১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের ক্ষণ গণনা শুরু

0
310
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের ক্ষণ গণনা শুরু
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের ক্ষণ গণনা শুরু

অনেককেই বলতে শুনি–৪৫ বছর পরও এই দিনটি নিয়ে এতো আলোচনা, বক্তৃতা করার কী আছে ? দেশে এতো এতো সমস্যা আছে, সেগুলো নিয়ে তো এতো আলোচনা হয় না। সত্যিই কি তাই ?

ড. আব্দুল জব্বার খাঁনঃ লিখছি মূলত তরুণ প্রজন্মের জন্য। অনেককেই বলতে শুনি– ৪৫ বছর পরও এই দিনটি নিয়ে এতো আলোচনা, বক্তৃতা করার কী আছে ? দেশে এতো এতো সমস্যা আছে, সেগুলো নিয়ে তো এতো আলোচনা হয় না। সত্যিই কি তাই ? সারাবছরই কিন্তু আমরা অন্যান্য সমস্যা নিয়েই প্রাসঙ্গিক আলোচনায় ব্যস্ত থাকি, শুধু আগস্ট মাসেই বরং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে আলোচনা করা হয়।

’৭৫ এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুসহ ১৭ জনকে হত্যা করার পর থেকে বঙ্গবন্ধু নাম উচ্চারণ করাও এদেশে নিষিদ্ধ ছিল। আজ যেমন ৭ মার্চের ভাষণ আমরা প্রচার মাধ্যমগুলোতে বা পাড়ায়-মহল্লায় অবাধে শুনতে পাই, দেখতে পাই-সেটি ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর্যন্ত ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এই এতোকাল যখন ইতিহাসের এই অবিচ্ছেদ্য অংশকে জাতিসত্ত্বা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চেষ্টা করা হয়, প্রতি পদে পদে বিকৃত ইতিহাস উপস্থাপন করার অপচেষ্টা চালানো হয় এবং মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী ক্রমশ একটি ‘ব্ল্যাক আউট প্রজন্ম’ গড়ে তোলার ক্লান্তিহীন ষড়যন্ত্রমূলক প্রয়াস চলতেই থাকে– তখন এর জবাবটাও দিতে হয় শক্তভাবেই। অনেক বছরের অবদমিত আবেগ, অনুভুতি আর মিথ্যচারার জবাব তাই বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতই সবকিছু ভাসিয়ে দিতে চাইবে-এটাই স্বাভাবিক। সত্যগুলোকে জেনেও হজম করতে না পারার মানুষের সংখ্যা এখনো এদেশে অনেক আছে এবং সেকারণেই অপশক্তির অপপ্রচার যতদিন অব্যাহত থাকবে ১৫ আগস্ট নিয়ে আলোচনাও প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম চলতেই থাকবে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সময় আমার বয়স ছিল নয় বছর। যখন আমি ত্রিশ বছরের পরিপূর্ণ যুবক তখন আমার সাথের অনেকেই মূলধারার ইতিহাস জানার ব্যপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, ভুল ইতিহাস জেনেই বেড়ে ওঠে, বড় হয়, প্রতিষ্ঠিত হয়। আমি সেই ব্ল্যাক আউট প্রজন্মের একজন হয়েও সঠিক ইতিহাস জানতে বা বুঝতে চেষ্টা করেছি পারিবারিক সূত্রে, বই পড়ে, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ শুনে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ পড়ে। আসুন, এক এক করে জেনে নিই কীভাবে ভুল তথ্য এবং ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে একটি প্রজন্মকে নষ্ট পথে পরিচালনার চেষ্টা করা হয়েছেঃ

১) বাকশালি স্টাইলে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়েই বঙ্গবন্ধুকে প্রাণ দিতে হয়েছে– উচিত শিক্ষাই পেয়েছেন তিনি!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপ বিনির্মাণের জন্য আমেরিকা একটি সহায়তা তহবিল গঠন করে। ১৯৪৮ সালে গঠিত যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘মার্শাল প্ল্যান’-এর আকার ছিল ১২ বিলিয়ন ডলার। শুধু মানবিক কারণে এতো বড় আকারের তহবিল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে তখন দানছত্র খুলে বসেনি সেটি বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় কারুরই। ভবিষ্যতে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো যেন সমাজতন্ত্রের দিকে না ঝুঁকে এবং ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে আসে সেটিই ছিল তাদের মূল পরিকল্পনা।

