সার্ধশত বর্ষে ঐতিহ্যবাহী রাজার বাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়

    0
    445

    আমার সিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,১৩জুলাই,এম এস জিলানী আখনজী, চুনারুঘাট (হবিগঞ্জ) থেকেঃ হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার আহম্মদাবাদ ইউনিয়নে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যের ধারক সু-প্রাচীন বিদ্যাপীঠ রাজার বাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। ১’শ ৫০ বছর যাবৎ জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে বিদ্যালয়টি।

    এ বিদ্যালয়টির আশপাশে গড়ে উঠে শতাধিক গ্রামগঞ্জ, হাট বাজার, মসজিদ, মক্তব, খানকাহ্ ও অগনিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব অগনিত প্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে জীবন্ত কিংবদন্তীরূপে কালের স্বাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আজো জ্ঞানের আলো বিতরণ করে চলছে ঐতিহ্যবাহী রাজার বাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়।

    ইতিহাস থেকে জানা যায়, ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা বীর বিক্রম মানিক্য লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করতো বর্তমান রাজার বাজার ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সমূহ। অবসর সময় তার কাটতো এই অ লে। রাজার বাজারের গোড়াপত্তন হয় তার হাতেই। এর সূত্র ধরে কালে-কালে বিকশিত হতে থাকে এই অ ল। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ব্রিটিশ সরকার শিক্ষার উন্নয়নের জন্য সমগ্র ভারত বর্ষের বিভিন্ন এলাকার প্রয়োজন অনুসারে বিদ্যালয় স্থাপন করে।

    এরই অংশ হিসেবে ১৮৩২ সালে আসাম সরকার তৎকালীন সিলেট জেলায় পাঁচটি বিদ্যালয় স্থাপন করে। এ গুলোকে বলা হতো এম ভি স্কুল বা মধ্যবঙ্গ ভার্নাকুলার স্কুল। এই পাঁচটির একটি স্থাপিত হয় হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার রাজার বাজারে। এই বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠার সন নিয়ে এক বিষ্ময়কর তথ্য দিলেন রাজার বাজারের প্রবীন মানুষ হরি গোপাল ঘোষ (বেনু মহাজন) একবার তার মুদি দোকানে বিদ্যালয়ের কিছু পুরাতন কাগজপত্র বিক্রি করা হয়। হঠাৎ একটি কাগজে তার চোখ পড়ে। যেখানে ১৮৬৭ প্রতিষ্ঠা সাল লেখা ছিল।

    রাজার বাজারের দা-মদরপুর গ্রামের জমিদার দানবীর উমেশ চন্দ্র দাস গুপ্ত বর্তমান বিদ্যালয়টির জমি দান করেন। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনামলে এ অ লের মানুষ শিক্ষার ছোঁয়া থেকে বি ত ছিলেন। আর এ জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আলো দিতেই তিনি প্রায় ৩ একর জমি দান করেন বিদ্যালয় স্থাপনার জন্য। এর মাধ্যমে দানবীর উমেশ চন্দ্র দাস গুপ্ত রাজার বাজার তথা চুনারুঘাটে শিক্ষার আলোকবর্তিকা জ্বালান। প্রতিষ্ঠানটি রাজার বাজার উচ্চ বিদ্যালয় নামে নামকরণ করা হয়। নয়ন জুরানো বিশাল অট্রালিকার পাশেই রাজার বাজার উপ-সাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য জমি দান করেন।

    এলাকার প্রবীন মুরুব্বী সূত্রে জানা যায়, সর্ব প্রথম মধ্যবঙ্গ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন স্নানঘাটের আফসর উদ্দিন, পরবর্তীতে হেড মাস্টার কামিনি পন্ডিত, হেড মাস্টার আব্দুস সত্তার পন্ডিত সহ পর্য্যায়ক্রমে নাম না জানা আরো অনেকেই প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।

    ১৯৬০ সালে ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যাপিঠখানী সরকারি জুনিয়র স্কুলে রূপান্তরীত হয়। পরে ১৯৬৬ সালে নবম ও দশম শ্রেণীর একটি পাবলিক হাইস্কুল গড়ে তোলা হয়। শিক্ষানুরাগী আব্দুল লতিফ চৌধুরীর অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্ঠায়, বুয়েটের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চ্যান্সেলর ড. এম এ রশীদ এর সহযোগীতায় পহেলা সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ সালে সরকারি হিসেবে পূর্ণাঙ্গভাবে স্বীকৃতি পায়।

