শিশুর কোমল হৃদয়ে যেন হিংসার বিষবৃক্ষ না লাগাই

    0
    227

    আতাউর রহমান মিটন: হায় রে আমার দেশ, এখানে মানুষ এখন মানুষকে কোপাচ্ছে! বরগুনায় স্ত্রীর সামনে কুপিয়ে হত্যা করছে স্বামীকে। সিরাজগঞ্জের উল্লপাড়ায় এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য ও তার মাকে, নারায়ণগঞ্জ এক স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ফেনীর নুসরাত হত্যার বিচার হতে না হতেই নরসিংদীতেও একটি মেয়েকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। শেষ পযন্ত নরসিংদীর সেই মেয়েটিকেও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রাণ দিতে হয়েছে। ঠাকুরগাঁও-এ মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় এক নার্স দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছেন এবং পরে হাসপাতালে মারা গেছেন। প্রতিদিন সড়কে ঝরে যাচ্ছে যে প্রাণগুলো সেগুলোর কথা বাদ দিলেও খুন, ধর্ষণ, অপঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনা করলে দেশটাকে যেন একটা মৃত্যু উপত্যকা মনে হচ্ছে! সবার মনে প্রশ্ন এমন হচ্ছে কেন? মানুষ এত অস্থির কেন? এটা কি কেবলই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নাকি এর বাইরেও কোন কারণ রয়েছে? আমি এই প্রশ্ন নিয়ে অনেকের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি। নানা জনের নানা মত।

     কেউ বলছেন, দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বৃদ্ধি পাওয়ায় অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। মানুষের মধ্যে হিং¯্রতা অতীতেও হয়তো ছিল কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি মনে হচ্ছে বেপরোয়া। অপরাধ এর সাথে জড়িতদের রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়া এবং অবশেষে সাজা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার দৃষ্টান্ত মানুষের মধ্যে অপরাধের প্রবণতা বাড়াচ্ছে। মানুষ কি কেবল অস্ত্র দিয়েই একজন আরেকজনকে কোপাচ্ছে? কেউ কেউ বলছেন, ‘ভাই আমরা তো কতভাবেই কোপানোর শিকার হচ্ছি। আপনার যদি ক্ষমতা না থাকে তাহলে এই সমাজে আপনি সর্বত্রই কোপের শিকার হবেন’! অফিসগুলোতে ঘুষের কোপের শিকার হচ্ছে সেবা প্রাথীরা, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কোপানলে ক্ষত-বিক্ষত সাধারণ মানুষ, বেকারত্বের লাঞ্ছনা-গঞ্জনার কোপে জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ দেশের যুব সমাজ, সংসারের অভাবের কোপে জর্জরিত নারীদের জীবন, বাবা-মায়ের শাসনের কোপে গুড়ো গুড়ো হয়ে যাচ্ছে সন্তানের ডানা মেলে ওড়ার স্বপ্ন, ধানের দাম না পাওয়ার কোপে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক! ভাপসা গরমে অতিষ্ঠ জীবন! প্রকৃতির এই গরম বেড়ে যাওয়া যেন আমাদের মেজাজ ও সু-শাসনের সামগ্রিক অভাবের প্রতিফলন হয়ে দেখা দিয়েছে। এর থেকে মুক্তির উপায় কি?
    যুগে যুগে আমাদের সঠিক পথে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন মনীষীরা আসেন এবং আমাদের পথ দেখান। বর্তমানের পরিস্থিতিতে এক উৎসুক যুবকের প্রশ্ন, দেশে কি এখন হেদায়েত করার মত মনীষীদের আগমন বন্ধ হয়ে গেছে? এই প্রশ্নের জবাবে সঙ্গের আরেকজন যুবক সাথে সাথে বলে উঠলেন, ‘আকাশে প্লেন ওড়ে কিন্তু যেখানে সেখানে প্লেন ইচ্ছেমত নামতে পারে না। প্লেন নামার জন্য উপযুক্ত এয়ারপোর্ট এর প্রয়োজন হয়। ঠিক তেমনি কোন সমাজে যখন গুণীর কদর কমে যায় তখন সেই সমাজে গুণীর জন্ম হয় না বা কমে যায়। আমরা যদি মানুষের মনে সততা, ভালবাসা, বিশ্বাস ও পরমত সহিষ্ণুতার এয়ারপোর্ট না বানাতে পারি তাহলে রহমতের বা বরকতের প্লেনটা নামতে পারবে না!
    যুবকটি বলে চলেছে, ‘আধুনিক বিজ্ঞানের মতে শিশুরা মায়ের পেটে থাকতেই শিক্ষাগ্রহণ শুরু করে। শিশুর মস্তিষ্কের গঠন ও বৃদ্ধি মায়ের পেটে থাকাকালীন থেকে শুরু করে ৩ বছর বয়স পর্যন্ত হয়ে থাকে। তাই শিশুর ভাল লাগা, মন্দ লাগা, রুচি, আদর্শ ইত্যাদি অনুভূতিগুলো তৈরিতে পরিবার ও মায়ের ভূমিকা বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে, মায়ের পেটে থাকাকালে শিশুরা মায়ের আনন্দ ও বেদনা, জীবনবোধ, আদর্শ ইত্যাদি থেকে শিক্ষা নেয় এবং পরবর্তিতেও সেইভাবেই প্রভাবিত হয়।’ যদিও তার অর্থ এটা নয় যে, খুনী ছেলেটি তার মায়ের কাছ থেকে খুন করা শিখেছে। এখানে খুনী ছেলেটির মানসিক নেপথ্য প্রভাব এর কথা বলা হচ্ছে। মায়ের জীবনে ঘটে যাওয়া বঞ্চনা, কষ্ট, বেদনা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব শিশুর জীবনকেও প্রভাবিত করে সেটাই এখানে বলা হচ্ছে। অনেক বেদনা, অনেক কষ্ট কিংবা সীমাহীন লোভ অনেক সময় সন্তানের মধ্যে নেতিবাচক চাহিদা ও জিঘাংসার জন্ম দেয়। সন্তান প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠে এবং নিজের অবচেতন মনেই সে অন্যকে আঘাত করতে আনন্দ পায়। মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় কিংবা মায়ের কোলে থাকা অবস্থায় পাওয়া ব্যথাতুর ও বিকৃত এই অনুভূতিগুলো সন্তানদের জীবনকে প্রভাবিত করে।

