শিবিরের ‘সুইসাইড স্কোয়াড’

    0
    442
    একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটক জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার বানচাল করতে বিগত কিছুদিন ধরে দেশজুড়ে সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির।
    চলমান এ সহিংসতাকে আরো জোরালো করতে স্বরূপে ফিরছেন এ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এজন্য প্রস্তুত করা হয়েছে প্রশিক্ষিত ক্যাডার। আর ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সহিংসতার মাধ্যমে রায় ঠেকাতে গঠন করা হয়েছে প্রশিক্ষিত ‘সুইসাইড স্কোয়াড’।
    নগরীর বাইরে অবস্থিত সীতাকুণ্ডের পাহাড়ি এলাকা কুমিরায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসসহ নগরী ও জেলার বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘদিনের বৈঠক ও প্রশিক্ষণ শেষে শিবির ক্যাডাররা নাশকতা সৃষ্টির জন্য এখন নগরীর বিভিন্ন স্থানে জড়ো হচ্ছেন বলে একাধিক গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে।
    নাশকতার আশংকায় নগরজুড়ে অতিরিক্ত চেকপোস্ট বসানোর পাশাপাশি শিবির নিয়ন্ত্রিত কলেজ ও মেসগুলোতে কড়া নজরদারি রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার প্রকৌশলী বনজ কুমার মজুমদার।
    অনুসন্ধানে জানা যায়, শিবির মসজিদভিত্তিক ‘শব বেদারি’ কর্মসূচির মাধ্যমে ‘বিবেকশূন্য করে ধর্মের প্রতি আবেগ বাড়িয়ে’ এ স্কোয়াড গঠন করা হয়েছে। শিবিরের মগজ ধোলাই করে হত্যার মতো কর্মকাণ্ডে কর্মীদের নিয়োজিত করার কর্মসূচি হচ্ছে ‘শব বেদারি’। এই কর্মসূচির কর্মীদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে শিবিরের ‘সুইসাইড স্কোয়াড’।   
    ফারসি শব্দ ‘শব বেদারি’ অর্থ নিশিযাপন করে ইবাদত। মধ্য রাত থেকে ভোর পর্যন্ত দলীয় কর্মীদের জিকির ও ধ্যানের মাধ্যমে এ কর্মসূচিটি পালন করে জামায়াত-শিবির। প্রচার করা হয় নিশিযাপন করে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভ করতে জিকির ও ধ্যান করা হবে। এ ধরনের কথা বলে জামায়াত-শিবির সমর্থকদের জড়ো করা হয়। জামায়াতের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নেতারা এ কর্মসূচি পরিচালনা করেন। গভীর রাতে মসজিদের ভেতরে শুরু হয় ‘শব বেদারি’ কর্মসূচি। জিকির ও ধ্যানের মধ্যে আবেগময় ধর্মীয় বক্তব্যের মাধ্যমে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী যুবকদের আবেগ বাড়িয়ে দেয়া হয়।
    অনুসন্ধানে জানা যায়, ‘শব বেদারি’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের বলা হয় দ্বীন কায়েমের জন্য যে কোনো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে মৃত্যু হলে সে মৃত্যু শহীদের মর্যাদা পাবে অবধারিতভাবে! দীর্ঘক্ষণ জিকির ও ধ্যান করার পর অংশগ্রহণকারীরা শেষ রাতের মোনাজাতে দু’হাত তুলে আন্দোলন করতে গিয়ে শহিদী মৃত্যু কামনা করেন। মূলত ‘শব বেদারি’ কর্মসূচির মাধ্যমে যুবকদের ‘বিবেকশূন্য করে আবেগকে বাড়িয়ে দেয়ার’ কাজটি করা হয়।
    জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে ‘শব বেদারি’ কর্মসূচির মাধ্যমে গঠন করা হয়েছে এ ‘সুইসাইড স্কোয়াড’। সাঈদীর রায় বিপক্ষে গেলে দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে জামায়াত-শিবির। এ সময় এ ‘সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্যদের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
    দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, বাঁশখালী, মহেশখালী এলাকায় স্কোয়াডের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা যায়।
    এ প্রসঙ্গে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার প্রকৌশলী বনজ কুমার মজুমদার (ক্রাইম ও অপারেশন) বলেন, ‘সুইসাইড স্কোয়াড গঠন সম্পর্কে আমাদের কাছে তেমন কোন তথ্য নেই। তবে তালিম তরবিয়ত কর্মসূচি তাদের অনেক দিন আগে  থেকেই আছে। এ কর্মসূচিতে মূলত শিবির কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তবে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় তাদের পাওয়া যায়নি।’
