হাওরে বৈশাখীর নিরাপত্তা কে দেবে ?

    0
    270

    “হাওরের সাথে সম্পর্কহীন বা হাওরের উজান-ভাটির অংক বুঝতে না পারা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের চাপিয়ে দেয়া এমনতর দশাসই সব উন্নয়ন চিন্তাই হাওরকে প্রতিবছর তলিয়ে দেয়”

    আমার সিলেট টুয়েন্টি ফোর ডটকম,১৬এপ্রিল,পাভেল পার্থঃদেশজুড়ে হরেক রকম ভাবে প্রায় সকলেই বাংলা বছর বিদায় দিয়েছে, স্বাগত জানিয়েছে নতুন বছর। চৈত্রসংক্রান্তি থেকে পহেলা বৈশাখ এবার গ্রাম থেকে শহরের রাস্তায় জমেছে শোভাযাত্রা। চাকমারা ফুল বিজু করেছে, মূল বিজু করেছে এবং গয্যাপয্যাও শেষ করেছে। ত্রিপুরারা বৈসুক, মারমারা সাংগ্রাই, রাখাইনরা সাংগ্রেং, ¤্রােরা চানক্রান, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা বিষু, সাঁওতালরা নেওয়া সেরমা পালন করেছে।

    হয়তো কম, হয়তো মাঝারি, কোথাও হয়তো একটু ভালই আয়োজন। কিন্তু হাওরা লে এবার জমেনি সংক্রান্তি কী বর্ষবরণ। পালনীয় কিছু কৃত্য আচার করেছেন পরিবারের প্রবীণ নারীরা। যেন চৈত্রসংক্রান্তি বিদায় নেয়নি এবার হাওরে। চইত বিষুর টান লাগেনি ভাটির জলে। বেগুন পাতার বর্তও করেনি অনেকে। চড়কের মাগনের দল ঘুরেছে ডুবন্ত জনপদে। খুব বেশি মেলেনি চাল-ডাল। সবই করেছে হওরবাসী।

    হিরাল এসেছে ফাল্গুন মাসেই। বজ্রপাত থেকে বোরো মওসুমের ধান জমিন রক্ষায় হিরালেরা মন্ত্র দিয়ে অনেক হাওর বন্ধন করেছে। নারীরা গোবর-জলে লেপে মুছে কাটা ধান মাড়াই, ঝাড়াই ও শুকানোর জায়গা ‘খলা’ তৈরি করে রেখেছে। ঘরে ঘরে ধান রাখার ডোল ও মটকা শুকিয়ে রেখেছে বাড়ির বৌ-ঝিরা। কিন্তু ‘পাহাইড়্যা ঢলের’ এক ধাক্কায় সব তলিয়ে গেছে। ধান জমিন থেকে ধানের খলা সব। চইত পরবে বেগুন পাতার বর্ত করবার একটা বেগুন গাছও পাওয়া যায়নি অনেক জায়গায়। চৈত্রসংক্রান্তিতে হাওরে তিতা খাওয়ার নিয়ম। ঘৃতিকা ন, ঠুনিমানকনি, গিমাই, দন্ডকলসের মতো সব শাকগুল্মই পানির তলায় ডুবে আছে।

    হাওর অ লে ধান ঋতু মূলত একটাই। বোরো মওসুম। চৈত্র মাসে ধান কাটা শেষ হয়, বৈশাখ থেকে জৈষ্ঠ্য জুড়ে চলে ধানের কারবার। চৈত্র থেকে জৈষ্ঠ্য এ সময় জুড়ে হাওর এলাকাা প্রধান কর্মউৎসবের নাম ‘বৈশাখী’। বৈশাখীতে ঘরে তোলা ধান বেঁচেই বছরের খোরাক এবং নানা দেনা-পাওনা শোধ করতে হয়। কৃষিমজুরের বেতন থেকে শুরু করে রাখালের মজুরি। নৌকা খেয়াঘাটের বছরভর যাতায়াতের খরচ কী হিরালের পাওনা সব শোধ করতে হয়।

    এবার সবই তল হয়েছে। দেখার হাওর, শনির হাওর, মাটিয়ান হাওর, নলুয়ার হাওর, সজনার হাইর, হাইল হাওর, হাকালুকি হাওর, কাউয়াদীঘি হাওর, ঘুইঙ্গাজুড়ি হাওর, জালিয়ার হাওর, বাওরবাগ, খরচার হাওর, পাথরচাউলি বা চেপটির হাওরের মত দেশের শত শত হাওরের আদি বৈশিষ্ট্যের সব জমিন আজ পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে।

    বাংলাদেশকে যদি ছয় ভাগ করা হয়, তার এক ভাগই হাওর জনপদ। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোণা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এই সাতটি প্রশাসনিক জেলায় বিস্তৃত দেশের হাওরভূমি এক দু:সহ মরণযন্ত্রণা পাড়ি দিচ্ছে। রাষ্ট্র বরাবরই হাওরকে এড়িয়ে চলে, হাওরের যন্ত্রণাকে আড়াল করে চলে।

