শ্রীমঙ্গলে ‘বিপদনাশিনী’ চক্রের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ

    0
    305

    স্থানীয় হিন্দু নের্তৃবৃন্দের ক্ষোভ,তদন্তে পুলিশ

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,০৩মার্চ,সাজন আহমেদ রানাঃ শ্রীমঙ্গলে সনাতন ধর্মের দেবী ‘বিপদনাশিনী’ নামধারী ও দাবীকারী শিপ্রা রাণী দেব’র কথিত আধ্যাতিক চিকিৎসা পদ্ধতি ও তার সংঘবদ্ধ গোষ্টির বিরুদ্ধে সাড়ে তিন বছরের কণ্যা শিশুর অপচিকিৎসার (বিজ্ঞানসম্মত নয়) কারনে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে মর্মে শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন হতভাগ্য কমলগঞ্জ উপজেলার গোপালনগর এলাকার বিশ্বজিৎ ঘোষ (৩৬)।

    গত ২২ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় বিশ্বজিৎ ঘোষ সাংবাদিকদের নিকট লিখিত অভিযোগে জানান, তার কণ্যা বৃদ্ধি রাণী ঘোষ চোখের রোগে ভুগছিল। মৌলভীবাজার বি.এন.এস.বি চক্ষু হাসপাতাল এবং জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ডাক্তার খায়ের আহমেদ চৌধুরী তার চিকিৎসা করেছিলেন।ডাক্তার রোগিনীর চক্ষু অস্ত্রোপচার এর জন্য মতামত ব্যক্ত করেন এবং ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে রেফার্ড করেন। কিন্তু, স্থানীয়লোক ও শ্রীকান্ত নামে এক প্রতারকের কাছ থেকে শুনে তিনি শ্রীমঙ্গলস্থ শিপ্রা রাণী দেব এর দ্বারস্থ হন।

    নিহত হতভাগা শিশু

    এতে কথিত ‘বিপদনাশীনি’ শিপ্রা রাণী ও তার ছেলেসহ চক্রের লোকজন তাকে ৩ মাসের মধ্যে মেয়ের আরোগ্য হবে এরুপ আশ্বাস দেন। ছোট্ট মেয়েকে চিকিৎসার বিধি অনুযায়ী শিপ্রা রাণীর আশ্রমে রেখে আসা হয়। কিছুদিন পর মেয়ের কোন উন্নতি না হওয়ায়, উন্নত ও সুচিকিৎসার জন্য নিতে চাইলে আমাকে ধর্মীয় বিধি-নিষেধ আছে এবং দেবী আশ্রয় করেছেন, তার আরোগ্য হওয়া শুরু হয়েছে ইত্যাদি বলে কালক্ষেপন করে। ইতোমধ্যে তারা আমার কাছ থেকে এক লক্ষ পঁয়ষট্টি হাজার টাকা গ্রহণ করে। গত ২০ ফেব্রুয়ারী শিপ্রা রাণীর বাড়িতে থাকাবস্থায় শিশু বৃদ্ধি মারা যায়।

    তিনি বিলাপের সুরে অভিযোগ করে বলেন, ‘ভূল চিকিৎসার ফাঁদে পড়ে, আমার মেয়ে বৃদ্ধি মারা গেল। বহন করতে হল মেয়ের লাশ। কেন আমি এ প্রতারকের ফাঁদে পড়ে আমার মেয়েকে এখানে নিয়ে এসে লাশ নিয়ে ফিরে গেলাম।’ একইভাবে, শ্রীমঙ্গলের রাশনা বেগম নামে এক মহিলাকে অপচিকিৎসার নামে বেশ কয়েকজন পুরুষ সহচর যারা তাকে দৈবিক চিকিৎসার নামে উপর্যুপরি আঘাত করে এবং এক পর্যায়ে রোগিনীর রক্ত¯্রাব হতে থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি শিপ্রা রাণীর বিরুদ্ধে শ্রীমঙ্গল থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। যা বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে বলে শ্রীমঙ্গল থানা সুত্রে জানা গেছে। বর্তমানে রাশনা বেগম সিলেটে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে সুত্রে জানা যায়।
    কে এই ‘বিপদনাশিনী দেবী’ দাবীকারী শিপ্রা রাণী দেব?

