বুদ্ধিজীবী হত্যা : মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

    0
    453

    ঢাকা, ০২ মে : একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রধান দুই খুনি আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন ট্রাইব্যুনাল। আজ বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। পাশাপাশি আগামী ১২ মে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিলের বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে ওই দিন পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
    জানা গেছে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয়ার বিষয়ে আদেশের জন্য আজ ২ মে তারিখ ধার্য ছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গত রবিবার এ তারিখ ধার্য করেন। ওই দিন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোকলেছুর রহমান ট্রাইব্যুনালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার অভিযোগে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আবেদন জানান। এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ যেসব নথি দাখিল করেছে, তা ট্রাইব্যুনাল যাচাই-বাছাই করবেন এবং অভিযোগ আমলে নেয়া হবে কি না, সে বিষয়ে ২ মে আদেশ দেবেন।
    রাষ্ট্রপক্ষ গত ২৫ এপ্রিল ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কাছে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। রেজিস্ট্রারের কার্যালয় আনুষ্ঠানিক ওই অভিযোগ ট্রাইব্যুনাল-২-এ পাঠায়। ওই দিন রাষ্ট্রপক্ষ সাংবাদিকদের জানায়, যেহেতু তারা দুজনই একই ধরনের অপরাধ করেছেন, তাই তাদের বিরুদ্ধে আলাদা করে অভিযোগ না এনে একসঙ্গে ১৬টি অভিযোগ আনা হয়েছে।
    এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থা ২০১২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। গত বছরের ৯ অক্টোবর তা শেষ হয়। তদন্তে মুক্তিযুদ্ধকালে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। তদন্ত সংস্থা ১০ অক্টোবর তদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষীদের জবানবন্দি ও সংশ্লিষ্ট নথিপত্র রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়ে জমা দেয়। ১১ অক্টোবর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী ও প্রধান দুই খুনি হিসেবে অভিযুক্ত করে আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
    জানা যায়, গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে তদন্ত শুরু হয় আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে। মোট ১১ মাস ১৫ দিন তদন্ত করে ওই দুই জনের বিরুদ্ধে মোট ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ করে নির্যাতন শেষে হত্যা করার অভিযোগ সম্বলিত মোট ৮টি ভলিউমে এক হাজার ১৫৮ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত সংস্থা। তদন্ত প্রতিবেদনে দুই জনের বিরুদ্ধে সংগৃহীত ডকুমেন্টের সংখ্যা মোট ৩০০টি, যা ৫৮৪ পৃষ্ঠায় সন্নিবেশিত। এর মধ্যে আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে ৩০০ পৃষ্ঠার মোট ১৫০টি ডকুমেন্ট সম্বলিত ৪টি ভলিউমে ৫৯০ পৃষ্ঠা এবং চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে ২৮৪ পৃষ্ঠার মোট ১৫০টি ডকুমেন্ট সম্বলিত ৪টি ভলিউমে ৫৬৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়।
    গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুরের বেজড়া ভাটরা (চিলেরপাড়) গ্রামের মৃত আজহার আলী খানের পুত্র মো. আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে তদন্ত সম্পন্ন করেন তদন্ত সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তা মো. শাহজাহান কবীর। আর ফেনী জেলার দাগনভুঞার চানপুর চৌধুরী বাড়ি (জগতপুর ফালিজেরঘাট) গ্রামের মৃত দেলোয়ার হোসেন চৌধুরীর পুত্র চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে তদন্তকারী কর্মকর্তা হচ্ছেন মো. আতাউর রহমান। মাঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে তাদের নিজ এলাকা যথাক্রমে ফেনী ও গোপালগঞ্জেও তদন্ত করা হয়। একই সঙ্গে এলাকায় তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির খোঁজ নেয়া হয়। তাদের সম্পদের প্রাথমিক একটি তথ্যও তদন্ত সংস্থা সংগ্রহ করেছে।
    পলাতক আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীন দুই জন অভিযুক্ত হয়েছেন ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ স্বাধীনতার উষালগ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ শিক্ষক, ৬ সাংবাদিক ও ৩ চিকিৎসকসহ ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ করে নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যার দায়ে। এতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এক্ট’৭৩ এর ৩/২ ধারা মোতাবেক অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা ও গণহত্যা- এ ৫টি মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ আনা হয়।এ মামলায় মোট ৪৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
