মিলাদ শব্দের অর্থ ও মিলাদ শরীফ পাঠের ফজিলত

    0
    4771

    আমারসিলেট24ডটকম,০৩জানুয়ারীঃ এ মাস পবিত্র মিলাদুন্নবীর মাস।এ মাসে মহা নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহে ওয়া সাল্লামের পবিত্র জন্ম দিন।আগামীকাল সারাদেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের সুন্নি মতাবলম্বিরা পবিত্র মিলাদুন্নবী (দঃ) উদযাপন করবে। যদিও সাড়া বছরেই পবিত্র মিলাদুন্নবী পালন করা হয়।আসুন দেখি পবিত্র মিলাদুন্নবী(দঃ) সম্পর্কে দালিলিক আলোচনায় কি দেখা যায়।

    মিলাদ শব্দের অর্থ
    মিলাদ (ميلاد), মাওলেদ (مولد) এবং মাওলুদ (مولود) এ তিনটি শব্দের আভিধানিক অর্থ যথাক্রমে হল জন্মদিন, জন্মকাল ও জন্মস্থান প্রভৃতি।
    সুপ্রসিদ্ধ আল মুনজিদ নামক আরবি অভিধানের ৯১৮ পৃষ্ঠায় রয়েছে, الميلاد – وقت الولادة অর্থাৎ মিলাদ অর্থ জন্মসময়।المولد – موضع الولادة او وقتها মাওলেদ অর্থ জন্মস্থান অথবা জন্মসময়। المولود – الولد الصغير মাওলুদ অর্থ ছোট শিশু।
    অনুরূপ মিসবাহুল লুগাতের ৯৬৬ পৃষ্ঠায় রয়েছে, ‘মিলাদ’ অর্থ জন্মসময়। ‘মাওলেদ’ অর্থ জন্মস্থান অথবা জন্মসময়। ‘মাওলুদ’ অর্থ ছোট শিশু।
    ‘মিলাদ’ শরীফ অর্থ হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মোৎসব উদ্‌যাপন। তাছাড়া আল্ মিসবাহুল মুনীর, ফিরুজুল লুগাত, গিয়াসুল লুগাত, লুগাতে সুরাহ, প্রভৃতি আরবি অভিধানে ‘মিলাদ’শব্দের উপরোক্ত অর্থই উল্লেখ করা হয়েছে।
    মোদ্দাকথা ‘মিলাদ’ শব্দটি জন্মকাল বা জন্মদিন ব্যতীত অন্য কোন অর্থে ব্যবহৃত হয় না। সুতরাং মিলাদুন্নবী, মাওলেদুন্নবী ও মাওলুদুন্নবী শব্দগুলির অর্থ হল, নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মদিন বা জন্মকাল।
    ইসলামের পরিভাষায় একমাত্র আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম সংক্রান্ত কাহিনী ও তদসম্বলিত ঘটনাবলী আলোচনা করা এবং এ অনুষ্ঠানকেই মিলাদুন্নবী বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। সংক্ষেপে বলা হয় ‘মিলাদ শরীফ’।

