লাউড় রাজ্যের দূর্গকে সংরক্ষিত পুরাকীতিতে তালিকাভুক্তি

    0
    338

    সুনামগঞ্জ প্রতিনিধিঃ সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার লাউড় রাজ্যের রাজধানী’র দূর্গকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসাবে গত ২৫সেপ্টেম্বর এই প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপনাকে সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংরক্ষিত ঘোষণা করে। একই সঙ্গে এই প্রত্নতত্ত্বস্থলটি সরকারি তালিকাভুক্তও হয়েছে।

    এরপূর্বে গত বছরের ১৪নভেম্বর থেকে তাহিরপুর উপজেলার লাউড় রাজ্যের রাজধানী’র দূর্গ খননের প্রাথমিক কাজ শুরু করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। তাহিরপুরের লাউড়ে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যাবে বলে আর সেটি কয়েক যুগকে যুক্ত করবে। সেই সাথে এই উপজেলার পর্যটন খাতে একটি উল্লেখ যোগ্য স্থান হিসাবে মাথা উচু করে দাড়াঁবে বলে আশা প্রকাশ করেন সমাজসেবক মাসুক মিয়াসহ স্থানীয় এলাকাবাসী।

    লাউড় রাজ্যের রাজধানী’র প্রতœতত্ত্বস্থলটি সরকারি তালিকাভুক্তও হওয়ায় স্থানীয় এলাকাবাসী উপজেলাবাসী সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। সেই সাথে এই প্রতœতত্ত্বস্থলটিকে নিয়ে যুগপোযুগি পদক্ষেপ নিয়ে দ্রুত কাজ করার দাবী জানান।

    সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন,হাওরা লের প্রাচীন নিদর্শন লাউর রাজ্য ঐতিহাসিক স্থাপনার স্বীকৃতি এবং সরকারের প্রতœ সম্পদের তালিকাভুক্ত করায় এখানকার জেলা প্রশাসক হিসাবে আমি অনেক খুশি হয়েছি। আমার পক্ষ থেকে খনন ও গবেষণায় সর্বোচ্ছ সহযোগিতা করবো। আমি মনে করি এখানকার পুরাকীর্তি পর্যটন বিকাশের সহায়ক হবে।

    একাধিক সূত্রে জানা যায়,রাঢ় শব্দ হতেই লাউড় শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। লাউড় রাজ্যের রাজধানী লাউড় ছাড়াও জগন্নাথপুর ও বানিয়াচংয়ে আরও দুটি উপ -রাজধানী ছিল। প্রাচীনকাল হতে শ্রীহট্ট (সিলেট) কয়েকটি রাজ্যে বিভক্ত ছিল। শ্রীহট্টের তিন ভাগ (গৌড়,লাউড় ও জয়ন্তিয়া )তিন জন পৃথক নৃপতি দ্বারা শাসিত হত। তাদের অধীনস্ত ছিল আরও অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূমি মালিক। লাউড় ছিল একটি স্বাধীন রাজ্য। জেলার তাহিরপুরের সীমান্ত এলাকায় লাউড়ের রাজধানী ছিল। লাউড় রাজ্য ছিল সুনামগঞ্জ,হবিগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ জেলার কিয়দংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ হলহলিয়া গ্রামে এখনো বিদ্যমান। এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কেশব মিশ্র। এরা ছিলেন কাত্যান গোত্রীয় মিশ্র। তাদের উপাধি ছিল সিংহ। খ্রিস্টীয় দশম অথবা একাদশ শতকে তিনি কনৌজ থেকে এখানে আসেন। দ্বাদশ শতকে এখানে বিজয় মাণিক্য নামের নৃপতি রাজত্ব করতেন। কারো কারো মতে বঙ্গ বিজয়ের পর রাঢ় অঞ্চল মুসলমানদের হাতে চলে যাওয়ায় সেখানকার বিতাড়িত ও পরাজিত সম্ভ্রান্তজনেরা প্রাণ ও মান বাঁচানোর জন্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়িয়েছিলেন। এদেরই একজন এখানে এসে রাজত্ব গড়ে তোলেন। বর্তমানে এই দূর্গের ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। প্রতিটি প্রকোষ্ঠের কারুকার্য দেখলে যেকেউ মনে করবেন এখানে সভ্রান্ত কোন রাজা বা নৃপতি বাস করতেন। প্রাচীন এই স্থাপনা ক্রমেই ধ্বংসের পথে ছিল।