১৬ ডিসেম্বর ৩০ লক্ষ শহীদ আর ২ লক্ষ বীরাঙ্গনার আত্মাহুতির মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ’ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জয় লাভ করে। এই বিজয়ের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ঘোষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে জাতির পিতার ঘোষণার মাধ্যমে যে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয় সেটি ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের মাধ্যমে বিজয়ী জাতির মর্যাদা লাভ করে। ইতিহাসে এধরণের নজির বিরল।

১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামোগত বিনির্মাণের পাশাপাশি, সংবিধান প্রণয়ন, প্রতিষ্ঠান স্থাপন, অর্থনীতির ভিত মজবুতকরণ – সব দিকেই নজর দেন। সেসময় দেশের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৯৩ ডলার আর প্রবৃদ্ধির হার ছিল (-) ১৪%। নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য পৃথিবীর কোনো জায়গা থেকে গঠিত হয়নি ‘মার্শাল প্ল্যান -২’। যুক্তরাষ্ট্র এধরণের মার্শাল প্ল্যান বাংলাদেশের জন্য গঠন করবে না – সেটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। কারণ, বাংলাদেশের বিজয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তখনকার বৈশ্বিক রাজনীতর প্রেক্ষাপটে মূলত চীন-পাকিস্তান-মার্কিন অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে বিজয় ছিল। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার পুরোধা তদানীন্তন সোভিয়েট ইউনিয়ন যদিও ভারতের সাথে মিত্রশক্তি হিসেবে বাংলাদেশের যুদ্ধে জয়লাভে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল, তারাও নিশ্চিত হতে চেষ্টা করছিল বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে ‘সমাজতন্ত্র’-কে অন্তর্ভুক্ত করলেও কার্যত তিনি কতটা সমাজতান্ত্রিক হবেন।

মার্শাল প্ল্যান নেই, অর্থনীতির ভিত মজবুত করা দরকার, সমাজতান্ত্রিক বলয়ের সাড়া কম, অভ্যন্তরীণ সম্পদ উৎপাদনের সক্ষমতা তৈরি হয়নি – এই বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর ডাক দেন। পার্লামেন্টে, জনসভায় তিনি বাস্তবতা তুলে ধরেন। অবশেষে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সর্ব সম্মতিক্রমে বঙ্গবন্ধু সংবিধানে ৪র্থ সংশোধনী আনেন – “রাষ্ট্রপতির নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে এই সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহের কোনো একটা পরিপূর্ণভাবে কার্যকর করিবার উদ্দেশ্যে অনুরূপ করা প্রয়োজন, তাহা হইলে তিনি, আদেশ দ্বারা, নির্দেশ দিতে পারিবেন যে রাষ্ট্রে শুধু একটা রাজনৈতিক দল (অতঃপর জাতীয় দল নামে অভিহিত) থাকিবে।” এরই আলোকে পরবর্তীতে বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) গঠিত হয় এবং সেখানে দেশের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ দেখা যায়, কারণ তখনকার বাস্তবতায় মানুষ এটিকে ‘মুক্তির সনদ’ হিসেবেই বিবেচনা করেছিল। এই বিপ্লবের মাধ্যমে ‘সমবায় ভিত্তিক’ সমাজ ব্যবস্থার দিকেই এগিয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, অনেকটাই সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার অন্যান্য দেশের আদলে। বাকশাল কনসেপ্টে সমবায় ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থার প্রস্তাবনা ছিল; যার ফলে কৃষক ফসলের ১ ভাগ, জমির মালিক ১ ভাগ এবং সমবায়তে ১ ভাগ! সম্পদের সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা ছিল, যেটি আজও আমাদের সকলের আরধ্য।

