গারো পাহাড়ে বন্য প্রাণী বিলুপ্তির পথে হুমকির মুখে পরিবেশ

    0
    343

    আমার সিলেট টুয়েন্টি ফোর ডটকম,২৭সেপ্টেম্বর,রাকিবুল হক রোমান,আনু হাসানঃ জামালপুরের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের প্রাকৃতিক বন কেটে বন উজার করার ফলে পরিবেশ ও প্রাণী বৈচিত্র হুমকির মুখে পড়েছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। পরিবেশের ওপর প্রতিকুল প্রভাব পড়ায় জীববৈচিত্র বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সংকুচিত হয়ে পড়েছে বহু বন্য প্রানী ও দেশীয় পাখ-পাখালির আবাস স্থল। অনেক পাখি এবং প্রাণী প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। নব্বই দশকে এসব পাহাড়ে সচারচর বিচরণ করতো পাখ-পাখলির মধ্যে বনমোরগ, বনহাঁস, কোকিল, বেনেবউ, বউ কথা কও, টিয়া, ময়না, ঘুঘু, চড়ুই, টুনটুনি, মাছরাঙা, বক, কোয়েল, পাতিকাক, দাঁড় কাক, কাঠময়ূর, বালিহাঁস, চন্দনা, হরিয়াল, কাঁঠঠোকরা, ফেসকুল, বুলবুলি, ঈগল, বাজপাখি, শকুন, হারগিলা, কাইম, ডাহুক, সারস, পেঁচা।

    এসবের মধ্যে অনেক পাখিই আজ বিলুপ্তির পথে।নিশুতি রাতে এখন আর ডাহুকের মিষ্টি ডাক শোনা যায় না। আগের দিনে অনেক প্রজাতির ঘুঘুর বিচরণ ছিল। সকাল বেলা ঘুঘুর মিষ্টি ডাক শুনে ঘুম ভাঙ্গতো। ব্যাপক নিধনের ফলে এখন আর ঘুঘুর খুব একটা ডাক শোনা যায় না। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান; সামাজিক বনের গাছ লাগানোর আগে গারোপাহাড়ে বাঘ, ভাল্লুক, হরিণ, বানর, চিতাবাঘ, বনবিড়াল, সজারো, বনরুই, শুকর, বনগরু, চিত্রা ও মায়া হরিণ, রামকুত্তা, মেঘলা চিতা, সোনালি বিড়াল, গেছোবাঘ, উল্লুক, হনুমান, খরগোস, বেজি, লজ্জাবতী বানর, চশমাপড়া বানর, বন ছাগল, অজগর সাপ, শেয়াল, বাঘ শিয়াল ও বন্য হাতি ইত্যাদির দেখা পাওয়া যেত। কিন্ত বর্তমানে এসব প্রাণীর মধ্যে শিয়াল, বন্যহাতি ও বেজি ছাড়া আর কোন প্রাণীর সচরাচর বিচরণ লক্ষ করা যায় না।

    তবে মাঝে মধ্যে বানর, বনরুই, গেছোবাঘ, খরগোস, বনশুকর ও মায়া হরিনের দেখা মেলে। স্থানীয় বড়জ্যোষ্ঠ রিয়াজুল হক নামে এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, বন্য প্রাণী তো দূরের কথা, এসব বনে দেশী গরুরও দেখা পাওয়া যায় না। একসময় দুর্দান্ত প্রতাপে রাজত্ব করে বেড়াত চিতাবাঘ। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে বন ধ্বংস আর মানুষের হিংস্রতার ফলে এখন আর চিতাবাঘের দেখা পা্ওয়া যায় না।

    এ বছরে মার্চ মাসে গারো পাহাড় থেকে সতেরো কি.মি. দূরে লোকালয়ে একটি চিতাবাঘের দেখা মেলে। তবে উৎসুক জনতা সেটাকে পিটিয়ে হত্যা করে। প্রায় দুই মাস আগে বকসিগঞ্জ উপজেলা সদরে একটি মেছোবাঘ লোকালয়ে ঢুকে প্রায় পঞ্চাশজন লোককে আহত করলে জনতা সেটাকেও পিটিয়ে হত্যা করে আনন্দ মিছিল করে।২০০৫ সালে এ বনে সর্বশেষ অজগর সাপের দেখা পাওয়া গিয়েছিল।মাঝে মধ্যে মায়া হরিণের দেখা পাওয়া গেলেও স্থানীয় জনতা ভক্ষনের জন্য ফাঁদ পেতে হন্য হয়ে খোঁজে।তবে খাদ্য সংকটে মাঝে মধ্যেই বন্যহাতি লোকালয়ে এসে তান্ডব চালায়।

    স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, বিগত ১৯৯৮ সালে এডিপির অর্থায়নে প্রাকৃতিক বন কেটে উপজেলার পাহাড়ী বনাঞ্চল ন্যাড়া পাহাড়ে পরিনত করা হয়। সরকারি সিদ্ধান্তে সীমান্ত এলাকার দরিদ্র অসহায় মানুষের কথা চিন্তা করে তাদেরকে সৃজিত সামাজিক বনায়নের অংশীদার তথা উপকারভোগী বানানো হয়। এসব সামাজিক বনে আকাশমনি, ইউকিলিপটাচ, মিনজিয়ামসহ বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগানো হয়েছে। প্রতি ১০ বছর পর পর এ সামাজিক বনায়নের গাছ কাটা হচ্ছে।

