লাউয়াছড়ায় পর্যটকদের ভিড়ে প্রকৃতির সুরক্ষা নিয়ে উৎকন্ঠা !

    0
    327

    “লাউয়াছড়াতে পর্যটকদের বাড়ছে চাপ,বিড়ম্বনার স্বীকার বন্যপ্রাণী,গাছপালা”

    আমার সিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,০২জুলাই,জহিরুল ইসলাম,নিজস্ব প্রতিনিধিঃ মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ও আংশিক শ্রীমঙ্গল অবস্থিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অধিক পরিমানে পর্যটকের ঢল নামছে।এতে করে পর্যটকদের পদাচারণে লাউয়াছড়াতে বন্যপ্রাণীরা বিড়ম্বনার স্বীকার হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে গাছপালা।

    এ বছর পাহাড় ধ্বসে কুলাউড়ার মাধবকুন্ড পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করায় লাউয়াছড়ায় পর্যটকের চাপ বাড়ছে। এই বনকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করায় বিশেষত ছুটির সময়ে মাত্রাতিরিক্ত পর্যটক বন্যপ্রাণির বিড়ম্বনার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যানবাহনের হুড়োহুড়ি, গাছ চুরি, বনবিভাগের স্বল্প সংখ্যক লোকবল, শুষ্ক মৌসুমে প্রাকৃতিক পানি, খাবার ও নিরাপদ বাসস্থান সংকট, এসব মিলিয়ে উদ্যানের জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতি সুরক্ষা নিয়ে রীতিমত উৎকণ্ঠা সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

    অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে লাউয়াছড়াকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে সরকার। উদ্যান ঘোষণার পর থেকে সেখানে পর্যটকদের ঢল নামছে। বনকে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলতে রেস্ট হাউস, নিসর্গ ও স্কেল সহায়তা প্রকল্পের আওতায় লাউয়াছড়ায় কয়েকটি ইকো-কটেজ, বাঘমারা এলাকায় স্টুডেন্ট ডরমিটরি, ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে প্রকৃতি সহ-ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রকৃতি ব্যাখ্যা কেন্দ্র স্থাপনের ফলে পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদ্যানের গাঁ ঘেষে বনজঙ্গল ও মাটি কেটে স্থাপিত হচ্ছে বিভিন্ন কর্টেজ।

    যার ফলে বনের ভেতরে দল বেঁধে মানুষের অবাধ বিচরন বন্যপ্রাণীর জন্য খাবার সংগ্রহ ও চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এসব বিভিন্ন কর্মকান্ডের কারনে বন্যপ্রাণীর খাবার ও আবাসস্থল বিনষ্ট হচ্ছে। যে কারণে খাবারের সন্ধানে জঙ্গলের দূর্লভ প্রাণীগুলো জনপদে ছুটে যায় অনেক সময় মানুষের হাতে ধরা পড়ে অথবা গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে। এছাড়াও জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে রয়েছে রেল ও সড়কপথ, বৈদ্যুতিক লাইন, যানবাহনের শব্দ, অধিক পর্যটকের হুড়োহুড়ি বনা লসহ ন্যাশনাল পার্কে অবস্থানরত জীববৈচিত্র্যকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। প্রতিনিয়ত অধিক পরিমাণে পর্যটকের আগমন, মাইক, হাল্লা-চিৎকার ও যানবাহনের শব্দে জাতীয় উদ্যানের শান্ত নিবিড় পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে।

    এ অবস্থায় পূর্বের মতো জীবজন্তু ও পশু পাখির দেখা সম্ভব হচ্ছে না বলে অনেকেই মন্তব্য করছেন। সম্প্রতি সময়ে পাহাড় ধ্বসে কুলাউড়ার মাধবকুন্ড পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করায় লাউয়াছড়ায় পর্যটকের চাপ বাড়ছে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারনা করছেন। মাধবকুন্ডে বছর হাজার হাজার পর্যটকের উপস্থিতি ঘটে। তাই এসব পর্যটকেরা লাউয়াছড়া উদ্যানে ভ্রমনে আসছে।

    লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে রাতের অন্ধকারে গাছ চুরি অব্যাহত হারে চলছে। কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে হাত করে লাউয়াছড়া, কালাপুর, বাঘমারা এবং চাউতলি বিট থেকে একটার পর একটা প্রাচীন গাছ কেটে ফেলে উড়ার করা হচ্ছে এখানকার মূল্যবান বৃক্ষ সম্পদ। বিশালায়তনের এই সকল বৃক্ষরাজি কেটে ফেলার ফলে পৃথিবী ব্যাপী মহাবিপন্ন উলুকসহ বিভিন্ন গাছ নির্ভর প্রাণীদের চলাচল এবং খাদ্য গ্রহণে তৈরি হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা। এভাবে ক্রমাগত গাছ কাটার ফলে এই চির সবুজ বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে।

    সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০০৯ সালের ১ লা নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ৫ লক্ষাধিকেরও উপরে দেশি-বিদেশি পর্যটক লাউয়াছড়া ভ্রমণ করেছেন। যা প্রাকৃতিক এই বন ও বন্যপ্রাণির জন্য হুমকির কারন। লাউয়াছড়ায় ২০০৬ সালে ৬৯টি উল্লুক ছিল, যা কিনা বাংলাদেশের কোনো একটি জায়গায় উল্লুকের সর্বাধিক সংখ্যা। উনিশ’শো আশির দশকেও বাংলাদেশে উল্লুকের সংখ্যা ছিল তিন হাজার, যা ২০০৬ সালে ২০০ তে নেমে এসেছে। লাউয়াছড়াতে উল্লুক ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও পাখির অভয়াশ্রম। বনভূমিটি এক সময়ে বিশালাকৃতির বৃক্ষরাজি সমৃদ্ধ ঘন প্রাকৃতিক বন থাকলেও গাছ চোর চক্রের আগ্রাসী থাবায় প্রকৃতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্থে।

    গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে এ পর্যন্ত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের কমপক্ষে ১০টি মায়া হরিণ লোকালয়ে ধরা পড়ে। অনেক রাতে আধাঁরে মায়া হরিণ ধরে খেয়ে ফেলছে , এর মধ্যে রেলপথে ও সড়ক পথে ৪টি মায়া হরিণ, গুইসাপ, দাঁড়াশ সাপ, বেন্ডেড ক্রেইট, ব্যাঙ, লিজার্ড, সবুজবরা সাপ, গন্ধগোকুল, গোল্ডেন জ্যাকেল, সিভিট, পেরিস ল্যাংঙ্গুর মোট ৪০টি বণ্যপ্রাণী মারা গেছে বলে জানান  শ্রীমঙ্গল বণ্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন।

    সম্প্রতি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী গবেষণা কাজে নিয়োজিত একটি দল গত ২০১৫ সালের ও ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বন্যপ্রানী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগে এক পরিসংখ্যান প্রদান করেন। ওই পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, সেপ্টেম্বর মাসে গোল্ডেন জ্যাকেল ১টি, ক্রিকেট ফ্রগ ২৫টি, ইসমিথ লিটিল ফ্রগ ২টি, মাইক্রো হাইলিফ ফ্রগ ৯টি, আনআইডেনটিফাইড ফ্রগ ১৩টি, চিকাল কিলব্যাক ৩টি, ব্লাকক্রেইট ১টি, বেন্ডেড ক্রেইট ১টিসহ মোট ৫৫ বন্যপ্রাণী মারা যায়। একই বছরের অক্টোবর মাসে মোট ৪৪টি মারা যায়। এর মধ্যে ছিল ক্রিকেট ফ্রগ ১৫টি, ইসমিথ লিটিল ফ্রগ ৪টি, মাইক্রো হাইলিফ ফ্রগ ১০টি, কপস ফ্রগ ৬টি, কমনট্রি ফ্রগ ৩টি, আনআইডেনটিফাইড ফ্রগ ৬টি।

    মৌলভীবাজার পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সৈয়দ মহসিন পারভেজসহ স্থানীয় পরিবেশবাদীদের মতে, সংরক্ষিত একটি বনে অধিক পরিমাণে পর্যটক বন্যপ্রাণির অবাধ চলাচল, খাবার ও আবাসস্থলে বিড়ম্বনার সৃষ্টি হবে। এটি রোধ করা প্রয়োজন। লেখক-গবেষক আহমদ সিরাজ, লেখক-সাংবাদিক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, জাতীয় উদ্যান ঘোষণা বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে জীববৈচিত্র্য রক্ষা প্রয়োজন।

    লাউয়াছড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণি) সাহাব আলী অত্যধিক পর্যটকের কারনে বন্যপ্রাণির বিড়ম্বনার কথা স্বীকার করে বলেন, অতিরিক্ত লোক আসলে নিয়ন্ত্রণে তাদের নিজস্ব লোকবল রয়েছে। নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে পর্যটকদের যেতে দেওয়া হয় না। ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রিত ট্যুরিজমের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

    বাংলাদেশ বণ্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সীতেশ রঞ্জণ বলেন , আগে পরিবেশ রক্ষা করতে হবে, তাহলে বন্য প্রাণী রক্ষা হবে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান বণ্যপ্রাণী অভয়াশ্রম ? নাকি এটা লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ? আনুমানিক ১৮৩৫ সালে সরকার এই বন কে রিজার্ভ ফরেস্ট ও ১৯৯৬ সালে লাউয়াছড়াকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষনা করে ।

    সেটা যদি বণ্যপ্রাণী রক্ষার জন্য করা হয় তাহলে সেখানে বনের ভিতরে পর্যটকদের বনভোজন ও পর্যটকরা আসা-যাওয়া বন্ধ করা হউক, আর সেটা যদি জাতীয় উদ্যান হয় তাহলে পর্যটক আসুক। পর্যটকদের আসা-যাওয়ার কারনে বনের বন্যপ্রাণীরা বনে থাকতে পারে না। বন উজাড় হবার কারন হিসেবে সীতেশ রঞ্জণ তিনি আরোও বলেন ,কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা ও এনজিও গুলার কারনে  গাছ চোররা বনের ভিতরে গাছ-পালা কেটে নিয়ে যাচ্ছে এতে করে বন ধব্বংস হচ্ছে। আর ক্ষতির সম্মুক্ষিন হচ্ছে বনের বন্যপ্রাণীরা।

    ফেব্রয়ারী, মার্চ, এপ্রিল এই তিন বন্যপ্রাণীরা বংশ বিস্তার করে, কিন্ত এই সময় বনের ভিতরে বন্যপ্রাণীদের বিরক্ত করা যাবে না ।

    তাছাড়া উন্নত দেশে বন উন্নয়ের জন্য কমিটি করা হয়। আর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে আইপ্যাক ও নির্সগ  কমিটি করে বনকে আরো ধব্বংস করছে। আর এই কমিটির ৪০ ভাগ সদস্যই গাছ চোরের সাথে জড়িত ,তাহলে বনের উন্নয়ন কিভাবে সম্ভব ? এতে করে বন বিভাগের কর্মকর্তা বন রক্ষা করতে অনিহা প্রকাশ করা করছে। বনের উন্নয়ের জন্য স্কেল ও নির্সগ, এনজিও কাজ করছে, কিন্তু এনজিও গুলো বাস্তবে কোনই কাজ করছে না। এরা বনের বিশাল ক্ষতি করছে।