    ঐতিহাসিক ডব্লিউ হান্টারের মতে সম্ভবত ১৫৫৬ খিঃ লাউড় রাজ্য স্বাধীনতা হারায় এবং মোগলরা এর নিয়ন্ত্রক হন। লেখক সৈয়দ মূর্তজা আলী তাঁর রচিত ‘হযরত শাহ্জালাল ও সিলেটের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিঃ) লাউড়ের রাজা গোবিন্দ সিংহ তাঁর জ্ঞাতি ভ্রাতা জগন্নাথপুরের রাজা বিজয় সিংহের সাথে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিরোধে লিপ্ত হয়েছিলেন এর জের ধরেই বিজয় সিংহ গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন। বিজয় সিংহের বংশধরগণ এ হত্যার জন্য গোবিন্দ সিংহকে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে মোগল সম্রাট আকবরের রাজদরবারে বিচার প্রার্থনা করেন। এ ঘটনার বিচারের জন্য সম্রাট আকবর দিল্লী থেকে সৈন্য পাঠিয়ে গোবিন্দ সিংহকে দিল্লীতে ডেকে নেন। বিচারে গোবিন্দ সিংহের ফাঁসির হুকুম হয়। গোবিন্দ সিংহের অপর নাম ছিল জয় সিংহ। একই সময়ে জয়সিংহ নামের অপর এক ব্যক্তি রাজা গোবিন্দ সিংহের সঙ্গে সম্রাট আকবরের কারাগারে আটক ছিলো। ভুলবশত প্রহরীরা গোবিন্দ সিংহের পরিবর্তে ঐ জয়সিংহকে ফাঁসিতে ঝুলান। গোবিন্দ সিংহের প্রাণ এভাবে রক্ষা পাওয়ায় তিনি কৌশলে সম্রাট আকবরের কাছ থেকে নানা সুযোগ গ্রহণ করেন। তিনি সম্রাট আকবরের নিকট প্রাণভিক্ষা চান ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। গোবিন্দ সিংহের নাম হয় হাবিব খাঁ।  সম্রাট আকবর গোবিন্দ সিংহকে তাঁর হৃতরাজ্য পুনরায় দান করেন। অবশ্য শর্ত দেওয়া হয় হাবিব খাঁ সম্রাট আকবরের বশ্যতা স্বীকার করবেন এবং সম্রাটের খাজনার পরিবর্তে ৬৮খানা কোষা নৌকা নির্মাণ করে সম্রাটকে সরবরাহ করবেন। এই নৌকাগুলো খাসিয়াদের আগ্রাসন হতে আত্মরক্ষার জন্য মোগল ও স্থানীয় বাহিনী কর্তৃক রণতরী হিসাবে ব্যবহার করা হবে।
    প্রাচীন নানা গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে হাবিব খাঁ’র পৌত্র ছিলেন মজলিস আলম খাঁ। মজলিস আলম খাঁ’র পুত্র ছিলেন আনোয়ার খাঁ। তিনি খাসিয়াদের উৎপাতের কারণে স্বপরিবারে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের লাউড় ছেড়ে হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে চলে যান এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। এই বংশেরই উমেদ রাজা লাউড়ে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। এই দূর্গের ধ্বংসাবশেষই লাউড়ের হাউলী,হলহলিয়া বা হাবেলী নামে পরিচিত।