এএসপি আনোয়ার শামিম এর “একটি বাংলাদেশ কুটির এর গল্প”

    0
    755

    কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার (১৮৩৪ – ১৯০৭) ছিলেন বাঙালি জগতে এক স্বনামধন্য কবি।যার রেখে যাওয়া সোনালি অক্ষরে লিখিত কবিতার কিছু অংশ শত বৎসর পরেও আমাদের প্রেরণা যোগায়। এই প্রেরণার প্রতিফলন যেন ফুটিয়ে তুলেছেন এক মানব প্রেমী কবি শ্রীমঙ্গল র‍্যাব-৯ ক্যাম্পে কর্মরত খাগড়াছড়ি জেলার কৃতি সন্তান এএসপি আনোয়ার হোসেন শামিম। কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের ভাষায়-

    “ চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন
    ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে।
    কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে
    কভূ আশীবিষে দংশেনি যারে ” 

    সরকারী একজন কর্মকর্তা হিসেবে দেশের জনগণের সুখ-দুঃখ বুঝার শক্তি তার নিম্নের লেখার মাঝে ফুটে উঠেছে। তিনি ব্যথিতদের ব্যথা বুঝতে সক্ষম কতটা তা তার নিজের ভাষায় লেখা একটি স্ট্যাটাসই সচেতন পাঠকদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলে নেটিজেনরা বিশ্বাস করে।নিম্নে স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো।

    “ধ্বংসস্তূপবাসী পরিবার এবং একটি ‘বাংলাদেশ কুটির’এর গল্প”

    “২৫ এপ্রিল মধ্যরাত। স্ত্রী ও তিন শিশুসন্তান নিয়ে নিজ ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন আব্দুল কাদির। হঠাৎ কালবৈশাখীর ঝড় এসে পুরো ঘরটিকে নিমিষেই মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। সপরিবারে ধ্বংসস্তুপের নিচে আটকা পড়ে যান কাদির। প্রতিবেশিরা ছুটে এসে বিধ্বস্ত ঘরের এক কোন উঁচু করে ধরে তাদেরকে সেখান থেকে উদ্ধার করেন। কি, ভাবছেন পরিবারটির দুর্দশার এখানেই ইতি? ভুল। অভাগা কাদিরের জন্য এ ছিলো কলির সন্ধ্যা মাত্র।

    শ্রীমঙ্গলের পুরানগাও গ্রামের বাসিন্দা কাদির পেশায় দিনমজুর। করোনা পরিস্থিতির কারনে কাজকর্ম না থাকায় হাতও একদম ফাঁকা। কিন্তু যত যাই হোক, ঘর বিধ্বস্ত হবার পর এখন মাথাগোঁজার ঠাঁই তো লাগবে। স্ত্রী সন্তানের মুখে দুমুঠো ডালভাত তুলে দেওয়াই যেখানে দায়, সেখানে নতুন করে ঘর তৈরির বিষয়টা কাদিরের জন্য চিন্তারও অতীত। অগত্যা আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শিদের কাছে আশ্রয় সন্ধান। কিন্তু লাভ নেই। এই করোনা ভাইরাসের আতঙ্কের দিনে বাড়িতে কোন অতিথি দেখতে নারাজ সবাই। সব চেষ্টা বিফল হওয়ায়, একে একে সব দুয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে পরিবার সমেত ফের এই বিধ্বস্ত কাঠামোর মধ্যেই এসে ঢোকেন নিরুপায় কাদির। আগের রাতে যেই জীবন বাঁচাতে ধ্বংসস্তুপ থেকে বের হয়ে এসেছিলেন, পরদিন সেই জীবনের তাগিদেই ফের সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিতে হলো। হায় নিষ্ঠুর করোনার দিন, হায় মানবতা!!!

    সেই থেকে এখন ( ১২ মে) পর্যন্ত প্রায় ১৮টি দিন স্ত্রী সন্তানসহ এই ধ্বংসস্তুপের ফাঁকফোকরেই জীবন হাতে নিয়ে তার বসবাস। কখনো বৃষ্টির পানি রাতের ঘুমে বাগড়া দিয়েছে, কখনো সাপ- বিষাক্ত পোকামাকড় চলে এসেছে রাতের ঘুমের সঙ্গী হতে, অনন্যোপায়, অসহায় কাদির সেখানেই মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন, পড়ে থাকতেই হয়। এর মধ্যেই একদিন প্রসব বেদনা ওঠে কাদিরের সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর। মড়ার ওপর খাড়ার ঘা আর কি। এখন কি করা। এই ঘরে নবজাতক জন্ম দেওয়া আর তাকে গলা টিপে নিজ হাতে মেরে ফেলা সমান কথা। বাধ্য হয়ে কাদির নির্লজ্জের মতো সেই ফিরিয়ে দেওয়া প্রতিবেশিদের দ্বারস্থ হন আবারো। অনেক চেষ্টা তদবিরের পর এক প্রতিবেশী শুধু স্ত্রীকে থাকার জায়গা দিতে সম্মত হন। আর কাদির তার তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে পড়ে থাকেন আগেরই ঠিকানাতেই।