    বলা হয় শিশুরা পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। এই পরিবেশ এর শুরু কোথা থেকে? মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই পরিবেশ এর শুরু মায়ের পেটে থাকার সময় থেকে বিবেচনা করতে হবে। এবার আমরা যদি আমাদের নিজেদের জীবন ও আমাদের চারপাশের পরিবারগুলোর দিকে তাকাই তাহলে নিজেরাই বুঝতে পারব আমাদের মায়েরা কতখানি সুন্দর ও আনন্দময় পরিবেশ এর মধ্যে আছে। গর্ভবতি মায়েদের অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর। অনেক পরিবারে গর্ভবতি নারীদের কম খেতে দেয়া হয়। অনেক পরিবারে গর্ভবতি নারীদের পর্যাপ্ত বিশ্রাম হয় না, তারা কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য হয়। অনেক গর্ভবতি নারী স্বামীর আদর ও ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়। সেদিন গ্রামের নারীদের নিয়ে আয়োজিত এক কর্মশালায় শুনলাম দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারগুলোতে গর্ভবতি নারীদের বাবার বাড়িতে চলে যেতে বাধ্য করা হয় যাতে করে তাদের খাবার ও চিকিৎসার জন্য স্বামীর পরিবারের সদস্যদের কোন বাড়তি খরচ করতে না হয়। একই কর্মশালায় একটি মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলেছে, খাবারের অভাবে অনেক গর্ভবতি মা বিভিন্ন আত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি বেড়ায় যাতে করে তাদের একটু ভাল খাবারের বন্দোবস্ত হয় কারণ স্বামীর বা বাবার পরিবারে তাদের জন্য একটুখানি ভাল খাবার, নিদেনপক্ষে পেট ভরে খাবারের সুযোগ ঘটে না। কি নির্মম, কি নিষ্ঠুর এই অভিজ্ঞতা! তাহলে কল্পনা করুন, যে সন্তান পেটে থাকতেই মায়ের এই কষ্ট অনুভব করছে এবং নিজের মধ্যে পুষে রাখছে সেই সন্তান পরবর্তিতে বড় হয়ে হিং¯্র মানুষ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে না কি নেই ?
    আমরা অনেক কিছু করি, আমাদের আচরণের নেপথ্যে কি প্রভাব রয়েছে তা অনেক সময় আমরা নিজেরা ব্যাখ্যা করতে পারি না। কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা জানেন, আমাদের বর্তমানের সকল আচরণই অতীত জীবনের নানা ধরনের ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত। সে কারণেই বলা হয়, আমি বর্তমানে যা তা হচ্ছে আমার অতীতের কর্মফল! একই সূত্রে বলা হয়, আমার আগামী কেমন হবে তা নির্ভর করছে আমি বর্তমানে কি করছি তার উপর। আমাদের বর্তমান সমাজটা যদি আমরা ঠিক করতে না পারি, আমরা যদি সচেতন না হই, আমরা যদি পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সৌহার্দ্য এবং আন্তরিকতায় শান্তিময় পারিবারিক ও সামাজিক জীবন গড়তে না পারি তাহলে আমাদের আগামীদিন আরও বর্বর ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে! আমরা কি সেটা চাই?
    নেপোলিয়ন একদা বলেছিলেন, আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে একটি শিক্ষিত জাতি দেব। এই কথার দ্বারা বোঝা যায় মায়ের উপর নির্ভর করে একটি জাতি কিভাবে গড়ে উঠবে। বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শনেও নারীদের প্রতি সদয় হওয়ার তাগিদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তোলার জন্য সমাজের নারীদের, বিশেষ করে মায়েদের দিকে নজর দিতে হবে। মেয়েদের ও মায়েদের জন্য সুন্দর ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে, তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলে এবং তাদের সাথে সব সময় সদাচরণ করা হলে আমরা একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে পারব। পবিত্র কোরান শরীফে সুরা নাহল – এ সংক্রান্ত একটি আয়াতই নাযিল করা হয়েছে। হাদিসে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কন্যা সন্তানের প্রতি সদয় থাকবে এবং তাদের প্রতিপালন করবে তাদের জন্য তিনটি পুরস্কার নির্ধারিত রয়েছে। এক, জাহান্নাম থেকে মুক্তি, দুই. জান্নাতে প্রবেশের নিশ্চয়তা এবং তিন. জান্নাতে রাসুল (সঃ) এর সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য।