তিনি সারা দেশের ৫৪টি জেলার জন্য গভর্ণর নিয়োগও চূড়ান্ত করেছিলেন। যেদিন বঙ্গবন্ধুকে প্রায় সপরিবারে হত্যা করা হয়, সেই ১৫ আগস্টেই এই গভর্ণরদের শপথ নেয়ার কথা ছিল। কাজেই সমসাময়িক ইতিহাস বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে ৪র্থ সংশোধনী অনুযায়ী যে জাতীয় দল বাকশাল গঠন করা হয়েছিল, দেশ পরিচালনার কোনো সুযোগই সেই নেতৃত্ব কখনো পায়নি। বাকশাল কনসেপ্ট নিয়ে সমালোচনা থাকতেই পারে, সমালোচনা কমিউনিজম নিয়েও আছে, সোশালিজম নিয়েও আছে, ক্যাপিটেলিজম নিয়েও আছে। কোন দেশে কোন বাস্তবতায় কোন ‘মডেল’ উপযোগী হবে সেটি বোঝার জন্য কিছু সময় প্রয়োজন হয়। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব পরীক্ষিত হবার আগেই তাঁকে হত্যা করা হয়। হয়তোবা যারা হত্যা পরিকল্পনার সাথে জড়িত ছিল তারা আঁচ করতে পেরেছিল বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লব সফল হয়ে যেতে পারে। শীতল স্নায়ুযুদ্ধের সেই সময়ে হয়তো একপক্ষ এটি মেনে নিতে পারেনি। একদিকে পরাজয় আবার অন্যদিকে অন্য ঘরাণায় গিয়ে সাফল্য অর্জন – দুইই মেনে নেয়া নিশ্চিত ভাবেই অনেক কঠিন।

সবচে’ বড় কথা হলো কেবলমাত্র একটি কনসেপ্ট প্রবর্তনের শাস্তি হিসেবে এতোগুলো মানুষকে হত্যা করায় দেশের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের নিয়মটি মুখ থুবড়ে পড়লো। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম এদেশে বা এই উপমহাদেশে নতুনতো কিছু নয়। তাই, দেশের মানুষ যদি বাকশাল সিস্টেমকে এতোই অপছন্দ করতো তাহলে তারাই ক্রমশ এর বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করতো এবং এক সময় এই সিস্টেম বিলুপ্ত করতে বাধ্য হতো তখনকার সরকার। তার জন্য হয়তো পাঁচ বছর লাগতো, কিন্তু সেটি হতো গণতান্ত্রিক আন্দোলন, গণমানুষের আন্দোলন – সেনা সমর্থিত কোনো নৃশংস হত্যাকান্ড হতো না। জাতি হিসেবে সেটি আমাদের জন্য হতো অনেক বেশি গৌরবের। কাজেই যারা বাকশালের অভিযোগ এনে বঙ্গবন্ধুর এই নির্মম হত্যাকান্ডকে জায়েজ করতে চান তাদের উদ্দেশ্য অবশ্যই ভিন্ন কিছু।

২) বঙ্গবন্ধু নয়, মেজর জিয়াউর রহমানই ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক!

জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৬ষ্ঠ তফসিলের ১৫০ (২) অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত আছে– “ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যাহা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।“ সংবিধান মতে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার এই ঘোষণা দেন।

একই দিনে অর্থাৎ ২৬ মার্চ দুপুর ২:৩০ এ আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হয়ে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার এই ঘোষণা পাঠ করেন। এর পরদিন অর্থাৎ ২৭ মার্চে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বেলাল আহমেদের অনুরোধে মেজর জিয়াউর রহমান সন্ধ্যা ৭:৩০ এ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন এইভাবে “I, Major Ziaur Rahman, do hereby declare the independence of Bangladesh on behalf of our great national leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman.”

