২৭হাজার করোনার ভুয়া রিপোর্ট প্রদানকারী ডাক্তারদের কারাদণ্ড

0
272
২৭হাজার করোনার ভুয়া রিপোর্ট প্রদানকারী ডাক্তারদের কারাদণ্ড
২৭হাজার করোনার ভুয়া রিপোর্ট প্রদানকারী ডাক্তারদের কারাদণ্ড

আমার সিলেট ডেস্কঃ সারা পৃথিবীর মানুষ যখন আতংকিত,দিশেহারা তখন মানুষের ভয় ও দুর্বলতাকে পুঁজি করে করোনার ভুয়া রিপোর্ট দেয়ার আলোচিত মামলায় জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারপার্সন ডাঃ সাবরিনা চৌধুরী ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আরিফুল হক চৌধুরীসহ আট আসামি প্রতেকের ১১ বছর করে কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।

এর মধ্যে সিইও আরিফুল হক চৌধুরী ও চেয়ারম্যান ডাঃ সাবরিনা আরিফ চৌধুরীসহ আট আসামিকে দণ্ডবিধির পৃথক তিন ধারায় এই ১১ বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত। ঢাকার অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালত মঙ্গলবার ১৯ জুলাই এ আদেশ দেন। এ সময় আদালত মন্তব্য করেছেন, জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ডাঃ সাবরিনা ও সিইও আরিফুল হক চৌধুরীসহ অন্য আসামিরা করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে মানুষের জীবন নিয়ে খেলেছে। এজন্য তাদের সাজা পাওয়া উচিত।

মঙ্গলবার দুপুরে রায় ঘোষণাকালে ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন রায়ের পর্যবেক্ষণে এসব কথা বলেন। রাষ্ট্রপক্ষের ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু রায় ঘোষণা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন-এই আসামিরা করোনা মহামারীতে মানুষের জীবন নিয়ে খেলেছেন। তারা কখনও অনুকম্পা পেতে পারেন না। তাই তাদের আদালত সাজা দিয়েছেন।

রায় প্রদানকালে বিচারক আরও বলেন, ৩৪ ধারার বিধান মতে সকলে একই শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। অভিপ্রায় ছিল একই। অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে একই কাজ করেছে। সুতরাং সকলেই একই শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। রাষ্ট্রপক্ষের মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী স্পেশাল পিপি আজাদ রহমান বলেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট, তবে আদালত আরও সাজা দিতে পারতেন। আশা করি, উচ্চ আদালতেও এ সাজা বহাল থাকবে।

তবে নাখোশ আসামিপক্ষ। তারা উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, ‘আদালত সকল আসামির বিরুদ্ধে যে কমন ইনটেনশনে সাজা দিয়েছে, আমি মনে করি এটা সঠিক হয়নি। আমরা উচ্চ আদালতে যাব।’

মামলায় কারাদণ্ড প্রাপ্ত অপর আসামিরা হলেন, আবু সাঈদ চৌধুরী, হুমায়ন কবির ও তার স্ত্রী তানজিলা পাটোয়ারী, জেকেজি হেলথকেয়ারের নির্বাহী কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম রোমিও ও প্রতিষ্ঠানটির ট্রেড লাইসেন্সের স্বত্বাধিকারী জেবুন্নেসা রিমা ও বিপ্লব দাস।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লা আবু সংবাদ মাধ্যমকে জানান, মামলাটিতে প্রত্যেক আসামিকে দণ্ডবিধির ৪০৩ ধারায় তিন বছর, ৪৬৬ ধারায় চার বছর ও ৪৭১ ধারায় চার বছর; সর্বমোট ১১ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এসব দণ্ড একটি শেষ হলে পরবর্তীটি কার্যকর হবে বলে আদেশে বলা হয়েছে।