    আলোকিত সমাজ গড়ে তোলার জন্য আমাদের সন্তানদের মধ্যে আলো ছড়াতে হবে। তাদের মধ্যে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা গড়ে তোলার শিক্ষা দিতে হবে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, আজকের বাবা-মায়েদের একটা বড় অংশ সন্তানদের সফল হিসেবে দেখতে চান। তাদের সব সময় শেখান, সফলতার সূচক হচ্ছে ধন সম্পদের প্রাচুর্যময় জীবন! তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুভাষ বসু, মহাত্মা গান্ধী, হাজী মুহম্মদ মহসিন, বিদ্যাসাগর, আরজ আলী মাতুব্বর প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ কোন আদর্শ নয়। আমরা আমাদের সন্তানদের স্বার্থপর হতে শেখাই, দেশ ও সমাজের কল্যাণে নিবেদিত হতে শেখাই না। এই স্বার্থপরতা ও হীনতা ও ক্ষুদ্রতা আমাদের ভবিষ্যতকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আমরা যেন নিজেদের দিকে তাকাই এবং একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তোলার জন্য নিজেদের চিন্তা ও কর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করি। আমাদের ভবিষ্যত আমাদেরই গড়তে হবে। আমাদের সার্থকতা ওটাই যা আমরা আমাদের সন্তানদের শিখিয়ে যাচ্ছি।

