হত্যাকান্ডঃনড়াইলে ৪মাস ধরে বাড়ি ছাড়া শতাধিক পরিবার

    0
    263

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,১৭সেপ্টেম্বর,নড়াইল প্রতিনিধিঃ নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পেড়লী গ্রামে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একটি হত্যাকান্ডের ঘটনায়  ৪ মাস ধরে বাড়ি ছাড়া শতাধিক পরিবার। এ হত্যাকান্ডের ঘটনার পর প্রতিপক্ষের লোকজন এসব পরিবারের বসত ঘর থেকে শুরু করে রান্নাঘর, গোয়ালঘর  ভেঙ্গেচুরে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভয় ও আতঙ্কে স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় যেতে পারছে না বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। বন্ধ রয়েছে লেখাপড়া।

    পুরুষ শুন্য ঐসব বাড়ী গুলিতে শিশু ও নারীরা দিনের বেলা বাড়িতে আসলেও রাতের বেলা থাকতে পারছেন না।  এই সব পরিবারগুলি  ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার আনন্দ-উৎসব থেকেও বি ত হয়েছেন। এছাড়া  এই ৪ মাস ধরে বাড়িঘরে লুটপাট চলছে বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্থরা।

    গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাতেও পেড়লী গ্রামের মিঠু শিকদারের বাড়িতে লুটপাট হয়েছে। দুর্বৃত্তরা তালা ও গ্রিল ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করে রঙিন টেলিভিশন, বক্সখাট, কম্বল, হাড়ি-পাতিল, গ্যাসচুলা, স্বর্ণের কানের দুল, গলার হার, আংটিসহ প্রায় আড়াই লাখ টাকার মালামাল নিয়ে গেছে জানিয়েছেন মিঠু শিকদারের আত্মীয়-স্বজনেরা।  গত চার মাসে অন্তত ৫০টি বাড়িতে লুটপাট করা হয়েছে।

    জানা যায়, ইউনিয়ন নির্বাচন (ইউপি) পরবর্তী সহিংসতার জের ধরে ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ২৫ মে আওয়ামী লীগের দুইপক্ষের সংঘর্ষে কালিয়া উপজেলা আ’লীগের সহ-সভাপতি পেড়লী গ্রামের মোফাজ্জেল হোসেন (৫০) নিহত হন। এদিকে, মোফাজ্জেল হত্যাকান্ডের দু’দিন পর ২৭ মে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আহত আ’লীগ নেতা (ওয়ার্ড আ’লীগের সহ-সভাপতি) পেড়লী গ্রামের বদরুল ইসলাম (৫১)। বদরুল মোফাজ্জেল গ্রুপের প্রতিপক্ষের লোক ছিলেন। এর আগে ২৩ মে পেড়লী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নিহত মোফাজ্জেল হোসেন চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী  আ’লীগ বিদ্রোহী প্রার্থী জারজিদ মোল্যার সমর্থক ছিলেন। এখানে আ’লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী জাহাঙ্গীর হোসেন ইকবাল পরাজিত হন। মোফাজ্জেল হত্যাকান্ডের পর পেড়লী গ্রামে প্রতিপক্ষের অন্তত ৫০টি বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পাঁকা দালান ঘর ও টিনের ঘরগুলো ভেঙ্গে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে।

    এছাড়া দেড় হাজার মণ ধানসহ বিভিন্ন ফসল, শতাধিক গরু লুটপাট এবং শিক্ষার্থীদের বইখাতাসহ শিক্ষা উপকরণ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এ ঘটনায় প্রায় ২ কোটি টাকার সম্পদ খোয়া গেছে বলে জানিয়েছেন পেড়লী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম বাবুসহ ক্ষতিগ্রস্থরা।