    এ উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠালগ্নে অনেক গুনী ব্যক্তিদের অবদানও কোন অংশে কম ছিল না। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন এলাকার বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিত্ব মরহুম আব্দুল লতিফ চৌধুরী, মরহুম ড. এম এ রশীদ, মরহুম মোবারক হোসেন, স্বর্গীয় রাজেন্দ্র দাস, স্বর্গীয় শ্রী দেব রায়, হীরন কুমার দাস গুপ্ত, মরহুম জমরুত চৌধুরী সহ নাম না জানা আরো অনেকেই। মরহুম আব্দুল লতিফ চৌধুরী তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিক্রি করে অর্থ, শ্রম ও মেধা দিয়ে তিনি তিলে-তিলে প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখতে এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে কাজ করে গেছেন।

    বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকাকালীন সময়ে প্রধান শিক্ষক ছিলেন বালিয়ারি নিবাসী আব্দুল আউয়াল, বি এস সি। ১৯৭৬ সালে নিজ এলাকা শ্রীকুটায় একটি নতুন বিদ্যালয় স্থাপনের লক্ষ্যে তিনি স্ব-সম্মানে বিদায় গ্রহন করেন এবং শ্রীকুটা স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন পরবর্তীতে, ঐ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি আরেকটি চাটপাড়া এলাকায় আইডিয়াল নামে একটি হাইস্কুল করেন। (তথ্যসূত্র- ২০১৪ইং সালের সাহিত্য ম্যাগাজিন “আলোড়ণ”)।

    স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন, মো: মনিরুল হক, এরই ধারাবাহিকতায় মো: শাহাবুদ্দিন, আব্দুল জব্বার, গোলাম হোসেন, মসয়ূদুল হাসান, মোহাম্মদ সাইদ, গফফার আহমেদ, আব্দুল মুছাব্বির, অমিয়াংশু শেখর ভট্রাচার্য, গাজীউর রহমান সহ নাম না জানা আরো অনেকেই এবং বর্তমানে ২০১৭ ইং সালের ২০ই মার্চ থেকে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন, মো: বদিউজ্জামান, বি এস এস সম্মান এম এস এস, বি এট।

    ১৯৯৫ সালে রাজার বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের সেন্টারের অনুমোদন আনতে ব্যাপক ভূমিকায় ছিলেন, মরহুম সাবু চৌধুরী, আহম্মদাবাদ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আব্দুল লতিফ, মিরাশী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কাশেম, মো: ওয়াহিদ ভূইঁয়া, মোতাব্বির হোসেন সহ নাম না জানা গন্যমান্যব্যক্তিবর্গ ও এলাকাবাসী।

    এ প্রতিষ্ঠানের অনেক ছাত্র/ছাত্রী রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। তৎকালে বিদ্যালয়টি এতটাই প্রসিদ্ধ ছিল যে, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার রাজার বাজার এলাকার বাইরে থেকেও অনেক শিক্ষার্থী এ বিদ্যালয়ে পড়তে আসতো। আগে এ অ লের রাস্তা ভালো ছিল না। যাতায়াতের জন্য গাড়ি কিংবা রিক্সাও ছিল না। ফলে দূর দূরান্ত থেকে এমনকি ১৫/২০ মাইল দূর থেকেও পায়ে হেঁটে চাত্র/ছাত্রীরা এ বিদ্যালয়ে পড়তে আসতো। কম সংখ্যক ছাত্ররা বাইসাইকেল যোগে আসতো। তবে আমু-নালুয়া চা বাগানের ছাত্র/ছাত্রীরা শুধু ইঞ্জিল চালিত ট্রাক্টর দিয়ে আসতো, বর্তমানেও তারা আসে। বর্তমানে বিদ্যালয়টি এক শিফটে পাঠদান হয়। শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় এক হাজার। বিদ্যালয়ের সামনে রয়েছে সুবিশাল খেলার মাঠ।

    বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক মো: বদিউজ্জামান জানান. এখনো এ এলাকায় শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছে। শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে যে দানবীররা প্রতিষ্ঠানটি করে গেছেন ও যাদের অবদানের ফলে প্রতিষ্ঠানটি হয়েছে তারা প্রয়াত হলেও যুগ-যুগ ধরে তারা অমর এবং চির স্বরণীয় হয়ে থাকবেন হবিগঞ্জের চুনারুঘাটবাসী তথা সারাবাংলার দেশ বাসীর হৃদয়ে।