স্পষ্টতই আব্দুল হান্নান বা জিয়াউর রহমান দুজনেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। আব্দুল হান্নান পাঠ করেন ২৬ মার্চেই এবং জিয়াউর রহমান পাঠ করেন ২৭ মার্চে। লক্ষ্য করবেন, এ দুটির কোনোটিই আমাদের সংবিধানে স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অথচ বঙ্গবন্ধুর দল বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ২১ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে ছিল। এতোবড় সুযোগ তাহলে ওরা হাত ছাড়া করলো কেন? কারণ ইতিহাসের পরতে পরতে রয়েছে প্রমাণ। ১০ এপ্রিল তারিখে গঠিত মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন দেয়া হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কোনো গোঁজামিল নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকেই এসব গোঁজামিল সৃষ্টি করতে চেষ্টা করা হয়েছে।

সুপ্রিয় পাঠক, আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করবেন – আমাদের স্বাধীনতা দিবস কিন্তু ২৬ মার্চেই পালন করা হয়, ২৭ মার্চে নয়। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা পাঠ করেছিলেন ২৭ মার্চে। যদি সেটিই স্বাধীনতার ঘোষণা হতো তাহলে তো আমাদের স্বাধীনতা দিবসও ২৭ মার্চ হওয়া উচিত ছিল। সেটি বিএনপি বা বিএনপি-জামায়াত জোট এতোবার সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েও ঘোষণা করলো না কেন? হিসাব মেলে না, এই হিসাব মেলার কথাও নয়। আবার দেখুন, যে অর্থে জিয়াউর রহমানকে বিএনপি স্বাধীনতার ঘোষক বলে সেই একই কারণে কিন্তু তারা আব্দুল হান্নানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলতে নারাজ। হাস্যকর নয়?

তাহলে একটি সম্পুরক প্রশ্ন এসেই যায় – বিএনপি বা তাদের দোসররা কেন হঠাত তাদের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর জন্য এতো মরিয়া হয়ে উঠলো? এর কারণ হচ্ছে বিএনপির জন্ম স্বাধীনতার অনেক পর – ১৯৭৮ সালের ০১ সেপ্টেম্বরে একাধারে রাষ্ট্রপতি ও সামরিক শাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাত ধরে, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ তারিখের সাজানো সাধারণ নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা ছিল জেড ফোর্সের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর বিশালত্বের কাছে জিয়াউর রহমানকে অতি ক্ষুদ্র মনে হয় তাদের কাছে। তাই, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাদের অনেকেরই শখ হলো ইতিহাসের পাতাগুলোকে দুমড়ে মুচড়ে নিজেদের মত করে সাজিয়ে নেয়ার। মজার ব্যপার হলো জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকতে কিন্তু তিনি নিজেকে কখনো স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে দাবী করেননি। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে তাঁর নির্মম মৃত্যুর পর থেকে বিএনপি এই মাত্রাটি যোগ করে এবং আমাদের প্রজন্মকে যুগের পর যুগ ভুল তথ্য দিতে থাকে। কিন্তু জোর করে ইতিহাস সৃষ্টি করা যায় না।

একজন স্বাধীনতার ঘোষক হঠাত করে জন্মায় না। এর জন্য ৪৬৮২ দিন জেল খাটতে হয়, বাংলার পথে-প্রান্তরে হাঁটতে হয়, ১৮ বছর বয়সে রাজনীতিতে আসতে হয়, ৪৮-৭১ এর আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করতে হয়, পরিবারের চেয়ে দেশের মানুষকে বেশী ভালবাসতে জানতে হয় – তবেই একজন স্বাধীনতার স্থপতি, একজন ঘোষক, একজন বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়। কোনো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারির পক্ষে তা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। বাস্তবতা আর আবেগ এক জিনিস নয়।

৩) আওয়ামী লীগের লোকজনই বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত, তাই তারা আসলে এই হত্যাকান্ডের বিচার চায় না!

একদিক থেকে এই কথায় সত্যতা আছে। কারণ খন্দকার মোশতাক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার মন্ত্রী, দলের লোক। বঙ্গবন্ধু ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনিনি যে এই মোশতাক হচ্ছে ট্রোজান হর্সের পেটের ভেতরে লুকিয়ে থাকা স্পার্টান। কিন্তু এই কথার বিপরীতে অনেক পাল্টা কথা এসে যায়। আওয়ামী লীগের লোকজনই যেহেতু এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত সেহেতু জিয়াউর রহমান তাঁর নবগঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নিয়ে সরকার গঠনের পর পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশনেই কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি এক্ট’ আমাদের মহান সংবিধানে ৫ম সংশোধনী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করলো কেন?