    লাগাতার রাষ্ট্রীয় অবহেলা, অন্যায় আর অনাচারের ভেতরেই জেগে থাকে হাওর। দেশকে জোগায় ধান আর মাছ, দুনিয়াকে উপহার দেয় গান। চৈত্র-বৈশাখে অবিরত বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলের পানিতে হাওরের তলিয়ে যাওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। এটি ঐতিহাসিক এবং সুরাহাহীন ভাবেই ঘটে চলেছে। হাওরের টিকে থাকা সংগ্রামের রসদ ও বিজ্ঞান কেউ হাওরবাসীকে দান করেনি বা বাড়ায়নি কোনো সহযোগিতার হাত।

    হাওরের বিশেষ বাস্তুসংস্থানই হাওরবাসীকে এই অ লে টিকে থাকবার সংগ্রামে প্রতিদিন নতুনভাবে প্রস্তুত করে তুলে। রাষ্ট্র এই প্রস্তুতির দিকে ফিরেও তাকায় না। সব কিছু ডুবে তলিয়ে গেলে সরকার কিছু উফশী ধানের সিদ্ধ চালের বস্তা নিয়ে আসে। কখনো ঘর তোলার জন্য কয়েক বান্ডিল ঢেউ টিন। এর বেশি কিছু না। হাওরের উন্নয়ন বলতে রাষ্ট্র এখনো বুঝে ডুবন্ত রাস্তা, ফসল রক্ষা বাঁধ আর বাণিজ্যিক মাছ চাষর জন্য বিল জলাভূমির ইজারাকে।

    আর এ নিয়েই বছরভর লেগে থাকে স্থানীয় থেকে জাতীয় জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের ভেতর ভাগ-বাটোয়ারার দরবার, কোন্দল আর দুর্নীতি। হাওরের উজান-ভাটির শর্তকে কেউই মান্য করে না। হাওরের সুরক্ষাপ্রশ্নটি কোনোভাবেই বাঁধ, ইজারা আর অবকাঠামোর সাথে জড়িত নয়। সংকটের মূল জায়গাটি এখানেই।

    হাওরের সাথে সম্পর্কহীন বা হাওরের উজান-ভাটির অংক বুঝতে না পারা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের চাপিয়ে দেয়া এমনতর দশাসইসব উন্নয়নচিন্তাই হাওরকে প্রতিবছর তলিয়ে দেয়। ডুবিয়ে মারে। বাঁধ দিয়ে কী কোনোভাবে একটি জলজ বাস্তুসংস্থানের সুরক্ষা হয়? শনির হাওরের জন্য বাঁধ দিলে মাটিয়ান হাওর ডুবে মরে। হাকালুকির উত্তরে বান দিলে দক্ষিণে নিদান শুরু হয়। হাওরের সুরক্ষাকে রঙবেরঙের উন্নয়নের রোদচশমা চোখে দিয়ে নয়, দেখতে হবে হাওরের চোখেই। হাওরবাসীর উজান-ভাটির অংক থেকেই।

    হাওরা লগুলো ভাটিতে অবস্থিত। উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি অ ল গুলো হলো হাওরের সাপেক্ষে উজান অ ল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জ ছাড়া দেশের অন্যান্য অ লের প্রায় হাওরগুলোই উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয়, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের কাছাকাছি। উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি উজানে জন্ম নিয়েছে শত সহস্র পাহাড়ি ঝর্ণা ও ছড়া। এই পাহাড়ি জলধারাই বাংলাদেশের হাওরা লের নদ-নদীগুলোর উৎসস্থল। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি ও বাংলাদেশের মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল দুনিয়ার দুই বৃষ্টিপ্রবণ অ ল হাওরা লেই অবস্থিত। চৈত্র-বৈশাখের বর্ষণের ঢল উত্তর-পূর্ব ভারতের উজানের পাহাড় থেকে বাংলাদেশের ভাটির হাওরের নেমে আসে বলেই এই ঢল ‘পাহাইড়্যা পানি বা পাহাড়ি ঢল’ নামে পরিচিত। আর পাহাড়ি ঢলেই আজ তলিয়ে যাচ্ছে ভাটির হাওর।

    পাহাড়ি ঢলের ফলে তৈরি প্লাবিত এই অসনীয় অবস্থাকে হাওরের অভিধানে বলে ‘আফাল’। কালবৈশাখী ঝড় আর বাতাসের গতি আটকে পড়া পাহাড়ি ঢলের পানিতে ‘আফরমারা’ তীব্র ঢেউ তৈরি করে, যা আফাল অবস্থাকে আরো জটিল ও দু:সহ করে তুলে। পাহাড়ি ঢল থেকে হাওরের সুরক্ষায় অবশ্যই আফাল ও আফরমারাকে বুঝতে হবে। হাওরের সাথে উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ের সম্পর্কটি ঐতিহাসিক। মৈমনসিংহ গীতিকা ও সিলেটি বারোমাসীর মতো হাওরের প্রাচীন দলিল গুলোতে এর সত্যতা মেলে। উজানের পাহাড় থেকে জল গড়িয়ে নামতো ভাটির হাওরে।