    গতকাল বিকেলে সিভিল পোশাকে ঘুরেঘুরে এলাকার কোয়ারেন্টাইন ও সামাজিক দূরত্ব পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখছিলাম। তখনই হঠাৎ ঘর(!!)টি নজরে আসে আমার। প্রথম দেখায় মনে হবে পরিত্যক্ত কোন জঞ্জাল। কাছে গিয়ে কয়েকটি বাচ্চাকে ভেতর থেকে উঁকি দিতে দেখে অবাক না হয়ে পারিনি। এরা এই বিপদসংকুল জায়গায় কি করে!!! জঞ্জালটির সামনে যেতেই ভেতর থেকে এক প্রকার হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে আসেন চল্লিশোর্ধ্ব আব্দুল কাদির। শোনালেন তার দুর্ভাগ্যের ইতিকথা। কৌতূহলবশতঃ আমিও একটু ঢুকেছিলাম (অবশ্যই হামাগুড়ি দিয়ে) জঞ্জালের স্তুপটির মধ্যে। দুই মিনিটেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসাতে দ্রুত বেরিয়ে এলাম। না, কোন মানুষের পক্ষে একদিনও এই জায়গায় থাকা সম্ভব নয়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয়, কাদিরের তিন শিশু সন্তান সুমাইয়া(৯), নাহিদ(৭) ও সামিয়া(৪); যাদের এখন কেবল খেলাধুলা নিয়ে মেতে থাকার কথা, তার বদলে তারা সারাক্ষণ শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সর্বনাশা কালবোশেখী যেভাবে তাদের ঘরটিকে মুহূর্তে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছিল, জঞ্জালের মধ্যে এই দীর্ঘ জীবন শিশুগুলোর মনোজগতকেও কি প্রতিনিয়ত একইভাবে দুমড়েমুচড়ে দিয়ে চলেছে!!!

    আমি ও আমাদের শ্রীমঙ্গল র‍্যাব ক্যাম্প পরিবার কাদিরের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিই। আমার নিজের ১০ হাজার টাকার সাথে ক্যাম্পের অন্যান্য সদস্যদের স্বেচ্ছায় দেওয়া ২ হাজার টাকা মিলিয়ে মোট ১২ হাজার টাকা সন্ধ্যার আগেই কাদিরের হাতে তুলে দিয়ে আসি। ঘর নির্মানের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনা হয়ে যাক। প্রতিবেশিদেরকেও সাধ্যমতো পাশে দাড়ানোর অনুরোধ করে এসেছিলাম। কিছুক্ষণ আগে আজ আবার গিয়ে দেখি, এর মধ্যে নির্মানকাজ শুরু হয়ে গেছে। নির্মানে যুক্ত শ্রমিকেরা কোন টাকা নেবেন না বলে আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রতিবেশী অনেকেই বিভিন্ন নির্মানসামগ্রী দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। যারাই কাদিরকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়েছেন, তাদেরকে আমি ১০ কেজি করে চালসহ অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের প্যাকেট উপহার হিসেবে দিয়ে এসেছি।
    এছাড়াও কর্মহীন কাদিরের পরিবারকে কিনে দিয়ে এসেছি ৫০ কেজি চালসহ পরিমাণমতো ডাল, সেমাই, চিনি, আলু, তেল ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী। আপাতত কিছুদিন পরিবারটা খাবারের টেনশন থেকে মুক্ত থাকুক। আরেকটি কাজ করে এসেছি- কাদিরের ঘরটির নামকরণ। কাজ সম্পন্ন হবার পর এই ঘরের নাম হবে ‘ বাংলাদেশ কুটির’। বিপদের মুহূর্তে আমরাসহ তার অন্যান্য প্রতিবেশীদের সহায়তায়ই এই ঘরের নির্মাণ। আর পরস্পরের প্রতি এই সহমর্মিতাই আবহমান বাংলার চিরায়ত রূপ। এই নামকরণের পেছনের কারন এটাই।

    আশা করি, দুয়েক দিনের মধ্যেই ধ্বংসস্তুপের উপর সগর্বে মাথা তুলবে আব্দুল কাদিরের ‘বাংলাদেশ কুটির’। দুঃস্বপ্নের প্রহর পেরিয়ে ঘরের মেঝেতে আবার নানারকম খেলায় মেতে উঠবে খুদে সুমাইয়া, নাহিদেরা। সকলের নিকট অনুরোধ- এই করোনার দিনে আপনাদের নিজ নিজ এলাকাতেও একটু খোঁজখবর রাখুন। সেখানেও আছে কি কোন আব্দুল কাদির পরিবার? করোনার এই বৈশ্বিক মহামারির দিনে কাজ হারিয়ে অর্থাভাবে এমন ভয়াবহ দুর্দশায় পতিত আছেন যারা, প্লিজ তাদের পাশে দাঁড়ান।” 

    কলেবর বৃদ্ধির ভয়ে প্রায় আড়াই’শতের অধিক কমেন্ট থেকে একটি কমেন্ট নিম্নে উল্লেখ করছি, তিনি বলেন  NaZmuL HaSaN LinKoN আমাদের ডিফেন্সে এমন কোনো বাহিনী আছে যানা ছিল না।।।।। এমন একটা কারণে আমার ইচ্ছে ছিল আর্মিতে যাওয়ার কিন্তু বাগ্যে জুটে নায়। কিন্তু আমার এমন বাহিনীর জন্য আমার কিছু বলার থাকে না। আমার এমন আরও অনেক এমন কিছু কথা শুনে বাহিনীতে যোগদানে অনুপ্রাণিত হবে ইনশাল্লাহ।।।।। হয়ত এটার ফল আপনি এহন না ও পেতে পারেন? কিন্তু এটার আনন্দ সব কিছুর থেকে বেশি।
    বাহিনী যোগদানের মানে এটা না যে আপনি আপনার ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য যোগদান করবেন।