এই সংশোধনীতে পরিষ্কার বলা হলো “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হইতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যে প্রণীত সকল ফরমান, ফরমান আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আদেশ ………………, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ বৈধভাবে প্রণীত, কৃত ও গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল, এবং তৎসম্পর্কে কোন আদালত, ট্রাইবুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোনো কারণেই কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।“

এই আইনের অর্থ দাঁড়ালো এরকম যে শুধু ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার নয়, ০৩ নভেম্বরে জাতীয় চার নেতার হত্যার বিচার, খালেদ মোশাররফ হত্যার বিচার, কর্ণেল তাহের হত্যার বিচার, সেনা ক্যুতে নিহত হাজার হাজার সামরিক সদস্যদের বিচার বহির্ভূত হত্যার বিচার – কোনো কিছুর ব্যপারেই বিচার চাওয়াতো দূরস্থ, মামলা পর্যন্ত করা যাবে না! এর চেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের উদাহরণ পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যাবে না। স্পষ্টতই, বিএনপি সরকার সেই সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জড়িত আওয়ামী লীগের লোকজনকে রক্ষা করার জন্য এই ইনডেমনিটি আইন সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেনি। তারাতো বরং সবসময়ই আওয়ামী লীগের বিনাশই চাইবার কথা – ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা তো সেই সাক্ষ্যই বহন করে।

অতএব সম্পুরক প্রশ্ন এসেই যায়, তাহলে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার (তাদের প্রথম সরকার) কাদের রক্ষা করার জন্য এরকম ন্যাক্কারজনক কাজটি করতে গেলো? উত্তর খুব সহজ – হয় নিজেদের রক্ষা করার জন্য নয় হত্যাকারীদের মদদে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। এছাড়া তো আর অন্য কোনো ব্যখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না।

৪) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বা জাতির পিতা – কোনোটিই নয়!

গত সাধারণ নির্বাচনের কিছুদিন আগে লন্ডন থেকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক জিয়া এক ভিডিও বার্তায় এধরণের কথা বলে হৈচৈ ফেলে দেন। এসব কথা যত বেশি বলা হবে ততই নিজেদের রাজনৈতিক অজ্ঞতাই প্রকাশ পাবে। বিষয়টি সামনে এনে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে মূলত আরেক দফা বিভ্রান্তিতে ফেলা হয়েছে।

এর প্রথম অংশের উত্তর খুঁজতে হলে আপনাকে চলে যেতে হবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের সপ্তম তফশিলের ১৫০(২) অনুচ্ছেদে। এখানে সন্নিবেশিত আছে ‘১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল তারিখে মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’। এই ঘোষণাপত্রে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে -“সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি থাকিবেন।“ উল্লেখ্য, মুজিবনগর সরকারই বাংলাদেশের প্রথম সরকার এবং এই সরকারের অধীনেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। এই সরকারে যারা ছিলেন তাঁরা সকলেই ’৭০ এর নির্বাচনে বিজয়ী জনপ্রতিনিধি। সেই ম্যান্ডেটই তাঁদেরকে এই সরকার গঠনের বৈধতা দেয়। অতএব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-ই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এনিয়ে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই।

‘জাতির পিতা’ সংক্রান্ত মিথ্যাচারের উত্তর আপনি পেয়ে যাবেন সংবিধানের ৪(ক) অনুচ্ছেদে। এখানে বলা আছে – “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার ও প্রধান বিচারপতির কার্যালয় এবং সকল সরকারী ও আধা-সরকারী অফিস, স্বায়তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সরকারী কর্তৃপক্ষের প্রধান ও শাখাকার্যালয়, সরকারী ও বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনসমূহে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করিতে হইবে“।

