ঝড়-তুফানে অভুক্ত সংখ্যালঘু পরিবারের পাশে র‍্যাবকর্তা

    0
    257

    “ঝড়বৃষ্টির রাতে অসহায় সংখ্যালঘু পরিবারের খাবারের সংস্থান করে নেটিজেনদের প্রশংসায় ভাসছেন শ্রীমঙ্গল র‍্যাব ক্যাম্পের কমান্ডার এএসপি মো. আনোয়ার হোসেন শামীম” 

     

    জহিরুল ইসলাম,নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ঝড়বৃষ্টির রাতে অসহায় সংখ্যালঘু পরিবারের খাবারের সংস্থান করে নেটিজেনদের প্রশংসায় ভাসছেন শ্রীমঙ্গল র‍্যাব ক্যাম্পের কমান্ডার এএসপি মো. আনোয়ার হোসেন শামীম।বৃহস্পতিবার (২এপ্রিল) সন্ধ্যারাত। মৌলভীবাজারের আকাশে তখন ঘন কালো মেঘ, বৃষ্টি-ঝড়ো হাওয়ার সাথে ঘন ঘন বিজলিও চমকাচ্ছে সমানতালে। ভয়ে অনেকেই নিজ নিজ আবাসস্থলে। হঠাৎ বৃষ্টির কারনে বেশিরভাগ সংস্থার ত্রাণ তৎপরতাও গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে, এ সময় শ্রীমঙ্গল র‍্যাব ক্যাম্পের কমান্ডার এএসপি মো. আনোয়ার হোসেন শামীম’র নিকট নির্ভর যোগ্য সুত্রে খবর আসে যে, শ্রীমঙ্গল উপজেলাধীন ৫ নং কালাপুর ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের পুর্বপাড়ার অনেকগুলো সংখ্যালঘু “শব্দকর” (স্থানীয়দের কাছে ঢুলি পাড়া নামে পরিচিত) পরিবারের সদস্যরা কয়েক দিন কাজে না যেতে পেরে সারাদিন অভুক্ত অবস্থায় আছে। এখুনি ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব না হলে এদের অনেককেই রাতেও অবুঝ সন্তানসন্ততি নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে খেটে খাওয়া এ মানুষগুলোকে।

    সংবাদ পেয়ে ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই দুর্গতদের নিকট ছুটে যান এই র‍্যাব কর্মকর্তা। গাড়ি চলাচলের রাস্তা নেই বিধায় তিনি ও তার সঙ্গীয় অন্যান্য র‍্যাব সদস্যরা দুই হাতে ত্রাণের বস্তা বহন করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কাদাপানি মাখামাখি হয়ে অভুক্ত মানুষ গুলোর নিকট পৌঁছান এবং অধিকতর অসচ্ছল মোট ১৫ টি পরিবারের নিকট পৌঁছে দেন চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী। এসময় তিনি ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে সরকারি সাহায্য পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাসও দেন।

    রাজাপুর এলাকার বাসিন্দা বিধবা সন্ধ্যা রানী কর ও তার অবুজ সন্তানরা।ছবি-এনিমেটরস মিডিয়া

    সাহায্যপ্রাপ্তদের মধ্যে অন্যতম রাজাপুর বস্তির বাসিন্দা বিধবা সন্ধ্যা রানী কর, যিনি তার দুই শিশু কন্যাসহ সারাদিন অভুক্ত অবস্থায় ছিলেন। সূর্য পাটে যেতেই ঝড়বৃষ্টির আভাস দেখে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, সকাল থেকে যে ত্রাণের আশায় বসে আছেন, রাতেও সেটা আর পাওয়া হচ্ছে না। সকাল এবং দুপুরের মতো রাতেও তার সন্তানদের মুখে এক মুঠো দানাপানি তুলে দিতে পারবেন না ভেবে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন এ মধ্য বয়স্ক নারী। এমন সময় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে খাদ্যসামগ্রীর বস্তা নিয়ে তাদের পাড়ায় হাজির হন র‍্যাব কমান্ডার এএসপি মো. আনোয়ার হোসেন শামীম।

    প্রসঙ্গত, সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে যখন সারা পৃথিবীর বাঘা বাঘা দেশ লণ্ডভণ্ড তখন বাংলাদেশও পড়েছে এই ছোবলের আঘাত। অঘোষিত লক ডাউনে বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষগুলো পড়েছে মহাসঙ্কটে। সরকারের স্বাস্থ্যবিধি পালনকল্পে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে নিজের সুরক্ষার প্রয়োজনেই বাইরে যেতে পারছেন না নিম্ন আয়ের এসব মানুষ। সরকারের তরফে পর্যাপ্ত ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও ফাঁকফোকরে এই সঙ্কটের শিকারে পরিণত হয়ে যাচ্ছেন সন্ধ্যা রানীর মতো কেউ কেউ। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে ত্রাণ বণ্টন প্রক্রিয়াকে আরো প্রাপ্যতা ও লক্ষ্যভিত্তিক করা প্রয়োজন বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহলের অভিমত।

    এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ভুক্তভোগী সন্ধ্যা রানী বলেন, “বৃষ্টি বাদলা হতে দেখে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম যেন, সারাদিনের উপোস বাচ্চাগুলোকে রাতেও আর উপোস না থাকতে হয়। আমি না খেয়ে থাকি থাকি, বাচ্চাগুলোর একটা ব্যবস্থা যেন হয়। এমন সময় ভগবান র‍্যাব স্যারকে চালডাল দিয়ে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন”।

    ঘটনাস্থলে শব্দকর পরিবারের আশপাশের অনেকের সাথে সরেজমিনে এই প্রতিবেদক কথা বললে সমীরণসহ অনেকেই স্বীকার করেন এবং বলেন ”আমরা এমন র‍্যাব অফিসার দেখিনি, আমরা যখন ঘর থেকে বাহিরে যেতে সাহস পাইনি তখন তিনি নিজেই আরও র‍্যাব সদস্যদের নিয়ে ছাতা মাথায় করে ভিজে কাদা মাটিতে ভরে পায়ে হেটে ঝর-তুফানের মধ্যে আমরার মত অতি সাধারণ মানুষের জন্য খাদ্য সামগ্রী নিয়ে এসেছেন। আমরা প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম।পরে উনাদের হাতে প্যাকেট দেখে সাহস পাই। আমরা এই স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা চাই এমন অফিসার যেন সমাজে অনেক দিন বেঁচে থাকে।”

    শ্রীমঙ্গল র‍্যাব ক্যাম্পের কমান্ডার এএসপি মো. আনোয়ার হোসেন শামীম।ফাইল ফটো,

    অপরদিকে এই ঘটনাকে নিয়ে নিজের আইডিতে এবং ফেসবুক পেজ Shamim Anwar এ একটি ভিডিও পোস্ট করেন এ র‍্যাব কর্মকর্তা, যেখানে দেখা যায় খাদ্য সাহায্যের প্যাকেট নিতে গিয়ে অঝোর ধারায় চোখের জল ফেলছেন বিধবা সন্ধ্যা রানী কর। এএসপি আনোয়ার এসময় বোন সম্বোধন করে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। ফেসবুক পোস্টের পর থেকেই নেটিজেনদের প্রশংসায় ভাসছেন তিনি। জনৈক রেজাউল ভুইয়া লিখেন, “সারা বাংলাদেশ একদিন আপনার মত মানবিক মানুষে ভরপুর হবে এটাই প্রত্যাশা রইলো। আর অনেক অনেক দোয়া রইলো আপনার জন্য”। আজিম উদ্দিন নামের অন্য আরেকজন লিখেন, “চোখে পানি চলে আসলো। ধন্যবাদ স্যার। এভাবে সবাই মানুষের পাশে থাকতে হবে”। সংবাদ লেখা পর্যন্ত র‍্যাব কর্তার এই স্ট্যাটাসে ১ হাজার এক শতের অধিক লাইক, প্রায় দেড় শতাধিক কমেন্ট ও ১১৭ টি শেয়ার করা হয়।

    নিচে ফেসবুক স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
    “”আজ সন্ধ্যায় বাইরে যখন ঘনঘোর বর্ষণ, বেশিরভাগ সংস্থার ত্রাণ তৎপরতা যখন ‘আজকের জন্য’ বন্ধ, তখন আমি এবং আমার টিম RAB-9 ছিলাম উপোস মানুষগুলোর দুয়ারে দুয়ারে। বৃষ্টির পানিতে আসল আগুন নিভলেও ক্ষুধার আগুন তো আর নেভে না। যে বিধবা আজ সকাল থেকে দুই শিশুসন্তান নিয়ে না খেয়ে আছে, সে-ই জানে ক্ষুধার জ্বালা কি জিনিস! তাই এ ঝঞ্ঝাময় বাদলধারার দিনে অন্য অনেকের ত্রাণ তৎপরতা থেমে যাওয়ার মুহূর্তে আজ আমাদের ছিল বর্ধিত আয়োজন। অন্যদের জায়গাগুলোতেও তো আজ আমাদের যেতে হবে!
    মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আদেশ অনুযায়ী ঘরেঘরে যেয়ে ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছি। সত্যি বলছি এই মহিলার কান্না দেখে আমি নিজেরই চোখের পানির বাধ মানাতে পারিনি। তাঁর কাছ থেকে আমাদের কতো কিছু শিক্ষনীয়! না খেয়ে আছেন, তবুও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ঘরের বাইরে যান নি। সবাইকে বলছি, প্লিজ আর কয়েকটি দিন ধৈর্য ধরুন। সাময়িক কষ্ট হলেও প্লিজ সবাই ঘরে থাকুন। ত্রাণ আপনার কাছে পৌছে যাবেই। করোনা পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবিলা করে ইনশাআল্লাহ ঘুরে দাঁড়াবেই এই অপরাজেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বের বাংলাদেশ ইনশাআল্লাহ পরাজিত হতে পারে না, পরাজিত হবে না। [Md. Anwar Hossan (Shamim Anwar), এএসপি, র‍্যাব-৯, সিলেট। কমান্ডার, শ্রীমঙ্গল র‍্যাব ক্যাম্প।]

    উল্লেখ্য, মো. আনোয়ার হোসেন শামীম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগে পড়াশুনা করার পর ৩৪ তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারে সহকারী পুলিশ সুপার পদে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি র‍্যাব-৯ এর শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।