সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে শিক্ষকরাই গলদঘর্ম

    0
    364

    প্রশ্ন করতে পারেন ৪৮% স্কুলের শিক্ষক,অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তা নেন ৩১%,বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র জোগাড় করেন ২১% শিক্ষক!

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,২০সেপ্টেম্বর,ডেস্ক নিউজঃ এক বছরের ব্যবধানে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে সৃজনশীল পদ্ধতির শিক্ষায় অবনতি হয়েছে। গত মে মাসে বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শনের ভিত্তিতে করা সরকারি প্রতিবেদন বলছে, প্রায় ৫২ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এখনো সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্নই করতে পারেন না। গত বছরের মে মাসের তথ্যানুযায়ী, ৪৫ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এ পদ্ধতিতে প্রশ্ন করতে পারতেন না।

    মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) করা দুটি ‘একাডেমিক সুপারভিশন প্রতিবেদন’ তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে অবনতির এই চিত্র পাওয়া গেছে। এই অবনতির কারণ খুঁজতে শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, একাধিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মাউশির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সৃজনশীল বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ পর্যাপ্ত নয়। নামকাওয়াস্তে মাত্র তিন দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যা কাজে আসছে না। এ ছাড়া বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ‘যেনতেনভাবে’ নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের বড় অংশই বিষয়টি ভালোভাবে না বোঝায় তাঁরা নোট-গাইড বই সরাসরি প্রশ্ন করেন। অনেক বিদ্যালয় আবার অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার জন্য স্থানীয় শিক্ষক সমিতিগুলোর কাছ থেকে প্রশ্নপত্র কিনে পরীক্ষা নেয়। ফলে শিক্ষকের এই চর্চা ঠিকমতো হচ্ছে না, যার প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপর।

    রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেন, তাঁদের বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় দেখেছেন, সৃজনশীল অংশে শিক্ষার্থীরা বেশি নম্বর পায় না। কিন্তু শিক্ষার্থীরা বোর্ডের পরীক্ষায় বিদ্যালয়ের চেয়ে বেশি নম্বর পাচ্ছে। এটা তাঁদের কাছে আশ্চর্য লাগে। প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম বলেন, এই পদ্ধতি ভালোভাবে করতে হলে সারা দেশে শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ আরও জোরদার করতে হবে।

    ‘সৃজনশীল’ ‘সৃজনশীল’ বলে চিৎকার শুরু ২০০৭ সাল থেকে। তারপর ২০১০ সালে মাধ্যমিকে বাংলা ও ধর্মশিক্ষায় ‘সৃজনশীল পদ্ধতি’তে প্রথম পরীক্ষা নেওয়া শুরু। কিন্তু চালু হওয়ার এত দিন পরে শিক্ষকেরা সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন কি না, তা নিয়ে একটি পরিদর্শন প্রতিবেদন ছাপিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর। এ নিয়ে শিক্ষাবিদ আমিরুল আলম খানের মতামত পড়ুন সৃজনশীল প্রশ্ন: হাটে হাঁড়ি ভাঙল মাউশি
    মাউশির কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুখস্থবিদ্যা পরিহার করার লক্ষ্যে ২০০৮ সালে মাধ্যমিক স্তরে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়। তখন বলা হয়েছিল, এই পদ্ধতিতে নোট-গাইড বই থাকবে না, কোচিং-প্রাইভেট বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এখন নাম পরিবর্তন করে নোট-গাইড বইয়ের জায়গায় অনুশীলন বা সহায়ক বই চলছে। শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা বলছেন, শিক্ষকেরাই বিষয়টি ভালোভাবে না বোঝায় শিক্ষার্থীদের কোচিং-প্রাইভেট বা সহায়ক বইয়ের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে।

    সৃজনশীলে একটি বিষয়কে চারটি ভাগে প্রশ্ন করা হয়। এতে প্রথম অংশের প্রশ্নের উত্তর বই থেকে দেওয়ার সুযোগ থাকলেও বাকি তিনটি অংশের উত্তর দেওয়ার কথা বুদ্ধি খাটিয়ে।

    মাউশি দেশের শিক্ষা প্রশাসনের নয়টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে সর্বশেষ গত মে মাসে ৬ হাজার ৬৭৬টি বিদ্যালয় (মোট বিদ্যালয়ের প্রায় ৩৬ শতাংশ) সুপারভিশন করে প্রতিবেদনটি করেছে। আর গত বছর ৬ হাজার ৪৪২টি বিদ্যালয় সুপারভিশন করা হয়েছিল। বর্তমানে সারা দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ১৮ হাজার ৫৯৮টি। এসব বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী এক কোটির বেশি।