    ঘটনার প্রায় চার মাস পর গতকাল শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বিকেলে পেড়লী গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ বাড়িঘর ও আসবাবপত্রের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। এতোদিনেও স্বাভাবিক হতে পারেননি ক্ষতিগ্রস্থরা। ফিরতে পারছেন না বাড়িতেও। বিশেষ করে পুরুষেরা বাড়ি ছাড়া। পেড়লী গ্রামের কিবরিয়া মোল্যার স্ত্রী হেলেনা বেগম বলেন, বাড়িঘর ভেঙ্গেচুরে ও কেটে ফেলেছে প্রতিপক্ষরা। প্রতিপক্ষের ভয় ও আতঙ্কে একদন্ড কেউ বাড়িতে দাঁড়াতে পারে না। আমরা চার মাস ধরে বাড়িছাড়া। সাংবাদিকদের আগমনের বিষয়টি জানতে পেরে বাড়িতে এসেছি। আপনারা (সাংবাদিক) চলে গেলে, আবার বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র যেতে হবে। জেসমিন খানম বলেন, আমার এক ছেলে কলেজে (এইচএসসি) এবং আরেক ছেলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। কিন্তু, প্রতিপক্ষের হামলা-মামলার ভয়ে চারমাস ধরে স্কুল, কলেজে যেতে পারছে না আমার দুই ছেলে। পড়ালেখা বন্ধ রয়েছে তাদের। রেজাউল মোল্যার স্ত্রী হেমেলা জানান, তার ছেলে এ বছর এসএসসি পরীক্ষার্থী। কিন্তু বাড়িঘরে থাকতে না পারায় পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারছে না। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে কিনা সংশয় রয়েছে। প্রতিপক্ষের ভয়ে তার স্বামী ও ছেলে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।

    এছাড়া তাদের পরিবারের ধানসহ সব লুট করে নিয়ে গেছে মোফাজ্জেল সমর্থকরা। তিনি বলেন, আমাদের অর্থ-জমিজমা থাকা সত্ত্বেও লুটপাট করে নিয়ে যাওয়ায় আমি এখন পরের বাড়িতে থাকি এবং খাই। সাকিরা বেগম বলেন, জানালা, দরজা, বাথরুম ভেঙ্গে ফেলেছে; এমনকি ঘরের চালা পর্যন্ত নেই। এছাড়া হাঁস-মুরগিসহ গবাদি পশু লুট করে নিয়ে গেছে। এখানে কীভাবে থাকব, কীভাবে বাঁচব? ক্ষতিগ্রস্থরা জানান, মোফাজ্জেল হত্যা মামলায় ৩২জনকে আসামি করা হলেও প্রতিপক্ষের ভয়ে তাদের ২ শতাধিক লোক বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। রেবেকাসহ পেড়লী গ্রামের নির্যাতিত নারীরা জানান, বাড়িঘর ও আসবাবপত্র ভাংচুরের পাশাপাশি টিউবওয়েল, থালাবাটি, জগ, মগ, গ্লাসসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভেঙ্গেচুরে শেষ করে দিয়েছে। দিন-রাত কোনো সময় বাড়ি থাকতে দিচ্ছে না। মোফাজ্জেল সমর্থকদের অত্যাচার আর নির্যাতনে তারা অতিষ্ঠ।

    মোল্যা শহিদুল ইসলাম জানান, শনিবার সাংবাদিকরা পেড়লী গ্রামের ক্ষতিগ্রস্থ বাড়িঘর দেখে আসার পর প্রতিপক্ষের লোকজন আরো সহিংস হয়ে উঠেছে। পুরুষদের বাড়ি না পেয়ে, নারীদের বিভিন্ন ধরণের হুমকি দিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে এলাকার সচেতনমহল বলেন, পেড়লী গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য পুলিশের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে। অশান্ত পেড়লীকে বসবাস যোগ্য করে তোলার জন্য সবার আন্তরিকতা ও সহযোগিতা প্রয়োজন।

    পেড়লী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এটিএম তসরিফুজ্জামান বলেন, বর্তমানে এলাকার পরিন্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। হত্যাকান্ডের পর যেসব বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছিল, সেই অবস্থায় রয়েছে। নতুন করে কোনো বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট হয়নি। এছাড়া আসামিরা জামিনে এসে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন।

    পেড়লী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জারজিদ মোল্যা দাবি করে বলেন, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পেড়লী গ্রামে দুইপক্ষের সংঘর্ষে মোফাজ্জেল হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তবে, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইউনিয়নের কোথাও কোনো বাড়ি ভাংচুরের ঘটনা ঘটেনি। এলাকার পরিবেশ স্বাভাবিক রয়েছে।