    এদিকে ‘তালিম তরবিয়ত’ এই আরবি শব্দ দুটির আভিধানিক অর্থ ‘জ্ঞান ও ভদ্রতা’ হলেও জামায়াত-শিবির এ শব্দ দুটিকে আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হিসেবে ব্যবহার করছে। এ কর্মসূচির কর্মীদেরই নিয়েই জামায়াত-শিবির গঠন করছে রাজপথের ক্যাডার বাহিনী।  
    অনুসন্ধানে জানা যায়, জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির ১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে ‘তালিম তরবিয়ত’ কর্মসূচি চালু করে। গোপনীয়তা রক্ষার মাধ্যমে দলের অগ্রসর কর্মী, সাথীপ্রার্থী কিংবা সাথীরা ‘তালিম তরবিয়ত’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে থাকেন। দলীয়ভাবে বিশ্বস্ত না হলে এ কর্মসূচিতে সুযোগ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
    কর্মসূচি শুরু হওয়ার ১০/১৫ মিনিট আগে অংশগ্রহণকারীদের প্রশিক্ষণের স্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেয়া হয়। নির্জন স্থান বেছে নিয়ে মধ্যরাতে চলে এ প্রশিক্ষণ। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের ফোরকানিয়া মাদ্রাসা কিংবা জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত ক্লাবঘরগুলোতে এ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালিত হয়। আগে কর্মসূচিতে দলের বিশ্বস্ত কর্মীদের আত্মরক্ষার কৌশল, মার্শাল আর্ট ও ককটেল তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। কিন্তু বর্তমানে এ কর্মসূচিকে অনেক আধুনিকায়ন করা হয়েছে।  সেখানে আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার ও বহন করা, ককটেল তৈরি, ককটেল ছুঁড়ে মারা, প্যারাসুট লঞ্চারের ব্যবহার ও প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করার প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজনের নেতৃত্বে ‘তালিম তরবিয়ত’ কর্মসূচির গ্রুপ গঠন করে ১৬ থেকে ২৪ বছরের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সহিংসতার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। শিবিরের প্রতিটি শাখার ‘ছাত্রকল্যাণ সম্পাদক’ মূলত এ কর্মসূচি তদারকি করে থাকেন।
    অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, শিবিরের পাঁচলাইশ পূর্ব-পশ্চিম, বাকলিয়া, কোতোয়ালী, চান্দগাঁও, বায়েজিদ, হালিশহর, ডবলমুরিং, বন্দর, পতেঙ্গা, কর্ণফুলী, হাটহাজারী দক্ষিণ, মোহরা উত্তর, মোহরা দক্ষিণ, চান্দগাঁও পূর্ব, পূর্ব ষোলশহর, বাকলিয়া থানা, বায়েজিদ  পাঁচলাইশ পূর্ব, পাঁচলাইশ পশ্চিম, জালালাবাদ উত্তর ও জালালাবাদ দক্ষিণ, পশ্চিম ষোলশহর উত্তর, পশ্চিম ষোলশহর দক্ষিণ, চকবাজার, চকবাজার দক্ষিণ, কোতোয়ালী দক্ষিণ, দেওয়ান বাজার, আলকরন শাখা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির নিয়ন্ত্রিত প্রতিটি হল, চট্টগ্রাম কলেজ, মহসিন কলেজ, চুয়েট, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও আলিয়া মাদ্রাসা হোস্টেল শাখা।
    নগরী ছাড়াও দক্ষিণ চট্টগ্রামের জামায়াত নিয়ন্ত্রিত সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়ার জামায়াত নিয়ন্ত্রিত তিনটি প্রাইভেট ক্লিনিক, বান্দরবান সদরের জামায়াত নিয়ন্ত্রিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাঁশখালীর শেখেরখীল ও চাম্বল ইউনিয়ন শিবির শাখায় নিয়মিত ‘তালিম তরবিয়ত ও শব বেদারি’ কর্মসূচি পরিচালিত হয় বলে অনুসন্ধানে জানা যায়।
    গত ৫ ফেব্রুয়ারি নগরীর অলংকার মোড় ও বহদ্দারহাট এলাকায় পুলিশের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় অধিকাংশ স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রকে অংশ নিতে দেখা গেছে। গত শুক্রবার দুপুরে হেফাজত ইসলামের ব্যানারে চট্টগ্রাম জুড়ে চালানো তাণ্ডবেও দেখা গেছে শিবির ক্যাডারাদের। তারা ইটের টুকরো ও লোহার পাইপভর্তি ব্যাগ পিঠে নিয়ে সংঘর্ষে অংশ নিয়েছিল বলে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানিয়েছে।