    এতে উপকারভোগীরা পাচ্ছেন শতকরা ৪৫ভাগ অর্থ, সরকার পাচ্ছে ৪৫ভাগ অর্থ আর বাকি ১০ভাগ অর্থ পরবর্তীতে গাছ লাগানোর জন্য ট্রি ফার্মিং ফান্ড (টিএফএফ) ফান্ডে জমা রাখা হচ্ছে। এর প্রেক্ষিতে এলাকার গরীব মানুষের কিছুটা উপকার হলেও প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে।বনবিভাগ সুত্রে জানা গেছে; জামালপুরের বকশিগঞ্জ উপজেলা এবং শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার সমন্বয়ে বালিজুরী রেঞ্জ। এর আওতায় রয়েছে ডুমুরতলা বিট এবং বালিজুরী বিট।ডুমুরতলা বিটের আওতায় বনভুমি রয়েছে আট হাজার চুরাশি একর। সামান্য অংশ ছাড়া বর্তমানে একখন্ড জমিতেও প্রাকৃতিক বনভুমি নেই। প্রাকৃতিক বন কেটে সামাজিক বন সৃজনের ফলে পাহাড়ে বিভিন্ন ধরনের লতা-গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ জন্মাতে পারছে না। এমনকি বিভিন্ন ধরনের ঔষধি গাছ যেমন- শতমূল, মণিরাজ, তোকমা, আমলকি, হরতকি, বহেরা, বন কাপাস, অর্জুন, খাড়াজোরা, বাসকপাতা, হাড়জোড়া, বহেরা ইত্যাদি আর আগের মত দেখা পাওয়া যায় না।

    স্থানীয় অধিবাসী সোলায়মান হক বলেন, আমি ছোট সময় দেখেছি এই এলাকার গারো পাহাড়ে প্রাকৃতিক ঝর্ণা প্রবাহ ছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক বন কেটে সামাজিক বনায়ন করায় এখন পাহাড়ী ঝর্ণা শুকিয়ে গেছে। গারো আদিবাসী কাপুস সাংমা বলেন, গারো আদিবাসীরা অনাদিকাল থেকে পাহাড়ে বসবাস করে বনের লাকড়ী সংগ্রহ করে স্থানীয় হাট-বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতো। বর্তমানে পাহাড়ে বিক্রির লাকড়ি দুরের কথা, জ্বালানীর লাকড়িও পাওয়া যায় না। এতে পাহাড়ী গারোরা অনেক কষ্টে তাদের সংসার চালাচ্ছে।

    বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির যত কারণঃ এলাকাবাসী জানিয়েছেন, ১৯৮৮ সালে প্রাকৃতিক বন কেটে সামাজিক বনায়ন করা হয়।ফলে প্রাকৃতিক বন নিধনের ফলে বন্য প্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস ও খাদ্য সংকট দেখা দেয়।১৯৯৬ সালে জামালপুর জেলা পরিষদ গারো পাহাড়ের ২৬ একর জমি দখল করে “লাউচাপড়া অবসর বিনোদন ও পর্যটন কেন্দ্র” গড়ে তোলে, ফলে গারো পাহাড়ে বাড়তে থাকে মানুষের আনাগোনা আর ভারতে পালাতে শুরু করে বন্য প্রাণীরা ।জামালপুরের বকশিগঞ্জ উপজেলা এবং ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত এলাকায় ২০০৯ সালে কাটা তারের বেড়া দেওয়া হয়, এর ফলে পূর্বে অনেক প্রাণী এসব সীমান্ত এলাকায় ভারত থেকে এদেশে যাতায়াত করলেও বর্তমানে একটি বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    একজন বিজিবি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শুধু কাঁটাতারের বেড়া নয় এসব সীমান্ত এলাকায় চোরাকারবারির হাত থেকে রক্ষার জন্য রাতভর উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন হ্যালজেন লাইট জ্বালিয়ে রাখা হয়। স্থানীয় বাসিন্দা সম্রাট জানিয়েছেন, গারো পাহাড়ের ভিতর বসবাসকারী আদিবাসীরা বন্যপ্রাণীদের উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের বিষটোপ ব্যবহার করে শিয়ালসহ বিভিন্ন বন্যা প্রাণী হত্যা করে থাকে কিন্তু এ ব্যাপারে প্রশাসন নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।

    প্রতিটি বনায়নের ক্ষেত্রে ১০ ভাগ বন্যপ্রাণীদের সংরক্ষনের ব্যবস্থা থাকলেও এসব গারো পাহাড়ে এধরনের কোন ব্যবস্থা নেই এমনটাই জানিয়েছেন ডুমুরতলা বিটের কর্মকর্তা আবুল হোসেন। এছাড়াও শিকারীদের দৌরাত্ব বৃদ্ধি, অবৈধ্যভাবে পশু শিকার করে ভক্ষণ, মানুষের হিংস্রতা ও সচেতনার অভাব, কীটনাশকের ব্যবহার ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারনেই গারো পাহাড় থেকে আজ বন্য প্রাণী বিলুপ্তির পথে।