স্মরণ- অনূভবে শায়খুল হাদীস ফয়জুল বারী মহেষপুরী (র.)

    0
    406

    আমারসিলেট24ডটকম,১৬জানুয়ারীঃ মুহাম্মদ রুহুল আমীন নগরী:বৃহত্তর সিলেটের সর্বজনশ্রদ্ধেয় আলেমেদ্বীন শায়খুল হাদীস আল্লামা ফয়জুল বারী মহেষপুরী হুজুর আর নেই। তিনি সম্প্রতি মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে চলেগেছেন। তিনি নেই কিন্তু আমাদের মাঝে রেখেগেছেন অনুকরনীয় অনেক দৃষ্টান্ত। আমি তাকে যতটুকু জেনেছি-কাছে থেকে অনুভব করেছি তাহলো-তিনি সত্যিকার অর্থেই একজন মাটির মানুষ ছিলেন। নিরহংকারী সাদামনের এই মানুষটি কিন্তু আল্লাহর নৈকট্য হাসিল কারীদেরই প্রথম সারির অন্যতম একজন। পুর্ব গগনে উদিত সূর্যের মতোই  আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী(র.) পরে তিনি পুর্ব সিলেটকে হাদীসের রৌশনীতে আলোকিত করেছিলেন। জীবনের শেষ লগ্নে শাহ জালালে ছানী শায়খুল ইসলাম আল্লামা হোসাইন আহমদ মাদানী (র.)এর ইলমী-আমলী দূর্গ হিসেবে পরিচিত সিলেটের নয়াসড়ক মসজিদ ও মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করেই ছিলো তার কর্মব্যস্ততা। নয়াসড়ক জামে মসজিদের প্রায় দুই যুগের খতীব হিসেবে প্রতি শুক্রবার বয়ান করতেন। এছাড়া রমজান মাসে ইতেকাফ ও করতেন শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানী (র.)এর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যবাহী নয়াসড়কে। ফেতনা ফাসাদের ভেড়াজাল থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতেই সরে দাড়িয়েছিলেন দীর্ঘ অর্ধশতাদ্ধির প্রিয় কর্মস্থল দারুল উলুম কানাইঘাট থেকে। হাদীস শাস্ত্রের উজ্বল এই নক্ষত্রের কক্ষচ্যুতিতে সত্যিই বিশাল শুন্যতা বিরাজকরছে। বহুবিদ জ্ঞানের অধিকারী ‘আল্লামা’ ফয়জুল বারী মহেষপুরী (র.) ছিয়াসতের ময়দানে আকাবির আছলাফের শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী কাফেলা জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। জাতির এই সংকটময়মুহুর্তে তার মতো বহুদর্শী একজন খতীবের চলে যাওয়া আমাদের জন্য দু:সংবাদই বটে।

     তিনি গত ১০ জানুয়ারী ২০১৪ ঈসায়ী শুক্রবার বেলা পৌনে ২ ঘটিকার সময় কানাইঘাট উপজেলাধীন মহেষপুর গ্রামের নিজ বাড়ীতে ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহী ওয়াইন্নাইলাইহি রাজিউন। পরদিন শনিবার সকাল ১১ ঘটিকায় কানাইঘাট দারুল উলুম মাদ্রাসা মাঠে লাখো জনতার উপস্থিতিতে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতিকরেন, মরহুমের একমাত্র ছেলে মাওলানা আব্দুল লতিফ। সিলেটের প্রবীণ এই আলেমেদ্বীনের মৃত্যুর খবর মুর্হুতে ছড়িয়ে পড়লে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। সিলেটের প্রত্যন্ত এলাকা হতে বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহন রিজার্ভকরে অসংখ্য বক্ত-অনুরক্ত মরহুমকে শেষ বারের মতো এক নজর দেখার জন্য কানাইঘাটে ছুটে যান। তার জানাযায় শরীক হতে বিভিন্ন কওমী মাদ্রাসা অঘোষিত ছুটি ছিল। সিলেট নগরীর ঐতিহ্যবাহী নয়াসড়ক জামে মসজিদের খতীব ও নয়া সড়ক দারুল হাদীস টাইটেল মাদ্রাসার শায়খুল হাদীসের দায়িত্ব ও পালন করেন।  পুর্বসিলেটের কওমী মাদ্রাসা সমুহের প্রাচীন তম শিক্ষাবোর্ড আযাদ দ্বীনী এদারার সভাপতি ছিলেন। আধ্যাত্মিক ময়দানে তিনিফেদায়ে মিল্লাত হযরত আসআদ মাদানীর এর নিকট থেকে খেলাফত প্রাপ্তহন। ২০০৪ সালের ৭ মে সিলেট নয়াসড়ক মাদ্রাসা মার্কেটে আল কলম গবেষণা পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁর জীবন বৃত্তান্ত জানার জন্য হুজুরের সাথে সাক্ষাৎহয়। সেদিন র্দীঘ আলাপ চারিতায় সমকালীন অনেক বিষয়াদি আমাদের অবগতকরে ছিলেন।  আপনার বয়স কত? এমন এক প্রশ্নের জবাবে হুজুর ৭৬ বছর বলেছিলেন।

