শব্দকরদের জীবনযাত্রা নাকি শ্মশানযাত্রা ?

    0
    482

    শাব্বির এলাহী,কমলগঞ্জ থেকেঃ “বাড়ীর পাশে আরশীনগর সেথায় পড়শী বসত করে।” কমলগঞ্জের আদমপুরে আমার বাড়ীর পাশে সে রকম কোন আরশীনগর নেই।আছে বাংলাদেশের এক অস্পৃশ্য,নিম্নবর্ণের জাতিগোষ্ঠীর বসবাস।যা স্থানীয়ভাবে ডুকলা গাঁও বা শব্দকর পাড়া নামে পরিচিত। আদমপুরের উত্তরভাগ ও মধ্যভাগ গ্রাম ছাড়াও এ উপজেলার ৩৫টি গ্রামে ৯০০ শব্দকর পরিবারে প্রায় পাঁচ হাজার সদস্য রয়েছে বলে জানা যায়।

    সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠী শব্দকর স্থানীয়ভাবে হিন্দু-মুসলমানদের কাছে অচ্ছুৎ। তাদের কারও ঘরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। অথচ তারা এ অঞ্চলের আদি জনগোষ্ঠী বলে ধারণা করা হয়। এ জনগোষ্ঠীর মূল পেশা বিভিন্ন উৎসবে বাজনা বাজনো। নাগরিক জীবনে উৎসবের সংখ্যা কমে আসায় পিতৃপুরুষের পেশা ছেড়ে এখন কৃষিকাজের দিকে অধিক ঝুঁকছে তারা। তবে ফসলের সময় বাদে অন্যসময় বেশির ভাগই দিনমজুরি করে।

    রিকশা চালানো থেকে ভিক্ষাবৃত্তিও করতে হয় কারও কারও। বন্যাত্তোর শব্দকর পাড়ায় সরজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, উত্তরভাগ,মধ্যভাগ দুই গ্রামে দেড়শো পরিবারের বসবাস।পল্লী বিদ্যুৎ বা সৌর বিদ্যুতের আলো অধিকাংশ বাড়ীতে না পৌছাঁলেও এ পাড়ার একশ ছেলেমেয়ে স্থানীয় প্রাইমারী স্কুল, হাই স্কুল ও কমলগঞ্জ গণ মহাবিদ্যালয়ে পড়ছে।

    রিকশা চালক রসু ও গৌরা শব্দকরের দুই ছেলে কলেজ শিক্ষার্থী রন ও নকুল শব্দকর জানালো, কলেজ থেকে উপবৃত্তি আর বিনা বেতনে পড়ার সূযোগ পেলে তারা উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। ক্ষুধা আর অপুষ্টিতে হাড্ডিসার শব্দকর মানুষের মতো ঘর বাড়িও যায় যায় অবস্থার।সাম্প্রতিক বন্যার ভয়াবহতা এদের উপর দিয়ে গেলেও হাতে গোনা কয়েকজন ১৫ / ১৬ কেজি করে চাল পেলেও বাকীরা রিকশার চাকা কিংবা ভিক্ষার চালেই জীবনের ঘানি টানছে।

    নিপেন্দ্র শব্দকর,সোমা শব্দকরদের সাথে আলাপচারিতায় জানা গেলো,কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মাহমুদুল হক ও লেখক গবেষক আহমদ সিরাজ মাঝে মাঝে তাদের খোঁজ খবর নেন। তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য একটি বাড়ী একটি খামার প্রকল্প গ্রহণ করেছেন।নেপাল শব্দকর, জিতেন্দ্র শব্দকর,আরতি শব্দকর,সমু শব্দকর জানালেন,বন্যার পর জনপ্রতিনিধিরা এসে অবশ্য বিধ্বস্ত ঘরের ছবি তুলে নিয়েছেন, জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপিও নিয়েছেন, পরে কেউ কেউ ফটোসেশন করে কয় কেজি চাল, আড়াইশ ডাল, আড়াইশ সয়াবিন, আড়াইশ পিয়াজ আর দেশলাই মোমবাতি দিয়ে গেছেন ।

    আহমেদ সিরাজ জানান,মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে এদের সংখ্যা বেশি। কমলগঞ্জেই সংখ্যা হাজার পাঁচেক। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা হাজার পঁচিশেক বলে জানা গেছে। দীর্ঘদিন ধরে এ ভূখণ্ডে বাস করা সত্ত্বেও তারা না পেয়েছে আদিবাসী কিংবা ক্ষূদ্র নৃ-গোষ্ঠীর স্বীকৃতি, না পেয়েছে বাঙালি হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার। নিম্নবর্ণের হওয়ায়, তারা হিন্দু সমাজে অস্পৃশ্য আর মুসলমানদের কাছে তারা নোংরা এক জাতি।ইন্টারমিডিয়েট পাস করেও সোমা শব্দকর জানে না,ক্ষূদ্র নৃ-গোষ্ঠী শব্দের যথাযথ মানে।

    তবু এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।এগিয়ে যাবে শব্দকরদের জীবন হয়তো ধূঁকে ধূঁকে শ্মশানের দিকে।