সিলেট সীমান্তজুড়ে বিজিবি ও পুলিশের সতর্কতা

    0
    253

    ‘আসামো কিতা অর (আসামে কী হচ্ছে), জানি না। গ্রামোর মাইনষে (মানুষ) নানা কথা কইরা (বলছে)। ইন্ডিয়ার বিষয় লইয়া আমরা কুছতা মাততাম (কিছু বলতে) চাই না। তার ফরেও (পরেও) চিন্তা অয়। চিটাগাং যেলা (যেভাবে) রোহিঙ্গা হকলে (সব) দখল করি বইছে, ইলা কুন্তা অইলে (সে রকম হলে) আমরার জকিগঞ্জর মানুষও বিপদো (বিপদে) পড়ি যাইব।’ এমন আশঙ্কা মনে থাকলেও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ওপর ভরসা আছে শ্রমজীবী আব্দুল মন্নানের। সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী বড় ছালিয়া গ্রামের বাসিন্দা মন্নানের মতো প্রায় সবার মধ্যেই নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাজ করছে।

    সীমান্তের ওপারে ভারতের আসাম রাজ্যে নাগরিক নিবন্ধনের চূড়ান্ত তালিকা (এনআরসি) প্রকাশের পর ১৯ লাখের ওপর মানুষ রাষ্ট্রহীন হওয়ার হুমকিতে রয়েছে। তাদের বাংলাদেশে ‘পুশইন’ করার হুমকি দিচ্ছেন সেখানকার কিছু রাজনীতিবিদ। এমন পরিস্থিতিতে সিলেট সীমান্তজুড়ে বিজিবি ও পুলিশের সতর্কতা বাড়ানো হয়েছে। এতে এখানকার মানুষ কিছুটা আশ্বস্ত হলেও দুই বছর আগে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা সমস্যা তাদের ভাবিয়ে তুলেছে।

    জকিগঞ্জ, কানাইঘাট ও বিয়ানীবাজার উপজেলা মিলে ভারতের আসামের সঙ্গে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ৫৪ কিলোমিটার সীমান্ত থাকায় জকিগঞ্জের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বেশি। এ উপজেলার সীমান্তবর্তী বীরশ্রী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম সমকালকে বলেন, ‘আসামের এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সে দেশের সরকারকেই এর সমাধান করতে হবে। তারপরও সীমান্তের মানুষের মধ্যে নানা উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।’

    সীমান্তের ওপারে ‘অস্থিতিশীল পরিস্থিতি’তে অনেকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে চাইবে এমন আশঙ্কার বিষয়ে বিজিবি-১৯ ব্যাটালিয়নের লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাঈদ হোসেন বলেন, সে দেশের কোনো ধরনের প্রভাব যাতে আমাদের ওপর না পড়ে, সেজন্য আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। সীমান্ত এলাকায় এমনিতেই সব সময় কঠোর নজরদারি থাকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দায়িত্বরতদের আরও তৎপর থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

    বিজিবির সতর্কতার মধ্যেও সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা শঙ্কার কথা স্বীকার করেছেন জকিগঞ্জ পৌর কাউন্সিলর রিপন আহমদ। তিনি বলেন, বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে ভারত দায়িত্বশীল আচরণ করবে বলে আমরা আশা করি। তারপরও কোনো কারণে বাংলাদেশে পুশইন করা হলে বা কেউ অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলে প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষ তাদের প্রতিহত করবে। তিনি বলেন, আমাদের জানামতে বাংলাদেশের কেউ ভারতে থাকে না।

    জকিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মুক্তিযোদ্ধা খলিল উদ্দিন বলেন, পাশাপাশি এলাকা হওয়ায় স্বাধীনতার আগে আসামের সঙ্গে এপারের মানুষের আত্মীয়তা ছিল। বিয়ে-শাদির সূত্রে এখানের অনেকের ওখানে আত্মীয়স্বজন রয়েছে। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই প্রবণতা তেমনভাবে দেখা যায়নি।

    জকিগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী আমলসিদ, বড় ছালিয়া, বেউড়ের এলাকার অনেকে জানিয়েছেন, আসামে তাদের আত্মীয়স্বজন রয়েছে। তবে তাদের কেউ এনআরসিতে বাদ পড়েননি বলে জানা গেছে। আমলসিদ গ্রামের সুখেন বলেন, তার এক পিসির ভারতে বিয়ে হয়েছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর সেই পিসির সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই। আসামে আত্মীয় থাকার কথা শুনলেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এদেশের অনেকেই সেই আত্মীয়তা ভুলে গেছেন সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ওঠায়।

    জকিগঞ্জের ছয়ল্যান্ডের বাসিন্দা মাহবুব আলম তাহের জানান, তার নানির পৈতৃক বাড়ি আসামের করিমগঞ্জের হাদারগ্রাম। সেখানে তার এক ফুফু, খালাসহ অনেক আত্মীয়স্বজন রয়েছেন। জকিগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী খলিলুর রহমান জানান, তার নানার অধিকাংশ আত্মীয় আসামের করিমগঞ্জ শহরতলির লোহারমহল, ফেদলগ্রাম ও ফুয়ারা এলাকায় বাস করেন। তাদের অনেকে আসামের গৌহাটি শহরে ব্যবসা করেন। তাদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে যোগাযোগ হয়।

    বিয়ানীবাজারের দুবাগ ও মুড়িয়া ইউনিয়নের বড়গ্রাম, গজুকাটা, নয়াগ্রামের সঙ্গে আসামের চার কিলোমিটারের মতো সীমান্ত রয়েছে। এই সীমান্তের মধ্যে শেওলা স্থলবন্দর থাকলেও আপাতত ‘পুশইনের’ আশঙ্কা নেই তিন গ্রামের মানুষের মধ্যে। অবশ্য কানাইঘাট উপজেলার সীমান্ত এলাকার মানুষের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। লোভাছড়া চা বাগানের বাসিন্দা নিরঞ্জন বৈদ্য জানান, তার পূর্বপুরুষের বাড়ি আসামের কালাইন এলাকায়। সেখানে তার মা ও ছোট ভাই থাকেন।

    কানাইঘাটের সীমান্তবর্তী লক্ষ্মীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফয়েজ আহমদ বলেন, দেশ ভাগের আগে আসামের অনেক এলাকায় আমাদের অঞ্চলের লোকজন আত্মীয়তা করেছেন। দেশভাগের পর দুই দেশের বাসিন্দা হয়ে যে যার মতো জীবন-সংসার সাজিয়েছেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের মতো আসামের লোকজনকে বাংলাদেশে পুশইন করা হলে বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

    কানাইঘাটের সীমান্তবর্তী অঞ্চল বড়গ্রামের বাসিন্দা ও সিলেট জেলা পরিষদের সদস্য আলমাছ উদ্দিন বলেন, যে কোনো দেশের মানুষ তার নাগরিকত্ব নিয়ে বিপাকে পড়াটা খুবই দুঃখজনক। আসামের ১৯ লাখ মানুষের নাগরিকত্ব জটিলতার বিষয়টি প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমরাও উদ্বিগ্ন। আশা করি ভারত সরকার দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করবে।সমকাল থেকে