৪(ক) অনুচ্ছেদটি দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে একদিকে যেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি তাঁর প্রতিকৃতি সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের বিষয়েও সুস্পষ্ট বিধান সুনিশ্চিত করা হয়েছে। অর্থাৎ, সরকার পরিচালনার দায়িত্বে যারাই থাকুক না কেন বঙ্গবন্ধুই জাতির পিতা থাকবেন এবং তাঁর প্রতিকৃতি যথাযথ সম্মানের সাথেই প্রদর্শন করতে হবে। সংবিধানের ৭(খ) অনুচ্ছেদে প্রথম ভাগে বর্ণিত এই সকল অনুচ্ছেদের সংশোধন অযোগ্য বলেও উল্লিখিত আছে। অতএব, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর দীর্ঘ ২১ বছর ক্ষমতার পালাবাদলে যারা ক্ষমতায় ছিলেন তাঁরা জাতির পিতার প্রতিকৃতি দপ্তরসমূহে প্রদর্শন না করে মূলত সংবিধান লংঘন করেছেন এবং পরবর্তী প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করেছেন।

৫) আমরা বাঙালী নয়, বাংলাদেশী!

এই বিষয়টিও আমাদের সংবিধানে সুস্পষ্ট করা হয়েছে ৬(২) অনুচ্ছেদে। এতে বলা আছে – “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া বিবেচিত হইবেন” (The people of Bangladesh shall be known as Bangalees as a nation and the citizens of Bangladesh shall be known as Bangladeshies)। স্পষ্টতই, সংবিধানে জাতীয়তা (nationality) এবং নাগরিকত্ব (citizenship) বিষয় দুটোকে আলাদা করা হয়েছে।

৬) আমাদের বুদ্ধিজীবিরা ছিলেন বেঈমান!

কথাগুলো সম্প্রতি আমরা বিএনপির একজন শীর্ষ রাজনৈতিক নেতার কাছ থেকে শুনেছি। তিনি ১৪ ডিসেম্বরে নিহত বুদ্ধিজীবিদের ‘বেঈমান’ বলেছেন এজন্য যে তাঁরা নাকি পাকিস্তান সরকারের বেতন খেয়ে সেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধাচারণ করেছেন মৃত্যুর দিন পর্যন্ত! এ কথাগুলোর দাঁতভাঙ্গা জবাব না দিয়ে পারা যায় না। কারণ এগুলোর সাথে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে। সুপ্রিয় পাঠক, লক্ষ্য করবেন – আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণা হয়েছিল ১৯৭১ এর ২৬ মার্চে অর্থাৎ তখন থেকেই বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্রের সূচনা। আমাদের স্বাধীনতা দিবসও তাই ২৬ মার্চ। সেদিন থেকে যারা বাংলাদেশের ভূখন্ডে ছিলেন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছে তাঁরা সবাই এদেশের নাগরিক। অতএব সেদিন থেকে মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত এদেশের প্রতিটি নাগরিক তাঁদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি যা কিছু পেয়েছেন সবই পেয়েছে্ন বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে, পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের সরকারের কাছ থেকে নয়। যারা আজও এসব কথা বলেন তারা মূলত আমাদের স্বাধীনতা দিবস এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়ের মধ্যে পার্থক্য সজ্ঞানেই বুঝতে চান না এবং অন্যদের বিভ্রান্ত করেন। যারা স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধকেই ঠিকভাবে ধারণ করতে পারেন না তারাই আবার সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেতে চান কীভাবে – বুঝতে পারি না।

সুপ্রিয় প্রজন্ম, বাংলাদেশ বিরোধীরা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীরা একই সূত্রে গাঁথা। এরা কখনই থেমে থাকেনি, এখনো থেমে নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে অদ্যাবধি এরা বারবারই ইতিহাস বা মহান সংবিধানের মীমাংসিত বিষয়গুলোকে সামনে টেনে এনে খোঁড়া যুক্তির মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করেছে– উদ্দেশ্য, স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের দলিল বিস্মৃত একটি জেনারেশন তৈরি করা এবং সম্ভব হলে তাদের আজন্ম লালিত ‘চাঁদ তারা মার্কা’ পতাকা ফিরিয়ে আনা। যতদিন এই অপশক্তিওগুলো সক্রিয় থাকবে ততদিন ১৫ আগস্টের আলোচনায় অগ্রজদের এগুলো তুলে ধরতেই হবে। এই আলোচনাগুলো তাই কালোত্তীর্ণভাবেই প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে।

লেখকঃ সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশন