স্মৃতিচারণঃঢাকা আলিয়ার হাদীসের শায়খ মাওলানা ফখরুদ্দীন

    0
    277
    অসাধারণ শিক্ষক- ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার হাদীসের শায়খ মাওলানা ফখরুদ্দীন (র) ‘র স্মৃতিচারণ

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,০৫ফেব্রুয়ারী,ডঃ আবুল কালাম আজাদঃ ফাজিল পরীক্ষার রেজাল্টের পর সিদ্ধান্ত নিলাম মিল্লাতেই কামিল পড়ব। আমরা হব মিল্লাতের প্রথম ব্যাচের কামিল। দূর্বাটি আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ জনাব মরহুম মাওলানা আব্দুস সালাম সাহেবের সাথে বুখারীর প্রথম সবকও নিলাম।

    ছুটিতে বাড়ি গেলাম- যশোরে। ফিরে এসে পুরাদমে ক্লাস শুরু হবে। কিন্তু সব কিছু ওলোট-পালট হয়ে গেলো। বাড়ি থেকে ফিরে এসে প্রথমেই এলাম বুয়েটের তিতুমীর হলে আমার সেজো ভাইয়ের ওখানে। এরপর কি কারণে গেলাম ঢাকা আলিয়ার হলে বর্তমান যশোরের লাউড়ি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মুফিজ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে। সেখানে গিয়ে পেলাম আমার মিল্লাতের ক্লাস মেট ও অন্তরঙ আব্দুস সালাম আজাদীকে।
    আজাদীকে সেই কাল থেকেই চাচা বলে ডাকি। সালাম চাচা বলি। সালাম চাচা বললো- চাচা, মিল্লাতে তো আর পড়া হচ্ছে না।
    আমি বললাম- সর্বনাশ ! কেনো? কি হলো?
    সে বললো- আমি তো ঢাকা আলিয়াতে ভর্তি হয়েছি। আর তোমার জন্যেও একটা ফরম নিয়ে রেখেছি।
    আমি তো একেবারেই অপ্রস্তুত। আমি হঠাৎ করে এতো বড় সিদ্ধান্ত?
    সে বলল- ঢাকা আলিয়াতে বড় বড় মুহাদ্দিস আছেন। এর মধ্যে একজন হলেন মাওলানা ফখরুদ্দীন। খুবই ভালো শিক্ষক। তাছাড়া আছেন- মুকাদ্দাস আলী হুজুর, আব্দুর রহীম হুজুর, ওয়াজিউল্লাহ হুজুর। আমি ইস্তেখারা করেছি। ইস্তেখারাতে ঢাকা আলিয়া পড়ার ব্যাপারে ইশারা পেয়েছি।
    আমি মুফিজ ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করলাম। উনিও ঢাকা আলিয়াতে পড়ার ব্যাপারে পরামর্শ দিলেন। পরামর্শ দিলেই তো হবে না। বাড়ি থেকে বাবার কাছ থেকে সিদ্ধান্ত পাল্টাবার চেষ্টা করতে হবে। কারণ ঢাকা আলিয়া পড়া মানে মাসে ১০০০ টাকা খরচ (১৯৮৯ সালে)। সেজ ভাইয়ের সাথে কথা হলো। বাবার কাছে বিস্তারিত চিঠি লেখা হলো। কারণ তখন বাড়িতে ফোন ছিলো না। এদিকে আমিও ঢাকা আলিয়াতে ভর্তি হবার প্রক্রিয়া শুরু করেছি।
    আব্বা ফেরত চিঠিতে অনুমতি দিলেন। ঢাকা আলিয়াতে ভর্তি হয়ে গেলাম।
    মুফিজ ভাই পরের দিন বিকালে বললেন- চলেন আপনাকে ফখরুদ্দীন হুজুরের বাসায় নিয়ে যাব। পরিচয় করিয়ে দিব।
    হুজুর থাকতেন বখশীবাজারের খাজে দেওয়ান রোডের ছোট্ট একটা বাসায়। এতো বড় একজন শিক্ষক এতো সাধারণ একটা বাসায় থাকেন দেখে আমি একটু অবাক হলাম। আরো অবাক হলাম দুইটা কারণে। উনার বাসায় অনেক বই-কিতাব আছে। উনি প্রচুর পড়াশুনা করেন। যতক্ষণ উনার ওখানে ছিলাম ততক্ষণ ইলমী বিষয় নিয়েই আলোচনা হলো।
    পরে জানলাম- প্রতিদিন আসরের পর হুজুরের ওখানে ভালো ছাত্ররা চা-নাস্তা নিয়ে যান এবং বিকাল বেলা হুজুরের সাথে ইলমী গল্প করে কাটান। আমার কাছে এই ইলমী আড্ডাটা খুবই পছন্দ হলো। উলামায়ে কেরামের কাছে বসলে যদি ইলমী আলো না পাওয়া যায় তাহলে সেখান থেকে দূরত্ব বজায় রাখাই কল্যানকর।
    আমার জন্যে আরেকটা সুযোগ হলো- আমি ছিলাম খ বিভাগে এবং শায়খ ফখরুদ্দীন হুজুর ছিলেন আমাদের গ্রুপের টিউটর। আর আমি ছিলাম খ গ্রুপের মনিটর। ফলে, হুজুরের সাথে আমার সম্পর্ক তৈরীতে বেশী সময় লাগে নি। তাড়াতাড়ি হুজুরের অতি নিকটে আসার আরো একটা কারণ ছিলো আমার অরাজনৈতিক অবস্থান। আমি কোন ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম না সচেতনভাবেই। অসুস্থ ছাত্র রাজনীতি আমাদের প্রজন্মকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও পেশাদারিত্বের অনেক নিচে গিয়েছে বলে আমার ধারণা ছিলো। আমার আশেপাশে অনেক ভালো ছাত্রকে দেখতাম সারাদিন মিছিল-মিটিং করে বেড়াতো অথচ এক লাইন আরবি ভালো করে পড়তে পারতো না। আমার খুব হাসি পেয়েছিলো সেদিন যেদিন দেখলাম আমারই এক ক্লাসমেট যিনি খুব নিচু নং পেয়ে কেন্দ্রীয় পরীক্ষায়ে ফেল করেছেন তাকে বানানো হয়েছে একটা ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক। আমি ছাত্র রাজনীতির একেবারে বিপক্ষে ছিলাম- তা ঠিক নয়, বরং ছাত্র রাজনীতিতে এই ধরণের দৈন্যতার বিপক্ষে তখনো ছিলাম এখনো আছি। যে ছাত্রটা পরীক্ষায় পাশ করতে পারে না, ভালো করে বাংলা লিখতে পারে না, আরবি জানে না, ইংরেজী জানে না তাকে দেওয়া হয়েছে একটা বড় সংগঠনের জাতীয় দায়িত্ব। এটা একটা রাজনীতি ও জাতির পংগুত্বের লক্ষণ। যে রাজনীতিতে নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বুদ্ধি, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও মেধার চেয়ে চিরাচরিত রীতিবদ্ধতা, আনুষ্ঠানিকতা ও অন্ধ আনুগত্যকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয় সে রাজনীতি কোনদিন কল্যান বয়ে আনে না। কারণ আদর্শ মানে পুরানোকে অন্ধভাবে মানা নয়, আদর্শ মানে নতুনকে নতুন রেখেই পুরানোর স্পিরিট অনুযায়ী চলা ও চালানো। যা হোক- ফখরুদ্দীন হুজুরও কোন রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না, কিন্তু তিনি রাজনীতি ও ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে এমনই ভাবতেন। তাঁর একটা ছোট্ট রেডিও ছিলো। তিনি রেডিওতে খবর শুনতেন। নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন এবং রাজনীতির অত্যন্ত খুটিনাটি বিষয়েও খোঁজ-খবর রাখতেন।
