“শবে বরাত” প্রসঙ্গে কিছু কথা

    1
    659

    আমারসিলেট24ডটকম, ১৩জুনঃ কিছু আলেম “শবে বরাত” বিষয়ে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করছেন। তাদের কথার সার নির্যাস হল, শবে বরাতের তেমন কোন গুরুত্ব নেই। ইদানিং বেশ কিছু লেখা  ফেইসবুক সহ বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশ করা হচ্ছে। সকলের মত আমিও বিষয়টি নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। যদিও আমার জ্ঞান বুদ্ধি সীমিত। আমি আশা করি পাঠকদের বিশাল জ্ঞান থেকে নিজেকে কিছুটা হলেও সমৃদ্ধ করতে পারব ইনশা-আল্লাহ।

    যদিও আমাদের সবার জানার কথা, তবুও বলে রাখতে তো দোষ নেই  যে, ফার্সি ভাষায় ‘শব’ শব্দের অর্থ হয় রাত। আর আরবি ভাষায় বারাআত অর্থ ভাগ্য। আমরা পাক-ভারত-বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের আমল থেকে এই শব্দটি ফার্সি থেকে আমাদের ভাষায় গ্রহণ করেছি এবং ঐ রাতকে ‘শবে বরাত’ বলে আসছি। আরব জাহানে লাইলাতুল বরাত,লাইলাতুল দোয়া,নিম শা’বান,নিসফ্ শা’বান এবং মালয় ভাষাভাষীরা বলে নিসফু শা’বান।তুর্কি ভাষাভাষীরা বলে বিরাত কান্দিলি আর ভারতীয় উপমহাদেশে বলা হয় “শবে বরাত”।

    যারা লাইলাতুল বারাআত’(ليلة البراءة) অর্থাৎ শবে বরাতের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চান না, তাদের প্রথম কথা হলো যে, এই বিষয়ে বর্ণিত হাদিসে দুর্বলতা রয়েছে ! কিন্তু হাদিসে দুর্বলতা আছে এমন কথায় আমলের বেলায়  গ্রহন যোগ্য কতটুকু ?কেননা ‘দুর্বল’ শব্দটি হাদিস শাস্ত্রের একটি পরিভাষা এবং এদিক থেকে এখানে শাব্দিক অর্থ মূল বিষয় নয়।

    পবিত্র হাদিস শাস্ত্রে ‘দুর্বল’ শব্দটি ইসনাদ বা বর্ণনা-সূত্রে (narrative chain-এ)  প্রোথিত একটি বিষয়। একটি বর্ণনা-সূত্রে কোন বর্ণনাকারীর অবস্থানহাদিস বিশেষজ্ঞের মানদণ্ডে ‘দুর্বল’ অনুভূত হলে সেই ক্ষেত্রে তিনি এইপরিভাষা ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু মূল বিষয়টি যখন অন্যান্য বর্ণনাসূত্রের ধারাবিচরণ করে বার বার বর্ণিত হয় তখন উল্লেখিত দুর্বলতা অনেকাংশে সবল হয়ে যেতেপারে। তাছাড়া একটি বর্ণনা একজন হাদিসবেত্তার মূলনীতির আলোকে দুর্বল হতেপারে কিন্তু অন্য হাদিসবেত্তার মানদণ্ডে তা ততটুকু নাও হতে পারে এবং অপরদিকে অন্য ধরনের মর্যাদাও লাভ করতে পারে। বলা যায় যে রাবীর জোফ বা দুর্বলতার কারণে কোন হাদিসকে জঈফ (দুর্বল) বলাহয়, অন্যথায় (নাওজুবিল্লাহ) রাছূলসাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহে ওয়া সাল্লামের

    কোন কথাই দুর্বল হয় না। দুর্বল হাদিছের জো’ফ (দুর্বলতা) কম ও বেশী হইতে পারে। খুব কম হইলে উহা হাসানের নিকটবর্তী থাকে। আর বেশী হতে হতে তা এক সময় একেবারে ‘মাওজুতে’ (দুর্বলতায়) পরিণত হতে পারে। প্রথম পর্যায়ের জঈফ হাদিছ আমলের ফযীলত বা আইনের উপকারিতার বর্ণনায় ব্যবহার করা যাইতে পারে, আইন প্রণয়নে নয়।

        সংক্ষেপে, রেওয়াতের সূত্রের রাওয়ী (راو) যদি ‘দাবত/ضبط ’ (দৃঢ় স্মতি শক্তির) গুণ সম্পন্ন হন অর্থাৎ যদি তার স্মৃতিশক্তি এমন হয় যে তিনি শ্রুত বা লিখিত বিষয় স্মৃতিতে সুচারুরূপে ধারণ করতে সক্ষম হন, তাহলে এই বর্ণনাকারীকে ‘দাবেত’ বলা হয়, (এই শব্দদ্বয়কে ফারসির উচ্চারণি কায়দায় বাংলায় যথাক্রমে জবত ও জাবেতও বলা হয়) এবং বর্ণনাকারীর গুণ দাবতের কম হলে হাদিসকে ‘হাসান’ বলা হয়।কিন্তু বর্ণনাকারীর গুণ হাসানের নিচে হলে বর্ণিত হাদিসে দুর্বল পরিভাষা আসে।‘দুর্বল’ পরিভাষা  প্রয়োগের আরও বিভিন্ন কারণাদি রয়েছে। ইমাম হাফিজ ইবন হাজর আল-আসক্বালানীর দৃষ্টিতে একটি হাদিসের ইসনাদের সূত্রের ধারাবাহিকতায় বিচ্ছেদ ঘটলে বা কোন রাওয়ীর ব্যাপারে সমালোচনা থাকলে শাস্ত্রীয় আলোচনায় ‘দুর্বলতার’ কথা আনা হয়।

        ঘটনা এমনও হতে পারে যে একটি সূত্রে (narrative chain-এ) একজন বর্ণনাকারীর (রাওয়ীর) সামান্য স্মৃতি বিস্মৃতি লক্ষ্য করা গেছে, অথচ বর্ণনার সমষ্টিগত বিচারে বর্ণিত বিষয় (মতন) হাদিস বিশেষজ্ঞের কাছে ঠিকই আছে।তাই হাদিস বিশেষজ্ঞ ঐ বর্ণনার অর্থগত বিষয় বর্জন করেন না। এমন হাদিস নেক আমল বা আখলাক গঠন সম্পর্কিত হলে তার সঠিক ব্যবহার করেন। অধিকন্তু এমন হাদিসের প্রচার ও প্রশিক্ষণে আগ্রহীও থাকেন।

    শবে বরাত সম্পর্কে অনেক হাদিস রয়েছে। এদের অনেক গুলোর দুর্বলতা তীব্র নয়। তাই এই হাদিস গুলোর ব্যাপক বর্ণনার প্রেক্ষিতে শবে বরাতকে প্রামাণিক বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এটাই হচ্ছে হাদিস বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সাধারণ ঐক্যমত।

    কয়েকখানা হাদিস বর্ননা করা হলঃ

    ১। মধ্য শাবানের রাতে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিলোকের দিকে দৃষ্টি দান করেন এবং সবাইকে মাফ করে দেন কেবল মুশরিক ব্যক্তি ছাড়া ও যার মধ্যে ঘৃণা বিদ্বেষ রয়েছে তাকে ছাড়া।  বর্ণনায়, মুয়ায বিন্ জাবাল রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।((আল-মুনযিরী তাঁর আত-তারগীব ওয়াত-তারহীবে (২/১৩২)বলেন, “সহিস হাদিস”।আল-আলবানীর দৃষ্টিতেও হাদিসটি সহিহ। আস-সিলসিলাহ আস-সাহীহাহ (৩/১৩৫))

    ২।আল্লাহ তা’আলা মধ্য শাবানের রাতে (দুনিয়ার আসমানে) আসেন এবং সকলকেমাফ করে দেন কেবল সেই ব্যক্তি ছাড়া যার হৃদয়ে ঘৃণা বিদ্বেষ রয়েছে এবং যেব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরিক সাব্যস্ত করে (অর্থাৎ মুশরিক)। বর্ণনায়, আবুবাকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। ((ইবন হাজর আল-আসক্বালানী তাঁর  আল-আমাল আল-মুথলাক্বাহ  গ্রন্থে (ক্রম, ১২২) বলেন, “হাদিসটি হাসান যদিও কাসেম তাঁর চাচার সূত্র থেকে বর্ণনা করেছেন।”

    ৩। আল্লাহ তা’আলা মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে নামেন এবং কালবগোত্রের ভেড়িগুলোর লোমের সংখ্যার পরিমাণের চেয়ে বেশি লোকজনকে মাফ করে দেন।বর্ণনায়, আয়েশা বিনত আবি বাকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।  ((আল-আলবানী বলেন,”হাদিসটি অন্য সূত্রে সহীহ।”তাখরীজ মিশকাত আল মাসাবীহ, (ক্রম, ১২৫১), প্রণয়নে আল-আলবানী ।