মহামারী করোনাভাইরাসকে পুঁজি করে জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারপার্সন ডাঃ সাবরিনা ও রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মোহাম্মদ শাহেদের মতো অনেকেই করোনার ভুয়া রিপোর্ট প্রদানের রমরমা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। অনেক ব্যবসায়ী ও ব্যক্তি অতিরিক্ত টাকা কামাতে গিয়ে অস্বাভাবিক দামে মাস্ক সরবরাহ করে মাস্ক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। এর সঙ্গে অনেক সরকারী কর্মকর্তারও যোগসাজশ হয়েছে। এসব বিষয়ে ওই সময় একাধিক মামলা হয়। প্রতিটি মামলাই বেশ আলোচনার সৃষ্টি করে। সবচেয়ে আলোচনার সৃষ্টি করেছিল জেকেজি ও রিজেন্ট হাসপাতালের ভুয়া রিপোর্টের ব্যবসা। এই ভুয়া রিপোর্টে বহু নিরীহ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে।

আলোচিত এই মামলায় রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার কারাগার থেকে ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয় আসামিদের। রায় ঘোষণার আগে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তাদের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকা সিএমএম আদালতে আনা হয়। প্রথমে তাদের রাখা হয় আদালতের হাজতখানায়। পরে তাদের আদালতে ওঠানো হয়।

আসামিদের দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় তিন বছরের কারা দণ্ড ও তিন হাজার টাকা করে জরিমানার আদেশ দেন আদালত। জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাস কারাভোগ করতে হবে।

দণ্ড-বিধির ৪৬৬ ধারায় চার বছরের কারাদণ্ড ও চার হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও চার মাস কারাভোগ করতে হবে। এছাড়া দণ্ড-বিধি ৪৭১ ধারায় চার বছরের কারা দণ্ড ও চার হাজার টাকা জরিমানার আদেশ দিয়েছেন আদালত। জরিমানা অনাদায়ে চার মাস কারাভোগ করতে হবে।  

অন্যদিকে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ড-বিধির ১৭০/২৬৯/৪০৬/৪৬৫ ধারায় অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। এ ধারাগুলোতে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের এ ধারাগুলোতে খালাস প্রদান করেন আদালত।

গত ২৯ জুন ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য ১৯ জুলাই দিন ধার্য করেন।

এর আগে গত ১১ মে ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে আসামিরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন।

গত ২০ এপ্রিল একই আদালতে সাক্ষ্য দেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোর্শেদ আল মামুন ভূঁইয়া। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্যগ্রহণ সমাপ্ত ঘোষণা করে। এ মামলায় এখন পর্যন্ত ৪০ সাক্ষীর মধ্যে ২৫ জন বিভিন্ন সময়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

মামলা সূত্রে জানা যায়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় করোনা শনাক্তের জন্য নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা না করেই জেকেজি হেলথকেয়ার ২৭ হাজার মানুষকে ভুয়া রিপোর্ট দেয়। এ অভিযোগে ২০২০ সালের ২৩ জুন অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করে দেয়া হয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলা করলে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়।

জানা যায়, করোনার ভুয়া রিপোর্ট দেয়ার মামলায় রায় ঘোষণার জন্য আদালতে তোলার পর মামলার আসামি জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারপার্সন ডাঃ সাবরিনা চৌধুরী বেশ স্বাভাবিক ছিলেন। তার এমন রায় হবে তিনি ভাবতেই পারেননি। তবে এজলাস কক্ষে সাবরিনা সারাক্ষণ দোয়া পড়ছিলেন। এর কিছুক্ষণ পরই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। এতে ডাঃ সাবরিনাসহ মামলার ৮ আসামির ১১ বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়।

সকাল সাড়ে আটটার দিকে সাবরিনাসহ অন্য আসামিদের কারাগার থেকে আদালতের এনে হাজতখানায় রাখা হয়। দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে আসামিদের এজলাশে তোলা হয়। গোলাপী রঙের শাড়ি পরা ডাঃ সাবরিনাকে কয়েকজন নারী পুলিশ এজলাসে নিয়ে যান। আসামির কাঠগড়ায় ঢোকানোমাত্র বসে পড়েন সাবরিনা। রায় পড়া শুরু হলে উঠে দাঁড়ান। রায় ঘোষণার সময় তাকে স্বাভাবিক দেখা গেলেও রায় শেষে তাকে কিছুটা বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। এ সময় তিনি আইনজীবী ও তার স্বামীর সঙ্গে কথা বলেন। পরে আবার তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