    আমরা যেন আমাদের সন্তানদের কেবল গাদ গাদা বই পড়তে এবং পরীক্ষায় ভাল ফল করার জন্য চাপ না দেই। আমরা যেন ওদের উদ্বুদ্ধ করি জীবন সম্পর্কে সচেতন হতে। আমরা যেন তাদেরকে সত্যিকারের আলোর সন্ধান দিতে পারি। আমরা যেন তাদেরকে শেখাই, সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায় কিন্তু কোন কিছুর জন্যই সত্যকে ত্যাগ করা যায় না! আমাদের সন্তানদের টাকা কামানোর মেশিন বানানোর আগে আমরা যেন মনে রাখি, আমাদের সার্থকতা কোথায়। বগুড়ার সাবেক পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক এর ফেসবুক ওয়াল থেকে আমি নীচের ঘটনাটা জেনেছি। আমার বক্তব্যের স্বার্থে আমি সেটা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

    কিরজেইডা রডরিগুয়েজ নামের একজন বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার শরীরে ক্যান্সার নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে লিখেছেন, “পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ব্রান্ডের গাড়িটি আমার গ্যারাজে পড়ে আছে। কিন্তু আমাকে বসে থাকতে হয় হুইল চেয়ারে। সব রকমের ডিজাইনার কাপড়, জুতো, দামি জিনিসে আমার গৃহ ভরপুর। কিন্তু আমার শরীর ঢাকা থাকে হাসপাতালের দেয়া সামান্য একটা চাদরে। প্রাসাদের মতো আমার বাড়ি কিন্তু আমি শুয়ে আছি হাসপাতালের টুইন সাইজের একটা বিছানায়। ব্যক্তিগত জেট প্লেনে আমি যেখানে খুশি সেখানেই উড়ে যেতে পারতাম। কিন্তু হাসপাতালের বারান্দায় যেতেও এখন আমার দুজন মানুষের সাহায্য নিতে হয়। পৃথিবীব্যাপী ভরপুর নানা খাবার আর পানীয় থাকলেও দিনে দুটো পিল আর রাতে সামান্য  স্যালাইন আমার খাবার। আমার চুলের সাজের জন্য সাতজন বিউটিশিয়ান ছিলো-আজ আমার মাথায় কোনো চুলই নেই। এই গৃহ, এই গাড়ি, এই জেট, এই আসবাবপত্র, এতো এতো ব্যাংক একাউন্ট, এতো সুনাম আর এতো খ্যাতি এগুলোর কোনো কিছুই আমার আর কোনো কাজে আসছেনা। এগুলোর কোনো কিছুই আমাকে একটু আরাম দিতে পারছেনা। শুধু দিতে পারছে- প্রিয় কিছু মানুষের মুখ, আর তাদের স্পর্শ।সুতরাং আমরা যদি সুখী হতে চাই, সুন্দর সমাজ চাই আর নিরাপদ ভবিষ্যত গড়ে তুলতে চাই তাহলে আমাদের লোভাতুর চিন্তায় পরিবর্তন আনতে হবে। মায়া, মমতা, ভালবাসা, পারস্পরিক নির্ভরশীলতায় আমাদের বাঁচতে শিখতে হবে। আমাদের সন্তানদের মধ্যে স্বার্থচিন্তার চাইতে পরার্থপরতার প্রেরণা জাগিয়ে তুলতে হবে। ছোট্ট শিশুর কোমল হৃদয়ে আমরা যেন হিংসার বিষবৃক্ষ না লাগাই। সকলের মঙ্গল হোক। সুন্দর ও নিরাপদ হোক আমাদের আগামী।দৈনিক করতোয়া
    লেখক : সংগঠক-প্রাবন্ধিক
    miton2021@gmail.com
    ০১৭১১-৫২৬৯৭৯