    ৪। এক রাতে আল্লাহর রাসূল  সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহে ওয়া সাল্লাম নামাজ পড়তে দাঁড়ালেন। তাঁর সেজদা এতই দীর্ঘ হল যে আমার মনে হল তিনি নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছেন। অবস্থা এমন মনে হওয়ার আমি উঠলাম কিন্তু (পরক্ষণে) তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলির সঞ্চালন অনুভব করলাম এবংতাঁর নড়াচড়াও পেলাম। তাই আমি শুয়ে পড়লাম।তারপর তিনি যখন সেজদা থেকে মাথা তুললেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন বললেন, “আয়েশা,  তুমি কি মনে করেছিলে আমি অন্য কোথাও চলে গেছি?” আমি বললাম, “তা নয়, হে আল্লাহর রাসূল। তবে আপনারসেজদার দীর্ঘতার কারণে মনে হয়েছিল আপনার প্রাণ-বায়ু বেরিয়ে গেল কিনা।” তিনিবললেন, “তুমি কি জান আজ কোন রাত” ?  আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহে ওয়া সাল্লামই অধিক অবগত। তিনি বললেন, “আজ মধ্য শাবানের রাত। মহান আল্লাহ এই মধ্য শাবানের রাতেতাঁর বান্দাদের দিকে মনোনিবেশ করেন এবং যারা তাঁর মার্জনা চায় তাদেরকেমার্জনা করেন, আর যারা তাঁর রহমত প্রত্যাশা করে তিনি তা তাদেরকে দান করেন।তবে হিংসা বিদ্বেষীরা যেভাবে আছে তাদেরকে সেভাবেই রেখে দেন।” বর্ণনায়, আয়েশা বিনত আবি বাকর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।((বাইহাক্বী বলেন, “হাদিসটি উত্তম মুরসাল।” [মুরসাল হচ্ছে এমন হাদিস যার সনদে/সূত্রে শেষের দিকে কেউ বাদ পড়েছেন।]বাইহাক্বী প্রণীত, শুয়াবুল ঈমান, ৩/১৪০/৫ ))

    ৫। যখন মধ্য শাবানের রাত্র আসবে তখন তোমরা রাতের বেলায় ইবাদত কর এবংদিনের বেলায় রোজা রাখ। কেননা আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ার আসমানে আসেন এবং বলেনকেউ কি ক্ষমা প্রার্থী আছ, আমি তাকে ক্ষমা করব। কেউ কি রিজিক প্রার্থী আছ, আমি তাকে রিজিক দেব। কেউ কি বিপদে আপদে আছ, আমি তার পরিত্রাণ করব। এভাবেআল্লাহ আহবান করতে থাকেন যতক্ষণ পর্যন্ত না ফজরের সময় হয়।বর্ণনায়, আলীরাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।  ((আশ-শাওকানী বলেন, “হাদিসটির সূত্র দুর্বল।” তুহফাতুজ জাকিরীন, (ক্রম ২৪১) প্রণয়নে আশ-শাওক্বানী।

    ৬।আল্লাহ তা’আলা মধ্য শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। তিনি বিশ্বাসীদেরকে মাফ করেন ও অবিশ্বাসীদের ক্ষমা স্থগিত করেন এবংহিংসা-বিদ্বেষীদেরকে তাদের নিজ অবস্থায় রেখে দেন (সেদিনের জন্য যখন তারা সংশোধিত হয়ে তাঁকে ডাকবে)। বর্ণনায়, আবু সা’বাহ আল খাশানী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। (আল-মুনযিরী বলেন, হাদিসটির সূত্র সহীহ বা হাসান বা এই দু’য়ের কাছাকাছি।আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব, ৩/৩৯২)।

    আলো জ্বালানো, আতশবাজির এরকম উছিলা ধরে ইসলামে শবে বারাত নেই বলে কোন ভাল আমলের দিন বা রাত্রিকেকটাক্ষ করা শোভনীয় মনে হয়না।আর একটি কথা না বললেই নয়, ওই রাতকে যারাডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে বিদআত হিসেবে হারাম বা নাজায়েজ বলতে চান ? আপনারা যারা দিবারাত্র ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করেন সেটা কি বিদআত না ফরজেআইন? তবে আমাদের সকলেরই দায়িত্ব এই হওয়া উচিৎ যে যারা ঐ রাতে এখানে-সেখানেআলো জ্বালায়, আতশবাজি করে এগুলো বন্ধ করতে তৎপর হওয়া। ঐ রাতে নফল নামাজ, কোরান তেলায়াত, জিকির-আযকার, তসবীহ তাহলীল কবর জিয়ারত ব্যতীত যেন অন্য কোন ধরণের হারাম কাজের সুচনা না করা হয়।আল্লাহ অধিক জ্ঞাত।