    এ যেন নাইওরী আসা, জলের নাইওরী। পুরো বর্ষাকাল এই জল নাইওরী কাটিয়ে নানান নদীর প্রবাহে চলে যেত সমুদ্রে। পাহাড় থেকে সমুদ্র, জলপ্রবাহের এই দীর্ঘ পরিভ্রমণে হাওরা ল পেত বৈশাখী জলের এক বিশেষ স্পর্শ। এই স্পর্শে কোনো আঘাত, যন্ত্রণা বা তলিয়ে যাওয়ার ছল ছিল না। বরং ওই জলে জীবনের টান ছিল। রাধারমণ থেকে শাহ আবদুল করিম কেউই এই জলের টান অস্বীকার করতে পারেননি।

    আর তাই এখনো সেই টান জাগিয়ে রাখেন ভাটির নারীরা ধামাইল গানের নাচে, …জলে গিয়অছিলাম সই, জলে গিয়াছিলাম সই, কালা কাজলের পাখি দেইখ্যা আইলাম অই। রাধারমণের এই ধামাইল গীতে দেখা যায়, জলে গিয়ে কাল কাজলের পাখির সাথে সাক্ষাৎ করে আবার ফিরে আসা যায়। কিন্তু এখন যায় না। এখন কালা কাজলের পাখিসহ প্রেমিক দর্শনার্থী নিজেও দুম করেই পাহাড়ি ঢলের তলায় হারিয়ে যায়। ডুবে ভেসে যায়।

    কেবল উত্তর-পূর্ব ভারতের উজান অঞ্চল নয়, ভাটির বাংলাদেশও সবগুলো হাওর ধনী ও প্রভাবশালীদের ইজারা দিয়ে হাওরকে বানিয়ে রেখেছে বাণিজ্যিক মৎস্য খামার। যে পাহাড়ি বালি হাওরের জন্য আজ অন্যতম প্রধান সমস্যা সেই পাহাড়ি বালি পাথর বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে একদল মুনাফাখোর। এই জল ও বালিমহাল ইজারাদার কী দখলদারেরাই হাওরের অর্থনীতি থেকে আজ রাজনীতিও নিয়ন্ত্রণ করছে। এরা মনে প্রাণে চায় মেঘালয় পাহাড় ভেঙে হাওর ভরাট হয়ে যাক এবং বছর বছর তলিয়ে যাক।

    উজানের খনি ব্যবসায়ী ও ভাটির ইজারাদারেরা মূলত একই নয়াউদারবাদী করপোরেট মনস্তত্ত্ব ধারণ করে। ভাটির বাংলাদেশে হাওর ইজারা নিয়ে প্রাকৃতিক জলাভূমিতে আগ্রাসি হাইব্রিড বিপদজনক মাছদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। হাওরের নানা জায়গায় বান দিয়ে জলতরঙ্গ আটকে দেয়া হয়েছে। হাওরের নদী ও প্রবাহগুলোকে আটকে দেয়া হয়েছে। মানে হাওরের উজান ও ভাটি আজ সব খানেই সব দিকে থেকে বন্ধ, শৃংখলিত ও আবদ্ধ।

    তাহলে কী বৃষ্টি হবে না? পানির ধর্ম বদলে যাবে? পানি তো উজান থকে ভাটিতে গড়াবেই। তাহলে উজান থেকে ভাটিতে বৃষ্টির ঢলকে গড়িয়ে যাওয়ার পথ গুলো বারবার বন্ধ করে যে উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা বারবার করা হচ্ছে তা কোনোভাবেই হাওরের সুরক্ষা দিতে পারেনি। চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। হাওরের এই উজান-ভাটির অংকটি সচল রাখার দাবি কোনোভাবেই আজকের নতুন নয়, ভাসান পানির আন্দোলনেরও আগ থেকে হাওরবাসী এই দাবি করে আসছেন। কিন্তু রাষ্ট্র এটি কোনোভাবেই কানে তুলছে না। রাষ্ট্র হাওরকে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে ছেড়ে দিয়েছে।

    নয়াউদারবাদী মুনাফার ময়দানে জিম্মি হয়ে আছে হাওর। পাহাড়ি ঢলে হাওরের এই তলিয়ে যাওয়া বিষয়টি পুরোপুরো একটি আন্ত:রাষ্ট্রিক সংকট। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ অংশগ্রহণের ভেতর দিয়েই এক বহুপক্ষীয় জলাভূমি ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণের ভেতর দিয়েই কেবল এর সুরাহা সম্ভব। তা না হলে হয়তো আবারো হাওরে বৈশাখীর প্রস্তুতি নিবে সংগ্রামী মানুষ, আবারো হয়তো চৈত্রের ঢলে তলিয়ে যাবে হাওর। হাওরের বৈশাখীর নিরাপত্তা তাহলে কে দেব?

    গবেষক, পরিবেশ ও প্রাণিবৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ক লেখক।