ব্যাংকিং খাত থেকে; কিন্তু সামপ্রতিক সময়ে গ্রাহকের ঋণের চাহিদা না থাকায় ব্যাংকগুলো বিতরণ করতে পারছে না। ফলে ব্যাংকগুলোতে বর্তমানে প্রচুর অলস টাকা দৃশ্যমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান হিসাবে ২৫২ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ ২০ হাজার ২০০ কোটি টাকা অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, এর মূল কারণ ব্যাংকগুলোর একের পর এক নানা অনিয়ম বেরিয়ে আসা।
মানুষের আস্থায় বার বার আঘাত হানা। শুধু আস্থাহীনতার কারণেই মূলত বিনিয়োগ চাহিদা কমে যাচ্ছে। ফলে জমছে টাকার পাহাড়। পাশাপাশি বিদ্যুৎ সঙ্কট, অবকাঠামোগত সমস্যা, রপ্তানি কমে যাওয়া এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও এর পেছনে কাজ করছে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে দেখা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ৪৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা গত বছরের হিসাবে উদ্বৃত্ত রয়েছে ২৫২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। যদিও মে মাস শেষে এর পরিমাণ ছিল ২৫৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার। তবে ২০১০-১১ অর্থবছরে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বা ব্যালান্স অব পেমেন্টে (বিওপি) বড় অংকের উদ্বৃত্ত ছিল। ২০১১-১২ অর্থবছরে এসে তা ঘাটতিতে পরিণত হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যালান্স অব পেমেন্ট প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অর্থবছরে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও মে পর্যন্ত এফডিআই কম হয়েছিল। ২০১১-১২ অর্থবছরে নিট এফডিআইয়ের মাধ্যমে বিনিয়োগ হয়েছিল ১১৯ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরে হয়েছে ১৩০ কোটি ডলার। সে হিসেবে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বেড়েছে ৯ দশমিক ১৫ শতাংশ। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের সামগ্রিক ভারসাম্যের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫১২ কোটি ৮০ লাখ ডলার, যা ২০১১-১২ অর্থবছরে ছিল মাত্র ৪৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সে হিসেবে গত অর্থবছরে ৯৩৮ শতাংশ সামগ্রিক ব্যালান্স বৃদ্ধি হয়েছে। এদিকে ব্যাংকগুলো আমানত নিরুৎসাহিত করতে আমানতে সুদের হার কমিয়ে দিয়েছে।
কিছুদিন আগেও যেখানে ব্যাংকগুলো আমানত টানতে ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ সুদ গুনেছে, সেখানে আমানতের বিপরীতে এখন সুদের হার ৯ থেকে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশে কমিয়ে এনেছে। অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি আমানতের (এফডিআর) নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আগেও গ্রাহকদের নোটিশ করা হচ্ছে সুদ হার কমানোর। ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় কমিয়ে আনতে এর বিকল্প ছিল না বলে জানান ব্যাংকাররা। আর এ অবস্থাকে বিনিয়োগ মন্দার সবচেয়ে বড় লক্ষণ হিসেবেও তারা উল্লেখ করেছেন। সাধারণত মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব নীতিমালার আলোকে আমানত ও সুদহার নির্ধারণ করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আমানতের সুদহার নির্ধারণে এমন অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছিল, মাত্র কয়েক মাস আগে ঘোষণার চেয়ে বেশি সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করায় ১৭টি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীকে সতর্ক করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আর সে প্রতিযোগিতা থামাতে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি কয়েক দফায় মিটিংও করেছিল; কিন্তু কোন ফল হয়নি। অথচ গত দুই মাস ধরে পাল্টে গেছে সে চিত্র। এখন কত কম সুদে আমানত রাখা যায়, সে চেষ্টা করছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকগুলো যদি ঋণ বিতরণ করতে না পারে, তাহলে আমানত নিয়ে কি করবে। বর্তমানে বিনিয়োগ না থাকায় ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার কমাচ্ছে। আমানতের সুদের হার কমে যাওয়ায় ঋণের সুদও কমতে বাধ্য। তবে ব্যাংকগুলো এরই মধ্যে যে ক্ষতিতে পড়েছে, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য ঋণের সুদহার নাও কমাতে পারে। তাই ঋণ ও আমানতের সুদহারের ব্যবধান নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর হতে হবে।
নতুন যেসব ঋণ দেয়া হচ্ছে, তার গুণগত মানও ভাল হতে হবে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি যেহেতু কম, সেজন্য সার্বিকভাবে সুদের হারও কম হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। ব্যাংকাররা বলছেন, বিভিন্ন খাতে বিশেষ করে উৎপাদনশীল খাতে ব্যাংক বিনিয়োগ করে থাকে; কিন্তু চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কটে আশঙ্কাজনকভাবে বিনিয়োগ কমে যাওয়া, সামপ্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপসহ কয়েকটি ব্যাংকের বড় বড় জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশের পর ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন, ব্যাংকের মুনাফা কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতের প্রবৃদ্ধি স্তিমিত হয়ে পড়েছে।
আর এ অবস্থাকে ব্যাংকিং খাতের ক্রান্তিকাল হিসেবে উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, ২০১০ সালের পুঁজিবাজারে বড় ধস এবং ব্যাংকগুলোর বেপরোয়াভাবে ঋণ বিতরণের ফলে ২০১১ সাল থেকেই ব্যাংকগুলোর তারল্য সঙ্কট প্রকট হয়ে ওঠে। ফলে ২০১২ সালের শুরুতে সাড়ে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করতে থাকে ব্যাংকগুলো। এ বছরের শুরুতেও এ ধারা অব্যাহত ছিল। তবে সামপ্রতিক দৃশ্যপট পাল্টে প্রায় সব ব্যাংকেই বিপুল পরিমাণে অলস টাকা পড়ে আছে।