    মিলাদ শরীফ পাঠ করার ফজিলত
    আল্লামা শিহাব উদ্দিন আহমদ ইবনে হাজর মক্কী হায়তামী শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিশ্বখ্যাত ‘আন নিয়ামাতুল কুবরা’ আলাল আলাম নামক কিতাবে মিলাদ শরীফ পাঠ করার ফজিলত ও উপকারিতা সম্পর্কে কয়েকখানা হাদিস শরীফ ও ইমামদের মতামত বর্ণনা করেছেন।
    অর্থাৎ হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন,
    قال ابوبكر الصديق رضى الله عنه من انفق درهما على قراءة مولد النبى صلی الله عليه وسلم كان رفيق فى الجنة
    অর্থাৎ যে ব্যক্তি নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিলাদ শরীফে এক দিরহাম খরচ করবে সে বেহেশতে আমার সঙ্গে দোস্ত হিসেবে থাকবে।
    হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন যে,
    قال عمر رضى الله عنه من عظم مولد النبى صلى الله عليه وسلم فقد احيا اللاسلام
    অর্থাৎ যে ব্যক্তি নবীয়ে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার মিলাদ শরীফের সম্মান করলো, নিশ্চয়ই সে ইসলামকে জিন্দা করল।
    হযরত উসমান গণি রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন যে,
    قال عثمان رضى الله عنه من انفق درهما على قراءة مولد النبى صلى الله عليه وسلم فكانما شهد غزوة بدر و حنين
    অর্থাৎ যে ব্যক্তি নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিলাদ শরীফ পাঠে এক দিরহাম খরচ করল, সে যেন বদর ও হুনাইনের যুদ্ধে শরিক হল।’
    শেরে খোদা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন-
    قال على رضى الله عنه وكرم الله وجهه من عظم مولد النبى صلى الله عليه وسلم وكان سببا لقراءته لايخرج من الدنيا الا بالايمان ويدخل الجنة بغير حساب
    অর্থাৎ যে ব্যক্তি নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিলাদ শরীফের সম্মান করল, তার মৃত্যু ঈমানের সাথে হবে। অর্থাৎ সে ঈমানদার হিসেবে মারা যাবে এবং বিনা হিসেবে বেহেশতে যাবে।’

    ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি বলেন, যে ব্যক্তি নবীয়ে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিলাদ শরীফের জন্য বন্ধুবান্ধবকে একত্রিত করবে এবং তাদের জন্য খাদ্য পানীয় তৈরি করে রাখবে ও ভাল ভাল কাজ করবে। আল্লাহ তা’য়ালা কিয়ামতের দিনে নবীগণ, শহীদগণ ও সালেহগণের সঙ্গে তাঁর হাশর করবেন এবং সে জান্নাতে নাঈমে থাকবে।
    হযরতুল আল্লামা আবুল হাসান সিররি সাক্বতি রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, যে ব্যক্তি নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিলাদ শরীফ পাঠ করার নিমিত্তে কোন এক জায়গা ঠিক করে নেবে। নিশ্চয় তাকে বেহেশতের বাগান দান করা হবে। কেননা মিলাদ শরীফের জায়গা শুধুমাত্র রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বতেই নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে এবং নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই বলেছেন, যে আমাকে মহব্বত করবে সে আমার সঙ্গে বেহেশতে থাকবে।
    আল্লামা শেখ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ উলাইশ মালিকী রহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি এর লিখিত মৌলুদে বরজঞ্জীর শরাহ ‘আলকউলুল মুঞ্জী’ নামক কিতাবের ১৫ পৃষ্ঠায় লেখা আছে, সরকারে কায়েনাত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মিলাদ শরীফের সম্মান করবে কিয়ামতের দিনে আমি তার শাফায়াতকারী হব এবং কোন ব্যক্তি আমার মিলাদ শরীফে এক দিরহাম খরচ করলে আল্লাহর রাস্তায় পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ খরচ করার সমান সওয়াব পাবে।
    উস্তাযুল উলামা আল্লামা শেখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি ‘মাসাবাতা মিনাসসুন্নাহ’ ৭৯ পৃষ্ঠায়, আল্লামা আব্দুল বাকি রহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি জারকানী শরীফের ১ম খন্ডের ১৩৯ পৃষ্ঠায়, বুখারী শরীফের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাকার আল্লামা ইমাম কাছতালানী রহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি ‘মাওয়াহিবে লাদুনিয়া’ নামক কিতাবের ১ম খন্ডের ২৭ পৃষ্ঠায়, আল্লামা আলী বিন বুরহান উদ্দিন হলবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তদীয় সিরাতে হলবিয়া নামক কিতাবের ১ম জিলদের ৮৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন,
    لازال اهل الاسلام يحتفلون بشهر مولوده عليه السلام ويعملون الولائم ويتصدقون فى لياليه بانواع الصدقات ويظهرون السرور ويزيدون فى المبرات ويعتون بقراءة بمولده الكريم ويظهر عليهم من بركاته كل فضل عميم
    ومما جرب من خواصه انه امان فى ذلك العام وبشرى عاجلة بنيل البغية والمرام فرحم الله امرا اتخذ ليالى شهر مولده المبارك اعيادا ليكون اشد علة على من فى قلبه مرض و عناد
    অর্থাৎ ‘মুসলমানগণ সর্বদা নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মমাসে মাহফিল করে থাকেন। সে উপলক্ষ্যে আনন্দ ভোজাদি প্রস্তুত করে থাকেন এবং ঐ রাতসমূহে বিভিন্ন প্রকারের দান খয়রাত ও আনন্দ প্রকাশ করে থাকেন, অধিক পরিমাণে নেক কাজ করে থাকেন এবং মিলাদ শরীফ পাঠ করার ক্ষেত্রে অতি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। যার বরকতে তাদের উপর বিভিন্ন প্রকারের কল্যাণ সাধিত হয়ে থাকে।
    মিলাদ শরীফ পাঠের পরীক্ষিত বিশেষত্ব এই যে, এর বদৌলতে এক বছর পর্যন্ত নিরাপদ ও শান্তিতে থাকবে। নেক মকসুদ ও প্রয়োজনাদি শীঘ্রই পূরণ হবে। আল্লাহ তায়ালা ঐ ব্যক্তির উপর অফুরন্ত রহমত বর্ষণ করবেন, যে ব্যক্তি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মমাসের রাত্রিকে ঈদ হিসেবে গ্রহণ করেছে, যাতে এ ঈদ শক্ত মসিবত হয়ে দাঁড়ায় ঐ ব্যক্তির জন্য যার কলবে ব্যাধি রয়েছে।’
    আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী রহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি তদীয় রচিত ‘মাওরিদুররাবী’ নামক কিতাবে লিখেছেন,
    لازال اهل الاسلام يحتفلون فى كل سنة جديدة ويعتون بقراءة مولده الكريم ويظهر عليهم من بركاته كل فضل عميم
    অর্থাৎ ‘মুসলমানগণ প্রতি নব বৎসরে মাহফিল করে থাকেন, এবং মিলাদ শরীফ পাঠ করার ব্যাপারে অতি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। মিলাদ শরীফ পাঠের বরকতে তাদের উপর অনেক প্রকারের কল্যাণ সাধিত হয়।
    তিনি (মোল্লা আলী ক্বারী) এ কিতাবে এ প্রসঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করে বলেন নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমণের কারণে মাস সমূহের মধ্যে রবিউল আউয়াল মাসের ফজিলত ও মর্তবা খুবই বেশি। সরকারে কায়েনাত হন রবি অর্থাৎ বসন্তকাল সদৃশ। তিনি বসন্তকালীন মাসসমূহের প্রথম বসন্ত মাসে মাওসুমে রবি অর্থাৎ বসন্তকালে ভুমিষ্ট হয়েছেন। তিনি সমুজ্জ্বল জ্যোতি অপেক্ষা সমধিক আলোর চেয়ে ও সর্বাধিক জ্যোতির্ময়।’
    সহীহ মুসলিম শরীফের ১ম জিলদের ৩৬৮ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে, হযরত আবু কাতাদা আনসারী হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
    سئل عن صوم الاثنين قال ذاك يوم ولدت فيه ويوم بعثت او انزل على فيه
    অর্থাৎ ‘রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সোমবারে রোজা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল, তিনি বললেন, সোমবারে তো আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং সোমবারই আমার প্রতি সর্বপ্রথম ওহী নাজিল করা হয়েছে।’
    এই হাদিস শরীফের আলোকে বুঝা গেল, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং এই সোমবারের বরকতে বৎসরের ৫২টি সোমবার ফজিলত ও বরকতময় হয়ে গিয়েছে, এবং হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবারে রোজা পালন করার অনুমতি ও উৎসাহ প্রদান করলেন।
    উপরন্তু তাফসিরে রুহুল বয়ান নামক কিতাবের নবম জিলদের ৫৬ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে, হিজরি নবম শতকের মুজাদ্দিদ আল্লামা জালাল উদ্দিন সুয়ূতী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
    يستحب لنا اظهار الشكر لمولده عليه السلام
    অর্থাৎ হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিলাদ শরীফের আলোচনা করে শোকর আদায় করা আমাদের জন্য মুস্তাহাব। সুত্রঃwww.RawshanDalil.com