    গত ২৮ এপ্রিল আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে একসঙ্গে অভিযুক্ত করে ট্রাইব্যুনালে  আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল। এর আগে গত ২৫ এপ্রিল ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কাছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দিয়েছিলেন অপর প্রসিকিউটর সাইদুর রহমান। প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল নায়ক আশরাফুজ্জামান বর্তমানে নিউ ইয়ার্কের জ্যামাইকা শহরে আছেন। আর চৌধুরী মইনুদ্দিন লন্ডন রয়েছেন বলে তিনি জানান।
    আনুষ্ঠানিক অভিযোগে বলা হয়েছে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত আলবদর বাহিনীর চিফ এক্সিকিউটর বা প্রধান জল্লাদ ছিলেন আশরাফুজ্জামান খান আর অপারেশন ইনচার্জ ছিলেন চৌধুরী মাঈনুদ্দীন। তারা উভয়েই ছাত্রজীবন থেকে ইসলামী ছাত্রসংঘের সক্রিয় সদস্য হিসেবে এবং পরবর্তী সময়ে হাইকমান্ডের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেন।
    আনুষ্ঠানিক অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, এ দেশকে মেধাশূন্য করার জন্য বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরাসরি জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যরা হাইকমাণ্ডের নির্দেশে আলবদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলা হয়। মাঈনুদ্দীন ওই বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ এবং আশরাফুজ্জামান চিফ এক্সিকিউটর ছিলেন। তারা স্বাধীনতার উষালগ্নে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে তুলে মোহাম্মদপুরের ফিজিকেল ট্রেনিং সেন্টারের নির্যাতন ক্যাম্পে নিয়ে যেতেন। সেখানে আটকে রেখে তাদের ওপর নির্যাতন করা হতো। তারপর মিরপুর ও রায়েরবাজার ইটখোলা বধ্যভূমিতে নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে লাশ ফেলে দিতেন।
    যে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যার জন্য আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীন অভিযুক্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকরা হচ্ছেন, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ড. আবুল খায়ের, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. সিরাজুল হক খান, অধ্যাপক ফয়জুল মহি, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। শহীদ চিকিৎসকরা হচ্ছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. মর্তুজা, বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল আলীম চৌধুরী ও বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট ডা. ফজলে রাব্বী। শহীদ সাংবাদিকরা হচ্ছেন, দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজউদ্দিন হোসেন, পিপিআইয়ের চিফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশের চিফ রিপোর্টার আ ন ম গোলাম মোস্তফা, বিবিসির সংবাদদাতা ও পিপিআইয়ের সাবেক জেনারেল ম্যানেজার নিজামউদ্দিন আহমেদ, শিলালিপি পত্রিকার সম্পাদিকা সেলিনা পারভীন এবং দৈনিক সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার।
    বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সম্পর্কে অভিযোগে বলা হয়, আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের নেতৃত্বে আলবদরের একটি সশস্ত্র দল পরিকল্পিতভাবে ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারকে সন্ধান করতে গিয়ে বাহাত্তর সালের ৩০ জানুয়ারি মিরপুর বিহারি ক্যাম্পে গিয়ে নিখোঁজ ও শহীদ হন তার ভাই প্রখ্যাত সাহিত্যিক জহির রায়হান।
    একাত্তর সালের ১০ ডিসেম্বর রাতে দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেন এবং পিপিআইয়ের চিফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হককে তাদের বাসা থেকে অপহরণ করা হয়। ১১ ডিসেম্বর ভোর রাতে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার চিফ রিপোর্টার আ ন ম গোলাম মোস্তফা, ১২ ডিসেম্বর বিবিসির সংবাদদাতা ও সাবেক পিপিআইয়ের জেনারেল ম্যানেজার নিজাম উদ্দিন আহমদ, ১৩ ডিসেম্বর তারিখে দৈনিক শিলালিপি পত্রিকার সম্পাদিকা সেলিনা পারভীন এবং ১৪ ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক ও বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সারকে অপহরণ করা হয়। একই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ড. আবুল খায়ের, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. সিরাজুল হক খান, অধ্যাপক ফয়জুল মহি, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ মর্তুজাকে অপহরণ করা হয়। ১৫ ডিসেম্বর বিশিষ্ট চক্ষু চিকিৎসক ডা. আলিম চৌধুরী এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট ডা. ফজলে রাব্বীকে অপহরণ এবং নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। অপহৃত সাংবাদিকদের মধ্যে সেলিনা পারভীনের অর্ধগলিত লাশ রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে একাত্তর সালের ১৮ ডিসেম্বর পাওয়া যায়। অন্য সাংবাদিকদের লাশের হদিস পাওয়া যায়নি।