    মাউশির সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, সুপারভিশন করা বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন। বাকি বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরা অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় বা বাইরে থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করে কাজ চালান। এর মধ্যে প্রায় ৩১ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় ও ২১ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করেন।

    জানতে চাইলে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, মাধ্যমিকে প্রশিক্ষণ পর্যাপ্ত নয়। দ্বিতীয়ত, প্রশিক্ষণের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। আর এখন শিক্ষা পণ্যে পরিণত হয়েছে। কোচিং-প্রাইভেট ও গাইডনির্ভর হয়ে গেছে। শিক্ষকেরা ওই সবে জড়িয়ে যাচ্ছেন। প্রশ্ন করার ক্ষেত্রেও তাঁরা অনুশীলন বইয়ের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছেন। এখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য শ্রেণিকক্ষের পড়াশোনা উন্নত করা ছাড়া বিকল্প নেই। প্রশিক্ষণের মানও বাড়াতে হবে।

    মাউশির প্রতিবেদন বলছে, বিদ্যালয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি নিশ্চিত করতে হলে বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ একেবারেই নিষিদ্ধ করতে হবে এবং নিজেরাই যাতে নতুন এই পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।

    ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বলেন, বোর্ডের পরীক্ষার প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে সমস্যা হয় না। কারণ, বোর্ডের প্রশ্ন করেন ‘মাস্টার ট্রেইনাররা’। তবে বিদ্যালয়গুলোর অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় অনেক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা স্থানীয় সমিতির মাধ্যমে পরীক্ষা নেন। অনেকে আবার গাইড ও বইয়ের ওপর নির্ভর করেন। এ জন্য সারা দেশের বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ আরও বাড়াতে হবে।

    সেগুনবাগিচা হাইস্কুলের একজন শিক্ষক বলেন, সৃজনশীল প্রশ্ন হলেও শ্রেণিকক্ষে সৃজনশীল শিক্ষা হচ্ছে না। এই বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক এ কে এম ওবাইদুল্লাহ বলেন, সহজলভ্য হওয়ার কারণেই নোট-গাইডনির্ভর হয়ে প্রশ্ন করেন শিক্ষকেরা। আবার প্রশিক্ষণও পর্যাপ্ত নয়।

    মাউশির মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর বিনিয়োগ প্রকল্পের (সেসিপ) অধীনে এ বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু এই প্রশিক্ষণ মাত্র তিন দিনের। যার মাধ্যমে শিক্ষকেরা ভালোভাবে বিষয়টি বুঝতে পারেন না। এ ছাড়া এখনো বিরাটসংখ্যক শিক্ষক প্রশিক্ষণ পাননি। সর্বশেষ একাডেমিক সুপারভিশন করা বিদ্যালয়গুলোর মোট শিক্ষক ছিলেন ৮৪ হাজার ৭২৩ জন। তাঁদের মধ্যে সৃজনশীল প্রশ্নের বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ৪৭ হাজার ৬০৩ জন।

    জানতে চাইলে মাউশির মহাপরিচালক এস এম ওয়াহিদুজ্জামানও বলেন, মাত্র তিন দিনের প্রশিক্ষণটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এ জন্য শিগগিরই শিক্ষকদের আবার ছয় দিন করে প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

    আরও যা আছে প্রতিবেদনে

    শিক্ষার মানোন্নয়ন, ঝরে পড়া রোধ ও শিক্ষার্থীদের বিকাশে স্বল্প কৃতীধারী শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার কথা থাকলেও ২৩ শতাংশেরও বেশি বিদ্যালয় দুর্বল শিক্ষার্থী চিহ্নিতই করে না। আর ২৫ শতাংশ বিদ্যালয় চিহ্নিত করলেও পদক্ষেপ নেয় না। বাকিরা নেয়। মাত্র ৩৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ শিক্ষক সম্পূর্ণভাবে ডায়েরি হালনাগাদ করেন। প্রধান শিক্ষকের রেজিস্টার সম্পূর্ণ হালনাগাদের হার মাত্র ৩০ শতাংশ।

    সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, তদারক করা ৫১টি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য টয়লেট নেই, নিরাপদ পানির ব্যবস্থা নেই ১২৯টিতে। পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ নেই ১ হাজার ৩১১টি বিদ্যালয়ের।

    মাউশির মহাপরিচালক বলেন, তদারকিতে যেসব সমস্যা বেরিয়ে এসেছে, সেগুলো সমাধানের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রথম আলো