    এভাবেই, ফখরুদ্দীন হুজুরের সান্নিধ্যের মজা পেয়ে গেলাম। বিকেল বেলায় ছাত্ররা যখন বাজার-ঘাটে, রেস্তোরাতে আর খেলার মাঠে সময় কাটাতো, আমরা কয়েকজন তখন হুজুরের সান্নিধ্যেই কাটানো শুরু করলাম। তবে, এক্ষেত্রে আমাদের কয়েকজনের মধ্যে বেশ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেলো। সিলেটের বিশ্বনাথের ছাত্র আযীযুদ্দীন শামীম এ ব্যাপারে এগিয়ে ছিলো। সেও প্রায়ই আমাদের আগেই হুজুযের দরবারে গিয়ে হাযির হতো। আমরা মাগরিবের আগেই চলে আসতাম হলে।
    হুজুর প্রথম বছরে আমাদেরকে বুখারী প্রথম খন্ড পড়াতেন। তবে, সাথে সাথে বুখারী দ্বিতীয় খন্ডও নিয়ে যেতে হত। কারণ তিনি সব হাদীসের সনদের রেফারেন্স দিতেন। এক হাদীসের সমার্থক রেওয়ায়েত আর কোথায় আছে তা তিনি পাতা খুলে খুলে বিশ্লেষণ করতেন। আমি হাদীসের অনেক আলোচনা শুনেছি, মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাদীস শাস্ত্রে পিএইচডি ধারী শিক্ষকদের কাছে হাদীস পড়েছি। কিন্তু শায়খ ফখরুদ্দীন (র) যেভাবে হাদীসের সনদের ও মতনের গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করতেন তার তুলনা হয় না। দুই ঘন্টার ক্লাসে মাঝে মাঝে একটা হাদীসও পড়ে শেষ করা যেত না। তিনি একটা চুম্বকের মত আকর্ষন দিয়ে পড়াতেন। লম্বা লেসনেও কোন বিরক্তি আসতো না। মনে হতো যা পড়াচ্ছেন তা আমাদের মাথায় ও বুকে গেথে যেত। শায়খের উপস্থাপনা ছিলো খুবই প্রাণভরা। মনে হতো আমাদেরকে পড়িয়েও তিনি নিজেও খুব মজা পাচ্ছেন। যারা মনে করেন আলিয়া মাদ্রাসায় পড়াশুনা হয় না তারা যদি শায়খের হাদীসের দারসে বসতেন তাহলে বুঝতেন কতো গভীরতা দিয়ে তিনি একেকটা লেসন তৈরী করে আসতেন। একেকটা দারসের জন্যে তিনি নিজে কয়েক ঘন্টা পড়াশুনা করে আসতেন এবং আমাদেরকেও পড়ে আসার উৎসাহ দিতেন।
    একদিন সকালে ক্লাসে এসে হাসতে হাসতে বলেছিলেন- তুমি আমার সারা রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছো। আমি তো অবাক। আমি কিভাবে উনার রাতের ঘুম হারাম করলাম? আমি অবাকের সুরেই বললাম- হুজুর, কিভাবে? আমি তো বুঝতে পারছি না। তখন তিনি আমাকে মনে করিয়ে দিলেন গতকালের ক্লাসে এক নবীর স্ত্রীর নামের বানানের ব্যাপারে আমি উনার সাথে দ্বিমত করেছিলাম। আমি একটা অক্ষরে যের দিয়ে পড়েছিলাম আর উনি পড়েছিলেন যবর দিয়ে। আমার দ্বিমতকে তিনি এতো গুরুত্ব দিবেন তা আমি কল্পনাও করি নি। তিনি আমার মতটা সঠিক না উনার মতটা সঠিক তা জানার জন্যে সারা রাত ঘুমান নি। অনেক কিতাব পড়াশুনা করেছিলেন।
    যে সমস্ত হুজুররা পরিবার দূরে রেখে একা একা মাদ্রাসায় থাকেন তাদের ব্যাপারে আমার খুব দয়া লাগে। কারণ স্ত্রী ও সন্তানদের ফেলে রেখে থাকা আসলেই খুব কষ্টকর। কিন্তু হুজুরকে দেখে আমার মনে হতো- উনার পরিবার কাছে নেই দেখে এতো পড়াশুনা করতে পারতেন। আমি নিজে একজন শিক্ষক হয়ে একথা ভালোকরেই বুঝি যে পোস্টগ্রাজুয়েট লেভেলের (বিএ, কামিল, এম এ পিএইচডি) একজন শিক্ষকের যে পরিমাণ পড়াশুনা ও গবেষনা করা লাগে তাতে পরিবারের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করা আসলেই কষ্টকর হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে শায়খের স্ত্রীরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন- আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষ থেকে তাদেরকে গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই। আল্লাহ যেন আমাদের মহান শিক্ষকদের সহধর্মিনীদেরকে বিশেষ পুরস্কার দান করেন।
    হুজুরের কাজ কর্ম ছিলো অসম্ভব রকমের গোছানো। তিনি যে কাজ করতেন তা একেবারে পাকাপোক্তভাবে করতেন। তাঁর কারণিক বা অফিসিয়াল কাজ-কর্ম ছিলো অত্যন্ত নিখুঁত। রুলার দিয়ে খাতায় যেভাবে সুন্দর করে দাগ কাটতেন তা ছাপাকেও হার মানাতো।
    আমি যখন ছাত্র ছিলাম তখন শায়খ ফখরুদ্দীন ছিলেন আলিয়া মাদ্রাসার একজন অধ্যাপক। তিনি মাদ্রাসার পরীক্ষার নিয়ন্ত্রক ছিলেন। তবে, মাদ্রাসার সামগ্রিক উন্নয়ন নিয়ে তিনি যে রকম ভাবতেন তা আর কেউ ভাবতেন বলে মনে হয় না। তিনি এটাকে চাকুরী মনে করতেন না, মনে করতেন তার মিশন। সারা আলিয়া মাদ্রাসাটা তখন খুব বেহাল অবস্থায় চলে এসেছিলো। আলিয়া মাদ্রাসার হোস্টেল ছিলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য অছাত্রদের দখলে। আমরা যারা তখন ছাত্র ছিলাম, তাদেরকে ঐ সব অছাত্রদের কাছ থেকে সীট কিনে নিতেও দেখেছি। আমরা ডাবলিং করে থাকতাম। আমি কামিলের ফার্স্ট বয় হওয়ার কারণে আমার ওপর অন্যান্য সাধারণ ছাত্রদের অনেক দাবী ও চাপ ছিলো। ছাত্র সংগঠনগুলো সীট দখলের একটা বিশাল প্রতিযোগিতা করত এবং তাদের পছন্দের নেতা কর্মী ছাড়া তারা কাউকে সীট দিতো না। আমি সারা বাংলাদেশে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়ার পর বা মিল্লাতের ছাত্র হওয়ার পরও কোন ছাত্র নেতার সামান্য একটু দয়া হলো না আমাকে কোথাও একটা সীট দেওয়া। শুধু আমি নই, আরো অনেক ভালো ছাত্রদেরও একই অবস্থা ছিলো। এগুলো নিয়ে হুজুরের সাথে আমি ও অন্যান্যরা দৈনিকই কথা বলতাম এবং নানান চিন্তা ও প্লান প্রোগ্রাম করতাম। হুজুরের সাথে বলার কারণ এটাই ছিলো যে হল সুপার বা হাউস টিউটররা ছিলেন ছাত্রদের কাছে একেবারেই বন্দী। তারা কিছু বললে তারা ছাত্রদের কাছে অপমানিত হবেন বলে তাদেরকে বহুবার বলেও কোন লাভ হয় নি। এবং আমাদেরকে নিয়ে তাদের কোন চিন্তা ছিলো বলেও মনে হয়নি। এ ক্ষেত্রে ফখরুদ্দীন হুজুরের যেমন ছিলো আন্তরিকতা তেমন ছিলো সাহস। তিনি বলতেন- যারা হলের দায়িত্বে আছেন এটা তাদের কাজ এবং তারা ইচ্ছা বা সাহস করলে অনেক কিছু করতে পারেন।
    আমরা বুঝেছিলাম- হুজুর চেষ্টা করলে কিছু করতে পারবেন এবং বেশ কিছু বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হলো। এর প্রথম ধাপ হিসাবে, হুজুরকে আমরা খাজে দেওয়ান থেকে মাদ্রাসার একাডেমিক বিল্ডিং এর একটা রুমে নিয়ে আসি প্রিন্সিপ্যাল অধ্যাপক ইউনুস শিকদারের অনুমোদন ক্রমে এবং হুজুরকে হলের একজন টিউটরও করা হলো। এ সময় ভাইস প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন জনাব আব্দুস সালাম। তিনি খুব ভালো মনের মানুষ ছিলেন এবং মাওলানাদেরকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন। তিনি ফখরুদ্দীন হুজুরকে খুব সাপোর্ট করতেন।
    হুজুরকে এ কাজে আরো বেশী সাপোর্ট করেছিলেন মুহাদ্দিস ওয়াজিউল্ল্যাহ সাহেব। কোন এক কারণে হুজুরের সাথে ওয়াজিউল্লাহ সাহেবের খুব মন কষাকষি ছিলো। মুখ দেখাদেখিও ছিলো না। আমি, সালাম আজাদী, শামীম, নূর মোহাম্মদ, জাকির মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের আলিয়ার পরিবেশ বদলাতে হলে দুই মুহাদ্দিস হুজুরের মধ্যে সম্পর্ক ভালো করতে হবে। কারণ প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের সাথে ওয়াজিউল্ল্যাহ হুজুরের সম্পর্ক ভালো ছিলো। আর ফখরুদ্দীন হুজুরের সাথে ভাইস প্রিন্সিপ্যাল হুজুরের ভালো খাতির ছিলো। ওয়াজিউল্ল্যাহ হুজুরও আলিয়া মাদ্রাসার একাডেমিক ভবনের কোনায় একটা ছোট্ট রুমে। খুব সাধারণ অবস্থায়।
    ওয়াজিউল্ল্যাহ হুজুর ও ফখরুদ্দীন হুজুরের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের জন্যে আমি আর আযীউদ্দীন শামীম বিশেষ করে উদ্যোগ নিলাম। আমাদের সাথে সহযোগিতায় ছিলেন (ডঃ) সালাম আজাদী, নূর মোহাম্মদ ও জাকির হোসাইন। আমরা নিজেরা আগে পরিকল্পণা করলাম এইভাবে যে আমরা দুই গ্রুপ হয়ে যাব- প্রত্যেকদিন বিকালে দুই গ্রুপই নাস্তা কিনে দুই মুহাদ্দিসের কাছে যাব এবং তারা একে অন্যের প্রশংসা করেন সে কথা বলব। এই বুদ্ধিতে কাজ হলো। দুই সপ্তাহের মধ্যেই দুই হুজুরের মন একটু একটু নরম হতে শুরু করলো। এরপর ফখরুদ্দীন হুজুরের রুমে ওয়াজিউল্লাহ হুজুরকে ডাকা হলো নাস্তার জন্যে। তিনি সে দাওয়াত সাদরে কবুল করলেন এবং ফখরুদ্দীন হুজুরও তাকে সাদর অভ্যররথনা জানালেন। বহুদিন পর তারা এভাবে কোন ঘরোয়া পরিবেশে মিশেন নাই এবং দু’জনেই খুব আনন্দিত হলেন বলে বুঝা গেল। এরপর থেকে প্রতিদিন বিকালে আসর থেকে মাগরিব থেকে ফখরুদ্দীন হুজুরের রুমে আমাদের ইলমী আড্ডা হতো। এর সাথে সাথে চা-নাস্তা তো অবশ্যই চলতো। আমাদের সার্কেলের একেকজন ছাত্র একেকদিন তা নিয়ে আসত। মাঝে মাঝে দুইজন নাস্তা নিয়ে আসত। ফলে, আমাদের ভাগে বেশী পড়ত। তবে, খাবার যতই বেশী হোক, শায়খ ফখরুদ্দীন কোনদিনই তার পরিমাণের বেশী খেতেন না। তবে, চা এক কাপ বেশী দিলে তিনি সাধারণত তা না করতেন না। তিনি মাত্রা অনুযায়ী পানও খেতেন।
    ক্রমে ক্রমে আমরা শায়খের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে মিশতাম। হাল্কা রস তামাশাও হতো। তিনি একবার তার নিজের একটা বিব্রতকর ঘটনার কথা বলেছিলেন যেটা ছিলো খুবই হাসির এবং সেটা একটা সময়ের ইতিহাসকে তুলে ধরে।
    বিকাল বেলা। আসরের কিছু আগের ঘটনা। আলিয়া মাদ্রাসার একাডেমিক বিল্ডিং শায়খ ফখরুদ্দীন, শায়খ ওয়াজিউদ্দীন, ও দারোয়ান ছাড়া এ সময় মাদ্রাসায় কেউ থাকতেন না। হঠাৎ টয়লেট থেকে এক চিল্লানোর আওয়াজ আসছে বাচাও বাচাও। একটু কাছে গিয়ে শোনা গেলো শায়খ ফখরুদ্দীন টয়লেট থেকেই চিল্লাচ্ছেন বাচাও বাচাও। তিনি এবার কাছে এগিয়ে গেলেন। গেলেই শায়খ ফখরুদ্দীন টয়লেটের দরোজা একটু খুলে একটা বদনা এগিয়ে দিয়ে বললেনঃ শিগগীর এক বদনা পানি নিয়ে এসে যেখান থেকে পারো।
    ঘটনা হলো- শায়খ টয়লেটে ঢুকেছেন। প্রয়োজন সেরে তিনি টের পেলেন যে টয়লেটের পানি সাপ্লাই শেষ। এই অবস্থায় তার চিল্লিয়ে লোক জড়ো করে পানি চাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিলো না।
    ভাগ্যভালো তিনি কিছুক্ষণের মধ্যে পানি পেয়েছিলেন। এবং পরে হাসতে হাসতে টয়লেট থেকে বের হয়েছিলেন।
    শায়খ খুব কাছা কাছি থাকলেও তাঁর পরিবার বা পারিবারিক বিষয় নিয়ে তেমন কোন গল্প আমাদের সাথে করতেন না। আমি জানি না, এটা আমাদের প্রাচীন শায়খদের একটা রীতি ছিলো কি-না। জীবনের গল্প থেকে পরিবারকে আড়ালে রাখার মধ্যে হয়ত একটা দর্শন আছে। কিন্তু আমার সেটা খুব বোধগম্য নয়। আল্লামা আবুল হাসান নদভী সাহেব তার আত্মজীবনীতে একটি বারের জন্যে নিজের স্ত্রীর কোন প্রসংগ আনেন নি। শায়খ ফখরুদ্দীন আবার এতোটা নিরব ছিলেন না। তিনি যখন বাড়িতে, চট্টগ্রামে নতুন ঘর বানাচ্ছিলেন তখন আমাদেরকে বলেছিলেন।
    হুজুর কামিলের ছাত্রদেরকে টিউশনি করাতেন, বিশাল গ্রুপ নিয়ে। এক ক্লাসে প্রায় ১০০ জন ছাত্র ছিলো। এক ক্লাসরুমে এতো ছাত্র নিয়ে টিউশনি করা খুব সমস্যা হতো দেখে আমরা প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের কাছ থেকে আলিয়া মাদ্রাসার হল রুমে মাইক ব্যবহার করে আলাদা ক্লাস করার অনুমতি পাই। আমরা প্রত্যেকে হুজুরকে তখন মাসে ২০০ টাকা করে টিউশন ফি দিতাম। আমি ছিলাম ট্রেজারার। টাকা পয়সা আমি কালেকশান করতাম এবং এক বা দুই কিস্তিতে শায়খকে নগদ টাকা দিতাম। তিনি কোনদিন টাকা গুণে নিতেন না কিংবা কোনদিন জিজ্ঞাসাও করতেন না। কবে আমরা টাকা দিব বা না দিব তার কোন তাগাদাও দিতেন না।
    আলিয়া মাদ্রাসার মারাত্মক শিক্ষক সংকট নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত ছিলেন এবং সরকারের কাছে তার যত লবি ছিলো সবই লাগিয়ে তিনি শিক্ষক বাড়ানোর জন্যে অনেক চেষ্টা করেছিলেন। মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের নেতৃত্বে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা প্রাক্তন ছাত্র সমিতি গঠনের পেছনে শায়খ ফখরুদ্দীনের অনেক চেষ্টা ও অবদান ছিলো। আলিয়া মাদ্রাসার সমস্যা নিয়ে জাতীয় পত্র-পত্রিকায় রিপোর্ট করানোর জন্যেও তিনি বিভিন্ন সূত্রে অনেক কাজ করেছিলেন। আমি নিজেও তাঁর সংগী ছিলাম। শায়খ মাদ্রাসার হাল-নাগাদ তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করতেন।
    ছাত্রাবাসের সমস্যা সমাধানের জন্যে তার অক্লান্ত চেষ্টা ও প্লান একটা ইতিহাস হয়ে আছে। প্লান হলো- ১৯৮৮ সালে আমাদের প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ হবে, ২য় বর্ষের ফাইনলা পরীক্ষা শেষ হবার পর পুলিশ দিয়ে হল খালি করা হবে। দুই মাস মত কেউ হলে প্রবেশ করতে করতে পারবে না। এরপর মেধার ভিত্তিতে প্রকৃত ছাত্রদেরকে সীট দেওয়া হবে। আমাদের ঘনিষ্ট কয়েকজনকে শায়খ আমাদের পছন্দনীয় রুম দিয়েছিলেন। এরপর পুলিশের সহয়তায় আইডি কার্ড দেখে দেখে আমাদেরকে হলে ঢুকতে দেওয়া হয়। হলের পরিবেশ রক্ষার জন্যে আরো কয়েক সপ্তাহ পুলিশের পেট্রোল ছিলো হলে গেটে। ফলে, আমাদের শেষ বছরের জীবনটা ছিলো খুবই আরাম দায়ক ও গোছানো।
    আমরা আবার যখন হলে উঠলাম তখন হলের পরিবেশ ছিলো খুবই গঠনমূলক। আমাদের হলের ক্যান্টিনের খাবার ছিলো এক যন্ত্রনার বিষয়। শায়খকে বললাম যে আমরা ছাত্ররা কিছুদিন ডাইনিং চালানোর দায়িত্ব নিতে চাই। পরে হল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে আমরা নিজেরা ক্যান্টিনের বাজার করা থেকে শুরু করে সব কিছু চালানোর অনুমতি পাই। এতে আমাদের খরচও কম পড়ে এবং খাবারের মানও অনেক উন্নত হয়।
    শায়খের সবচেয়ে বড় গুণ ছিলো- তিনি ছাত্রদেরকে মন দিয়ে ভালোবাসতেন। তাদেরকে নিয়ে ভাবতেন এবং তাদের কল্যানে যা কিছু সম্ভব ছিলো তা তাঁর নিজ দায়িত্বে করতেন। ছাত্রদেরকে ডেকে পরামর্শ দিতেন। ছাত্রদেরকে তিনি নিজের ছেলেদের মতই দেখতেন। জ্ঞান, জ্ঞানী ও জ্ঞান পিপাসুদের সাথেই শায়খের ছিলো যত ভাব ও শখ্যতা। এ জন্যে জ্ঞান, জ্ঞানীরা ও জ্ঞান পিপাসুরাও শায়খকে অসম্ভব ভালোবাসতেন এখনও বাসেন।
    ১৯৯৯ সালে আমি যখন আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের প্রভাষক ছিলাম তখন এক শিক্ষা সফরে সিলেট গিয়েছিলাম। শায়খ ফখরুদ্দীন তখন ভাইস প্রিন্সিপ্যাল হিসাবে ছিলেন। তিনি সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার এক হোস্টেলে থাকতেন। এক সন্ধ্যায় সেখানে গিয়ে উপস্থিত। শায়খকে দেখেই আনন্দে আমি কেঁদে দিয়েছিলাম। তিনিও খুব আপ্লূত হয়েছিলেন।
    লন্ডনে এসে কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে শায়খের সাথে। কিন্তু আর সাক্ষাৎ হয়নি। কারণ তিনি শেষ বয়েসে চিটাগাং এর চুনতি মাদ্রাসায় চলে যান। আর ২০০০ সালে চিটাগাং ছাড়ার পর আমারও সেখানে যাওয়া হয়নি। অবশ্য শায়খের সাথে মনে মনে এখনো অনেক কথা বলি। মনে হয় তিনি স্বভাবসুলভ মিষ্টি হাসি দিয়ে পুরু চশমার ফাক দিয়ে তাকিয়ে বলছেন- আমি কিন্তু এখনো তোমাদেরকে ছেড়ে যাই নি !! আমিও বলি- শায়খ আপনি ছেড়ে যাবেন কিভাবে? আপনি তো বাধা আছেন আমাদের হৃদয়ের অনেক অনেক গভীরে, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সোনালী তারে। আপনি সত্যি একজন মহান বন্ধু, বাবা ও শিক্ষক। আপনাকে ছাড়া আমাদের চলার পথ নিরংকুশ নয়।