    নিহত শিশুর পুর্বের ছবি।

    অনুসন্ধানে জানা যায়, তিনি উত্তর ভাড়াউড়া এলাকায় পুর্বে বসবাস করতেন স্বামীসহ। সাংসারিক ঝামেলার দরুন শিপ্রা রাণীর স্বামী ভাইয়ের সাথে মনোমালিন্যর কারনে দক্ষিণ ভাড়াউড়া এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। শিপ্রা রাণী বীমা কোম্পানীতে চাকুরী করতেন। একসময়, তিনি তার বাড়িতে বিপদনাশিনী মন্দির স্থাপন করবেন বলে এলাকার বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নেন। মন্দির নির্মানের পর চাকুরী ছেড়ে তিনি নিজেই নিজেকে ‘বিপদনাশিনী দেবী’ আখ্যায়িত করেন। এলাকার জানাজানি হলে অনেকেই ধর্মকে ব্যবহার করে তার এসব কাজের বিরোধিতা করেন। কেউ কেউ আবার, বিপদনাশিনীর আশ্রয় ভেবে নিজেদের সমস্যা নিয়ে তার বাড়িতে ছুটে যান। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, তার সহচর হিসেবে কাজ করেন কুলাউড়ার শ্রীকান্তসহ কয়েকজন যুবক ও শিপ্রা রাণীর পুত্র জুয়েল দেব প্রমুখ। তারা মুলত প্রচার – প্রচারণায় কাজ করেন। শুধু তাই নয়, শিপ্রা রাণী নিজের স্বামী নারু দেবকে ‘পুত্র’ বলে আখ্যায়িত করেন এবং স্বামীকে মানসিক প্রতিবন্ধী হিসেবে গণমাধ্যমকর্মীদের নিকট জাহির করেন।
    এলাকাবাসীর বক্তব্যঃ
    নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকাবাসীর অনেকেই বলেন, এখানে মন্দির হয়েছে আমরা জানি। কিন্তু শিপ্রা রাণীর এই আচরণ বিধি মেনে নিতে পারি না বলে ঐ মন্দিরে আমরা যাই না। কিন্তু প্রতিনিয়তই বিভিন্ন স্থান থেকে বিপদগ্রস্থ মানুষ ছুটে আসেন তার কাছে। অনেক সময় দেখা যায় বাড়ি থেকে বের হয়ে তিনি ছুটতে থাকেন এবং তার পিছনে আট – দশজন যুবক ছুটতে থাকে। তার এসব কর্মকান্ড স্থানীয়রা ইউপি চেয়ারম্যান ভানুলাল রায়কে অবহিত করলে, তিনি শিপ্রা রাণীকে এসব কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার কথা বলেন। এমনকি হিন্দু ধর্মীয় পূজা বিধির ও রীতির তোয়াক্কা না করে নিজ ফর্মুলা মোতাবেক (ভুল পন্থায়) বিভিন্ন ধর্মীয় কর্মকান্ড করেন বলে স্থানীয় এলাকাবাসী সুত্রে জানা গেছে।
    শিপ্রা রাণীর ভক্তবৃন্দরা যা বলেনঃ
    শিপ্রা রাণীর উপকার প্রত্যাশীদের (ভক্তবৃন্দ) মধ্যে রয়েছেন দেশের বিভিন্ন জায়গার সাধারণ মানুষ, সমাজের বহুস্তরের পেশাজীবি, ব্যবসায়ী, প্রবাসী, সরকারী চাকুরীজীবিসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা। প্রবাসী একজন ভক্ত বিগত ২৪ ফেব্রুয়ারী এ প্রতিবেদকের ফোনে বিদেশ থেকে ফে ুগঞ্জের বিজন কুমার বর্ধন নামে একজন ফোন করে, শিপ্রা রাণীর সম্পর্কে সাফাই বর্ণনা করেন। এখানে মিথ্যা কিছু নাই বলে জানান। এমন কি পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন সংবাদ সম্মেলন করেননি শিপ্রা রাণী বা অন্য কোন পক্ষ। এছাড়া, শিপ্রা রাণীর সাথে থাকা আরো কয়েকজন ভক্ত দাবীকারী ব্যক্তি শিপ্রা রাণীর মধ্যে ‘বিপদনাশিনী দেবী’ রয়েছেন বলে দাবী করেন।
    পরবর্তীতে, এ বিষয়ে সরেজমিন অনুসন্ধানে নারু দেব’র বাড়িতে গেলে গণমাধ্যমের ক্যামেরায় তার কর্মকান্ডের বিবরণ উঠে আসে। তিনি, স্বল্পবসনা হয়ে দৃষ্টিকটুভাবে নাচেন এবং নাচের এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার চিত্র দেখা যায়। শুধু তাই নয়, তিনি গণমাধ্যমকর্মীদেরকে জাপটে ধরেন এবং ‘পুত্র’ বলে আখ্যায়িত করেন। ধর্মীয় কিছু কথাবার্তা বলে অভিযোগের বিষয়ে বলেন, ‘শিশু বৃদ্ধির মৃত্যু মেয়ের বাবার কর্মফল এবং এটি বিশ্বজিৎ, বিশ্বজিৎ এর বোন মুন্না, কাকাতো ভাই সমীরণকে তিনি অবহিত করেন শিশুটির মৃত্যুর পুর্বেই।

    এক্ষেত্রে ‘জগৎ জননী’ তাকে জানিয়েছেন বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘তোর বাচ্চা সুস্থ হবে ৬ মাসের মধ্যে, যা করে জগতের জননী, মানুষে কোন কিছু করে না। আবার তিনিই বলেন, ‘অমবস্যার আগে মা আমাকে সাড়া দিয়েছেন, শিশু বৃদ্ধি প্রাণ ত্যাগ করবে। আমি বিশ্বজিৎকে গলা জড়িয়ে বলি, বাবা বিশ্বজিৎ তুই ভেঙ্গে পরিস না, এক বৃদ্ধি মারা গেলে হাজারো বৃদ্ধি পাওয়া যাবে। মাত্র ১০ মাস ১০ দিন লাগবে। আর সেদিনই ২১ টি মোমবাতি চেয়েছি। মন্দিরে জ্বালিয়ে দেবার জন্য। এরপর আমি তাকে বুকে জড়াইয়া বলি, তোর বৃদ্ধি ভালো নায়’। কিন্তু বিশ্বজিৎ ঘোষ এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের অবহিত করায় বক্তব্যের একপর্যায়ে তিনি রাগত স্বরে মেয়েটির পিতাকে (বিশ্বজিৎ ঘোষকে) অভিশাপ দিতে থাকেন।
    সাংবাদিকদের সাথে আলাপের সময় তার সাথে থাকা সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট নেপাল পরিচয় দেয়া এক ব্যক্তি বলেন, সরকারী – বেসরকারী বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ তার ভক্ত রয়েছেন এবং তিনি উপকার পেয়েছেন বলে জানান তবে তিনি এও বলেন, অনেকেই উপকারের কথা স্বীকার করেন না।
    শ্রীকান্ত নামে শিপ্রা দেবীর সহচর বলেন, ঐ শিপ্রা রানীর বাসায় যেকোন ব্যক্তি দিবা রাত্রি থাকতে পারেন। বিভিন্ন সময় শতব্যক্তি এখানে থাকেন বলে জানা যায়। ভক্তরা এখানে দান করেন। এবং পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন।
    চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা সম্পর্কে এ প্রতিবেদকের সাথে শ্রীকান্ত আলাপকালে বলেন, ‘আমি দোষী নায়, আমি দোষের কিছু দেখি না, এখন যদি আল্লায় আমাকে জেল- ফাঁসি দিলাইন, আমারে নেয়গি, তাইলে কইমু আলহামদুলিল্লা।’ তিনি এখানে উনিশ -বিশ আছে স্বীকার করে, সংবাদকর্মীদের সংবাদ প্রকাশে বিরত থাকার জন্য অনুনয় বিনয় করেন এবং একপর্যায়ে প্রতিবেদককে ঘুষ দেবার প্রস্তাব করেন।
    কুলাউড়া উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতারক শ্রীকান্ত কুলাউড়ায় একটি দোকানে চাকুরী করত। পরবর্তীতে সে কয়েক লক্ষাধিক টাকার দেনার দায়ে সেখানে টিকতে না পেরে সে শ্রীমঙ্গলে এসে এ প্রতারণামুলক কাজে যোগ দেয়। ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে গ্রামীন এলাকার সহজ – সরল লোকদেরকে চটকদার কথাবার্তার মাধ্যমে বিভ্রান্ত করে শিপ্রা রাণীর নিকট পাঠায়।
    এ ব্যাপারে জানতে শ্রীমঙ্গল হিন্দু – বৌদ্ধ – খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি শ্রী অজয় দেব প্রতিবেদককে বলেন, এ ঘটনা সম্পর্কে আমরা খোঁজ নিয়েছি। এগুলো বিশ্বাস যোগ্য ব্যাপার নয়। হিন্দু (সনাতন) ধর্মে এমন কোন বিধান নাই। আমরা পূজা ব্যতীত অন্য সব ধরনের কর্মকান্ড সম্পুর্ণ বন্ধ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছি। প্রয়োজনে প্রশাসনের সহযোগিতা গ্রহণ করা হবে। ইতোমধ্যে সাধারণ সম্পাদক সুশীল শীলকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে’
    এ বিষয়ে বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. বিনেন্দু ভৌমিক প্রতিবেদককে বলেন, চিকিৎসা সাধারণত স্বীকৃত ডাক্তারের নিকট থেকে নেয়া উচিত। চিকিৎসা বিজ্ঞান এ ধরনের পদ্ধতি সমর্থন করে না। ধর্মীয় বিশ্বাস ও চিকিৎসা বিজ্ঞান দুটি আলাদা বিষয়। শিশুটির পিতার উচিত ছিল বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করা।
    এসম্পর্কে আলাপকালে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, শ্রীমঙ্গল উপজেলা শাখার সহ -সাংগঠনিক সম্পাদক এসকে দাশ সুমন বলেন, ‘আমাদের সনাতন ধর্মের কিছু স্বার্থন্বেষী মহল, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় দেব দেবীর নামে প্রতারণামূলক অর্থ আত্মসাৎ করে, তারা ধর্ম নিয়ে সরল মানুষের মনে ভীতি স ার করে ও ধর্মভীরু মানুষকে দালাল চক্রের মাধ্যমে প্রতারিত করে, আমরা পূজা উদযাপন পরিষদসহ সনাতন ধর্মীয় সকল সংগঠন চাই, এ ধরনের কাজ যারা করে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হোক, যাতে মানুষ ধর্মের নামে প্রতারিত না হয়।’
    এ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান ভানু লাল রায় প্রতিবেদককে বলেন, ‘এ সম্পর্কে আমি অবগত। বিপদনাশিনী আমাদের দেবী, কোন মানুষ যদি নিজেকে দেবী দাবী করে তা আমরা (হিন্দু সমাজ) মানব না। সে ধর্মীয় নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে এসব করে যাচ্ছে। এখানে এক নারীকে চিকিৎসার নামে পিটানো হয়। পরে, ঐ মহিলা পুলিশের দারস্থ হলে শ্রীমঙ্গল থানা শিপ্রা রাণীর প্রতি নজর রাখছে। শিপ্রা রাণী চিকিৎসা বাবদ দশহাজার টাকা দিয়েছে। আমরা হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন সংগঠন এ বিষয়টি নিয়ে জরুরী ভিত্তিতে বসে প্রয়োজন স্বাপেক্ষে একটি প্রেস রিলিজ দিয়ে দেয়া হবে।’
    শ্রীমঙ্গল থানার অফিসার ইনচার্জ কে এম নজরুল এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এ ব্যাপারে অভিযোগ রয়েছে, এ বিষয়টির প্রতি আমরা গুরুত্ব সহকারে নজর রাখছি এবং তদন্ত চলছে। তদন্ত সাপেক্ষে পরবর্তী যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’