    মরহুম শায়খুল হাদীস আল্লামা ফয়জুল বারী মহেষপুরী ১৯২৭ ঈসায়ী সনে সিলেটে জেলার কানাইঘাট উপজেলাধীন মহেষপুর গ্রামে এক সমভ্রান্তপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম মুহাম্মদ আসআদ একজন সৎব্যবসায়ী ও ধার্মীক ব্যক্তি ছিলেন। মাতা মরহুমা মাহমুদা বেগম ছিলেন একজন পর্দানশীল দ্বীনদার মহিলা। শিক্ষা জীবনে তিনি স্থানীয় বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধ্যয়নের পর কানাইঘাট দারুল উলুমে ভর্তিহন। অতপর উমরগঞ্জ ইমদাদুল উলুম মাদ্রাসায় ৪ বছর লেখা পড়াকরে চলেযান গাছবাড়ী। তিনি গাছবাড়ী আলিয়া মাদ্রাসায় ৪ বছর ছাত্রজীবন অতিবাহিতকরে বুখারীও তিরমিযি শরীফ  পড়েন। ১৯৪০-৫০ এর কোন এক সময় গাছবাড়ী জামিউল উলুম কামিল মাদ্রাসা থেকে ফাযিল উর্ত্তীন হন। ১৯৫১-৫২ সালে সিলেটে সরকারী আলিয়া মাদ্রাসা থেকে প্রথম বিভাগে তাকমিল ফিল হাদীস পরীক্ষায় উত্তীর্ণহয়ে কৃতিত্ব অর্জনকরেন। তখনকার উস্তাদগনের মধ্যে অন্যতম হলেন-প্রিন্সিপাল মাওলানা মোহাম্মদ হাসান, মাওলানা ফৈয়াজ আলী, মাওলানা আব্দুল ওয়াহিদ শায়খে রাজারগাও প্রমুখ। এছাড়া তাঁর জীবন গঠনে যেসকল উস্তাদগনের বিশেষ ভুমিকা ছিল তাদের মধ্যে রয়েছেন, আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী, মাওলানা আব্দুর রব কাসেমী,  মাওলানা শায়খ আব্দুস সামাদ,  মাওলানা মছদ্দর আলী, মাওলানা আবু সাঈদ (র) প্রমুখ। যশোর সিদ্দিকীয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে শায়খে মহিষপুরী কর্মজীবনের সুচনাকরেন। সেখানে ২ বছর শিক্ষকতার পর স্বীয় উস্তাদ আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী (র.)এর নির্দেশে ১৯৫৫ সালে চলে আসেন দারুল হাদীস কানাইঘাট মাদ্রাসায়। প্রথমে শিক্ষক পর্যায়ক্রমে নাজিমে তালিমাত, শায়খুল হাদীস ও মুহতামিম এর গুরুদায়িত্ব পালনকরে দারুল উলুম কানাইঘাটকে বৃহত্তর সিলেটের র্শীষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলতে বিরামহীন পরিশ্রমকরেগেছেন। তিনি দারুল উলুম কানাইঘাটের ৪র্থ মুহতামিম হিসেবে ১৯৮৮-২০০৬ সাল পর্যন্ত মুহতামিম এর আগে ৭ বছর নাজিমে তালিমাত, প্রায় ১৯ বছর শায়খুল হাদীসের দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত কানাইঘাট ইসলামীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়ে ১৯৬০ সালে দাওরায়ে হাদীস খোলা হয়। মাদ্রাসার প্রথম মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস ছিলেন  (দায়িত্বকাল ১৯৫৩-১৯৭০) মাওলানা মুশাহিদ বায়মপুরী, দ্বিতীয় মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস ছিলেন মাওলানা মুজাম্মিল ( দায়িত্বকাল-১৯৭১-৭২) তৃতীয় মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস ছিলেন  মাওলানা শহরুল্লাহ চটির হুজুর ( দায়িত্বকাল-১৯৭৩-১৯৮৭)।  দীর্ঘপ্রায় অর্ধশতাব্ধিকালের প্রিয় এই কর্মক্ষেত্র ছেড়ে ইন্তেকালের কয়েক বছর আগে (২০০৬ সালে) তিনি কর্মজীবনের এই ঠিকানা পরিবর্তন করতে বাধ্যহয়েছিলেন। আল্লাহর প্রিয় এই বান্দা মৃত্যুর কয়েকদিন পুর্বে কাফনের ব্যবস্থার জন্য নগদ কিছু টাকা নিজ সন্তানের হাতে তুলে দিয়ে কোন জায়গায় তাকে সমাহিত করাহবে এ সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়ে যান।  এছাড়া কর্মজীবনে দারুল উলুম থেকে ১৯ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা হারে মাসিক যে বেতন তিনি নিয়েছিলেন এই টাকা পরিশোধের জন্য মৃত্যুর আগে নিজ সম্পদ মাদ্রাসায় দানকরেগেছেন। জানাগেছে, প্রায় ৪০ লক্ষ টাকার জমি মাদ্রাসার নামে ওয়াকফকরে দিতে পরিবারের সদস্যদের ওসিয়তকরেগেছেন। বেতন বাবদ  তিনি যে পরিমান অর্থ মাদ্রাসা থেকে নিয়েছিলেন তার চেয়ে বহুগুণ সম্পদ মাদ্রাসার নামে দানকরে এক বিরল ইতিহাস সৃষ্টিকরেগেলেন।

     সত্যকে সত্য, সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে তিনি কাউকে পরোয়া করতেননা। তিনি বিভিন্ন সময়ে বয়ানে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদা পরিপন্থীদের ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের মুখোশ উন্মোচনে কোরআন-সুন্নাহ নির্ভর সারগর্ব আলোচনা  করতেন। ২০০৭ সালে জামিয়া ইসলামিয়া হোসাইনিয়া নয়াসড়ক মাদ্রাসায় তার মাধ্যমে বুখারী শরীফের দরস চালু হয়। সেখানে একাধারে ৫ বছর হাদীসের দরস দেন। ২০১২ সাল থেকে অসুস্থতার কারনে নিয়মিত আসতে পারেননি। আধ্যাত্মিক ময়দানে তিনি প্রথমে বাহরুল উলুম আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী (র.)এর  হাতে বায়াত গ্রহন করেন। অত:পর স্বীয় মুর্শিদের ইন্তেকালের পরে কুতবুল আলম শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানী (র.)এর সুযোগ্য আওলাদ ফেদায়ে মিল্লাত হযরত আসআদ মাদানীর হাতে ব্য়াাত গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তাযকিয়ায়ে ক্বলবের মেহনতে ১৯৯৬ সালে হযরত আসআদ মাদানী (র.)এর নিকট থেকে খেলাফত প্রাপ্তহন।  শায়খুল হাদীস মাওলানা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ী, মাওলানা শিহাবুদ্দিন রেংগা, মাওলানা নছিব আলী, মাওলানা শফিকুল হক সুড়ইঘাটি, মাওলানা আলিম উদ্দীন দুলর্ভপুরী প্রমুখ মরহুমের ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম। ছাত্রজীবনে তিনি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ এবং পাকিস্তান আমলে  জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং ১৯৭১ সালের পর থেকে মৃত্যু পযন্ত জমিয়তে উলামায়ে ইসলার্ম বাংলাদেশ এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ক্বাঈতুল উলামা হযরত আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া, মাওলানা শামসুদ্দিীন কাসেমী, মাওলানা আশরাফ আলী শায়খে বিশ্বনাথী (র.), মাওলানা মহিউদ্দীন খান প্রমুখ উলামায়ে কেরামের নেতৃত্বে তিনি জমিয়তের কর্মতৎপরতা চালিয়ে যান। কানাইঘাট উপজেলার র্দীঘ দিনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালের ৫ ডিসেম্বর কানাইঘাটে জমিয়তের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি খলিফায়ে মাদানী শায়খুল হাদীস আল্লামা শায়খআব্দুল মোমিন। সেই সমাবেশে হযরত শায়খে মহেষপুরী ও উপস্থিত ছিলেন। সম্ভবত এই সমাবেশই ছিলো তার জীবনের শেষ রাজনৈতিক সভা। তিনি জীবনে ৭ বারেরও অধিক পবিত্র হজ্ব পালনকরেন। পারিবারীক জীবনে ১ ছেলে ও ৭ মেয়ের জনক। ১৯৬২ সালে তিনি বিষনপুর নিবাসী উসমান আলীর ৪ র্থ কন্যা আলেয়া বেগমের সাথে প্রথমে পরিনয় সুত্রে আবদ্ধ হন।  এ তরফে কোন সন্তানাদি নেই। এরপর  একই গ্রামের হাজি ইমরান আলীর ২ য় কন্যা বেলায়তুননেছার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এ তরফে ১ ছেলে ও ৭ মেয়ে জন্মলাভকরেন। বিভিন্ন সময়ে মোট ৪ টি বিয়ে করেন। একমাত্র ছেলে মাওলানা আব্দুল লতিফ দারুল উলুম কানাইঘাট মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন।লেখক: সহসাধারণ সম্পাদক -জালালাবাদ লেখক ফোরাম সিলেট