১১ বছরের কারাদণ্ড হওয়ার পর আদালত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ডাঃ সাবরিনা বলেছেন, “আমার আর কিছু বলার নেই। তবে এটাই জানি আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। একদিন মানুষ জানবে-আমি নির্দোষ ছিলাম। আমি নির্দোষ, কিন্তু দেশবাসী জানল আমি অপরাধী।“সমকাল

আরেক আসামি শফিকুল ইসলাম রোমিওকে আদালত থেকে বের হওয়ার সময় বলেন, আমরা কারও সঙ্গে প্রতারণা করি নাই। বরং আমরা প্রতারণার শিকার হয়েছি। সত্য একদিন বের হয়ে আসবে।

রোমিওর পরেই জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ডাঃ সাবরিনাকে আদালত থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় গণমাধ্যম কর্মীরা রায়ের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি স্বল্প কথায় জবাব দেন। এরপর পুলিশী কড়া নিরাপত্তা দিয়ে আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। রায় ঘোষণা শেষে আদালত থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার সময় আসামিদের মুখে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

গত বছরের ২০ আগস্ট ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সরাফুজ্জামান আনছারীর আদালত এ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। গত বছরের আগস্টে ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুলফিকার হায়াত মামলার চার্জশীট (অভিযোগপত্র) গ্রহণ করেন।

২০২০ সালের ৫ আগস্ট ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে ডাঃ সাবরিনা ও আরিফসহ আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করেন ডিবি পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলী। চার্জশীটে ডাঃ সাবরিনা ও আরিফকে ঘটনার হোতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিযোগপত্রে উল্লেখিত অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে হিমু, তানজিলা ও রোমিও দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন।

করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে জেকেজি হেলথকেয়ারের সিইও আরিফুল হক চৌধুরী ও চেয়ারম্যান ডাঃ সাবরিনা আরিফ চৌধুরীসহ আট আসামির ১১ বছর করে কারা দণ্ড-দেয়ার রায়ে ‘অসন্তোষ’ জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ।

রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এই মামলায় যে তিনটি ধারায় আদালত সাজা দিয়েছেন, রাষ্ট্রপক্ষ কোন ধারাই প্রমাণ করতে পারেন নাই। রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে যে কাগজপত্র দাখিল করেছেন তা শুধু ফটোকপি।

এ মামলায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত বাদী, তারাও আদালতে এসে তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলেন নাই বলেও দাবি করেন তিনি। আসামিপক্ষের এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘শুধু এই মামলাটি একটি আলোচিত-সমালোচিত মামলা বিধায় আসামিদের এই সাজা দেয়া হয়েছে। তবে আমরা উচ্চ আদালতে যাব, আপীল করব।’

নমুনা পরীক্ষা না করেই করোনার ভুয়া রিপোর্ট দেয়ার মামলায় আদালত ঘোষিত রায়ের কপি হাতে পেলে ডাঃ সাবরিনার চিকিৎসক নিবন্ধন বাতিল হতে পারে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)।

এক্ষেত্রে রায়ের কপি আসার পর নীতিনির্ধারকেরা আলোচনায় বসে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে আদালত থেকে সরাসরি কোন নির্দেশনা এলে আলোচনা ছাড়াই চিকিৎসক নিবন্ধন বাতিল হবে। মঙ্গলবার বিএমডিসির রেজিস্ট্রার আরমান হোসেন জানান, কোন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আদালতের রায় হলে তার নিবন্ধন বিষয়ে আমাদের আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসক নিবন্ধন বাতিল হয়ে থাকে।

তিনি আরও জানান, আমাদের কাছে এখনও রায়ের (ডাঃ সাবরিনার) কপি এসে পৌঁছায়নি। কোর্ট আমাদের এ বিষয়ে জানালে তখন আলোচনার প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে।