শ্রীমঙ্গলের দশরথ স্কুলের শিক্ষার্থীদের ঝুঁকিই যেন জীবন

    0
    297

    বিক্রমজিত বর্ধন,নিজস্ব প্রতিনিধি: মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভূনবীর ইউনিয়নের প্রাচীন বিদ্যাপিঠ ভূনবীর দশরথ হাই স্কুল এন্ড কলেজের সামনে কোমলমতি এসব শিক্ষার্থীরা এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করলেও সমাজের কর্তা ব্যাক্তিরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। প্রতিদিনই জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয় তাদের। তবে তাদের উদ্দেশ্য একটাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও শিক্ষার আলোয় নিজেকে আলোকিত করা।তাই প্রতিনিয়ত এভাবেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে যাতায়াত করে কোমলমতি এসব শিক্ষার্থীরা। খানাখন্দে ভরা রাস্তা আর যানবাহনের অপ্রতুলতায় চরম ভোগান্তিতে শ্রীমঙ্গল উপজেলার প্রাচীনতম এলাকা ভূনবীর, মির্জাপুর ও বৌলাশির গ্রামের শিক্ষার্থী ও স্থানীয় মানুষজন।

    সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় ভুনবীর থেকে মির্জাপুর পর্যন্ত প্রায় পনেরো কিলোমিটার রাস্তা খানাখন্দে ভরা সৃস্টি হয়েছে বড় বড় গর্তের! স্থানীয়দের অভিযোগ নিম্ন মানের উপকরণ ব্যবহার করার ফলে অল্প সময়েই সড়কের পিচ উঠে গিয়ে খানাখন্দ আর বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়। রাস্তার কারণে এ সড়কে যানবাহন কমে গেছে বলেও জানান স্থানীয়রা।

    রাস্তার করুন চিত্র

    সিএনজি চালক রহিম জানান,খানাখন্দে ভরা এই রাস্তায় গাড়ি চালালে প্রচন্ড ক্ষতির শিকার হন চালকরা। তিনি জানান গত একসপ্তাহে আমার গাড়ির এক্সেল ভেঙেছে দুইবার। বেশি ভাড়া এবং অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কথা স্বীকার করে এই চালক জানান,মাসে কমপক্ষে তিন থেকে চারবার গাড়ি গ্যারেজে নিয়ে গিয়ে মেরামত করতে হয় তাই বাধ্য হয়েই বেশি ভাড়া এবং অধিক যাত্রী বহন করি। ভাঙ্গাচুরা রাস্তা আর গাড়ি স্বল্পতার কারণে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছেন স্থানীয় ভূনবীর শ্রীমঙ্গল উপজেলার প্রাচীনতম বিদ্যাপিঠ ভূনবীর দশরথ হাই স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা।

    পরিবহন ব্যবস্থাটাই প্রধান সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে অত্র এলাকার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভূনবীর মির্জাপুর ও বৌলাশি এলাকায় আশির দশকের শুরুতে প্রথম বাস সার্ভিস চালু হয়। দেশের অন্যতম পর্যটন নগরী হলেও এখানে কেন্দ্রীয় কোন বাস টার্মিনাল নেই। কিন্তু ৩০ বছরেরও অধিক সময় ধরে এই এলাকার বাস গুলো ছেড়ে যাওয়ার জন্য শহরের অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় স্থাপিত হয় মির্জাপুর বাসষ্ট্যান্ড। যা আজও শ্রীমঙ্গল শহরের ষ্টেশন রোডে নতুন বাজারের পাশে মির্জাপুর বাসষ্ট্যান্ড নামে সর্বমহলেই সু-পরিচিত ছিল। কিন্তু এখন সেই বাস ষ্ট্যান্ড নাই এবং সেখান থেকে এখন আর বাস আসা যাওয়া করেনা।

    শ্রীমঙ্গল এর প্রাচীনতম বিদ্যাপিঠ ভূনবীর দশরথ হাই স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ ঝলক কান্তি চক্রবর্তী এই প্রতিনিধিকে জানান,কয়েক বছর আগে শিক্ষার্থীদের এই দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে মৌলভীবাজার জেলার সাবেক সুযোগ্য জেলা প্রশাসক (ডিসি) কামরুল হাসান মহোদয় দুটি বাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। যদিও সে সময়টাতে এ সড়কে সিএনজি এবং অন্যান্য গাড়ির চলাচল খুব একটা ছিলোনা। সে সময়ে ডিসি মহোদয়ের নির্দেশে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ লাগবে দুটি বাস চালু হয় কিন্তু তার কিছুদিনের মধ্যেই এই সড়কে সিএনজি গাড়ি চলাচল শুরু হয়।

    স্কুলে আগত শিক্ষার্থিদের ভিড়

    ফলে যাত্রী না পেয়ে ধীরে ধীরে সেই দুটি বাস সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়! সিএনজি অটো রিকসা, ইমা,সার্ভিস শুরু হওয়ার সাথে সাথে হারিয়ে যায় এ সড়কের বাস চলাচল। ৭/৮ বছর ধরেই এ সড়কের বেশিরভাগ যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন ভূনবীর দশরথ হাই স্কুল এন্ড কলেজ একটি পুরাতন ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ে প্রায় পনেরশ’র মতো শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে যদিও যানবাহন সংকটের কারণে অনেক শিক্ষার্থী প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে।

    এসব বিবেচনা করে শুধু মাত্র ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সরকারের তরফ থেকে যদি নির্ধারিত বিদ্যালয়ের জন্য একটি বাস সার্ভিস চালু করা যায় তাহলে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও থাকবে শতভাগ।

    তিনি আরো জানান,এখন পর্যন্ত আমাদের বিদ্যালয়ের ফলাফলও অত্যান্ত সন্তুষ্টজনক। ভূনবীর দশরথ হাই স্কুল এন্ড কলেজের গেইটে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন অভিভাবক জানান,এলাকার লোকজন অধিক ভাড়া দিয়ে আধুনিক যান বাহনে চড়ে শহরে আসা-যাওয়া করতে পারলেও সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে এ দুই ইউনিয়নের হাই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা। গাড়ী পাওয়া ও ভাড়ার জন্য অনেক গরিব ছাত্র-ছাত্রী প্রায়ই স্কুলে আসেনা। আর যারাই আসে তারাও অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে ছোট ছোট গাড়ির উপরে চড়ে স্কুলে আসে এবং বাড়ি ফিরে।

    এ ব্যপারে ভূনবীর দশরথ হাই স্কুল এন্ড কলেজের স্বনামধন্য শিক্ষক তারিক হাসান জানান, রাস্তার এই বেহাল দশাই প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভূনবীর থেকে মির্জাপুর পর্যন্ত সড়কে খানাখন্দ আর বড় বড় গর্ত তৈরি হওয়ায় চালকরা গাড়ি নিয়ে আসতে চান না এই সড়কে তিনি অভিযোগ করে বলেন নাম মাত্র যে কয়েকটি গাড়ি চলাচল করে তাদের কাছে অনেকটাই জিম্মি শিক্ষার্থী সহ স্থানীয়রা! দ্বিগুন ভাড়া আর ধারণ ক্ষমতার চেয়ে তিনগুন যাত্রী এবং শিক্ষার্থী নিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই স্কুলে আসা-যাওয়া করে শিক্ষার্থীরা।

    যদিও স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের গাড়ীর উপরে চড়তে প্রতিনিয়তই নিষেধ করেন। কিন্তু তারা তা মানছে না। কারন পরিবহন সংকটের কারণে স্কুল ছুঠির পর দ্রুত বাড়ি ফিরতেই ইমা এবং সিএনজি গাড়িতে করে ঝুঁকি নিয়েই তারা বাড়ি ফিরে এবং বিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করে! সরেজমিন ভূনবীর দশরথ হাই স্কুল এন্ড কলেজ এ গিয়ে দেখা যায় বিদ্যালয় ছুটির পর সিএনজি এবং ইমা গাড়ির যেখানে যাত্রী ধারণ ক্ষমতা পাঁচ থেকে সাতজন সেখানে একই গাড়িতে পনেরো থেকে আঠারো জন শিক্ষার্থী গাড়ির ছাদে ঝুলে কেউবা গাড়ির হ্যান্ডেলে ঝুলে ঝুঁকি নিয়েই বাড়ি ফিরছে।

    শামীম আহমেদ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থী সে জানায়,আমাদের বিদ্যালয় ছুটি হলে বাড়ী ফিরতে ফিরতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে যায় তাই দ্রুত বাড়ি ফিরতে আমরা ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করি প্রতিদিন।

    শিক্ষার্থী শামীম জানায়,কিছু ছাত্র গাড়ির পেছনের হ্যান্ডেল ও ছাঁদে বসে যেতে পারলেও ছাত্রীরা পড়ে বেশ বিপাকে। বাড়ী ফিরতে দেরী হলে অভিবাবকরা থাকেন দুশ্চিন্তায়। গাড়ী না পেয়ে অনেক ক্ষেত্রে মাইলের পর মাইল তারা পায়ে হেঁটে আসা যাওয়া করে। তাই মাননীয় প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ভূনবীর দশরথ হাই স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক তারিক হাসান বলেন,আমাদের মমতাময়ী শিক্ষাবান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে আমাদের জেলায় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী চা-শ্রমিক সন্তানদের বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার জন্য দুটি গাড়ি স্থায়ী বরাদ্ধ দিয়েছেন। যদি এই এলাকার ছাত্র/ছাত্রীদের কল্যানেও একটি বাস স্থায়ীভাবে বরাদ্ধ দেয়া হতো তবে শিক্ষার্থীদের আর এত দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। পাশাপাশি ভূনবীর থেকে মির্জাপুর পর্যন্ত রাস্তার বেহাল দশার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, অতি দ্রুত এই সড়কের সংস্কার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তখন শিক্ষার্থী এবং স্থানীয়দের এত ভোগান্তি পোহাতে হবেনা বলেও জানান তিনি।

    এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম এই প্রতিনিধিকে জানান,শিক্ষার্থীদের জন্য স্থায়ীভাবে গাড়ি বরাদ্ধের বিষয়টি শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে সুপারিশ নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ আবেদন করুক আমি তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি এসব অবহেলিত শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে তাদের জন্য একটি স্থায়ী গাড়ি বরাদ্ধ দেন তাহলে নিঃসন্দেহে এ এলাকার শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে তা হলে সবচেয়ে বেশি খুশি আমিই হবো কারণ এটা হবে আমারই সফলতা।

    মির্জাপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আবু সুফিয়ান চৌধুরী জানান,ইতোমধ্যে গন্ধর্বপুর থেকে সমশেরগঞ্জ পর্যন্ত সড়কের সংস্কার কাজের জন্য টেন্ডার হয়েছে এবং ওয়ার্ক অর্ডারও হয়ে গেছে খুব দ্রুতই কাজ শুরু হবে বলে জানান তিনি।