রিফাত হত্যার ছক ম্যাসেঞ্জারেই নির্ধারণ বন্ড গ্রুপের

    0
    261

    ‘০০৭ গ্রুপের সবাইকে কলেজে দেখতে চাই।’ রিফাত ফরাজী নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে মেসেঞ্জার গ্রুপে এ আহ্বান জানানো হয়েছিল। ‘মোহাম্মদ’ নামে আরেকটি আইডি থেকে জানতে চাওয়া হয়- কয়টার সময় আসতে হবে। এরপর মোহাম্মদ আরও জানতে চায়, কলেজের কোথায়? উত্তরে রিফাত ফরাজী বলে, ‘৯টার দিকে।’ এই মেসেঞ্জার গ্রুপের কথোপকথনে একটি চাপাতির ছবি দিয়ে বলা হয় ‘পারলে হেইডাসহ।’ মোহাম্মদ বলে, ‘আমু আনে’। ০০৭ নামে একটি মেসেঞ্জার গ্রুপের এই তথ্য মিলেছে, যেখানে আগের রাতেই বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যায় জড়িতরা নিজেদের মধ্যে কথা চালাচালি করে খুনের চূড়ান্ত ছক ঠিক করে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বুধবার বরগুনায় প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে স্ত্রীর সামনে রিফাত শরীফ হত্যার মূল আসামি নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ ‘০০৭’ মেসেঞ্জার গ্রুপে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করত।

    ঔপন্যাসিক ইয়ান ফ্লেমিংয়ের লেখা বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র জেমস বন্ড। লন্ডনের সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস বা এসআইএসের প্রধান গুপ্তচর হিসেবে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৯৫ সালের পর এসআইএসের নাম বদলে করা হয় ‘এমআই ৬’। জেমস বন্ড ‘০০৭’ সাংকেতিক নম্বর ধারণ করেন। এখানে ডাবল-ও বা ডাবল-জিরো সংকেতের মাধ্যমে তাকে কর্তব্য পালনের প্রয়োজনে যে কাউকে হত্যা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। জেমস বন্ড কারও সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সময় এভাবে বলেন- ‘বন্ড, জেমস বন্ড।’ সংশ্নিষ্ট সূত্র বলছে, জেমস বন্ডকে অনুকরণ করেই বরগুনার বখাটে মাদক ব্যবসায়ী নয়ন বন্ড ‘০০৭’ মেসেঞ্জার গ্রুপ চালিয়ে আসছিল। এমনকি নয়নের প্রকৃত নাম সাব্বির আহম্মেদ নয়ন হলেও নিজেকে পরিচয় দিত ‘নয়ন বন্ড’ হিসেবে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, নয়ন এলাকায় ‘বন্ড’ নামে যে বখাটে গ্রুপের নেতৃত্ব দিত তার সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিল রিফাত ফরাজী। নয়ন ও রিফাত এলাকায় মাদক কারবার, ছিনতাইয়ে জড়িত ছিল। বিশেষ করে বরগুনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে যারা অধ্যয়ন করছেন তাদের অধিকাংশ অন্যান্য জেলার বাসিন্দা। তারা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট মেসে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে আসছেন। এসব মেসে প্রায়ই নয়ন ও রিফাত বাহিনীর সদস্যরা হানা দিয়ে মোবাইল ফোন সেট ও নগদ অর্থ হাতিয়ে নিত। অনেক মেসে কৌশলে তাদের ভাড়া করা মেয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পাতত ০০৭ গ্রুপের এই বখাটেরা।

    বরগুনার একাধিক সচেতন নাগরিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রিফাত হত্যায় জড়িতরা আগে থেকেই এলাকাবাসীর কাছে চিহ্নিত অপরাধী হিসেবে পরিচিত। এ ঘটনায় জড়িত নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজীসহ অনেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় চলাফেরা করত তারা। রিফাত ফরাজীর আপন খালু বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি দেলোয়ার হোসেন। বরগুনার স্থানীয় রাজনীতিতে দেলোয়ার হোসেন ও বর্তমান এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর মধ্যে বিরোধ রয়েছে। এলাকার অনেকের অভিযোগ, ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথের প্রভাবে নয়ন বন্ড অপকর্ম চালিয়ে আসছিল। আর রিফাত ফরাজী তার খালু দেলোয়ার হোসেনের জোরে এলাকায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল। দেলোয়ার ও শম্ভুর মধ্যে বিরোধ থাকলেও নয়ন বন্ড এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা দুই গ্রুপের ছত্রছায়ায় বখাটেপনা করে আসছিল। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথ সমকালকে বলেন, নয়ন বন্ড ও রিফাতের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং যে নিহত হয়েছে তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল তার। রিফাত ফরাজী তার খালু দেলোয়ার হোসেনের প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যবহার করে অনেক অপকর্ম করেও পার পেয়ে আসছিল। সুনাম দেবনাথের দাবি, একবার রিফাত ফরাজীকে আটক করে থানায় দেওয়ার পরও দেলোয়ার তদবির করে তাকে ছাড়িয়ে আনেন। একটি পক্ষ নয়ন বন্ডের সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করছে।

    তবে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন এ প্রসঙ্গে সমকালকে বলেন, ‘রিফাত ফরাজী মাদকাসক্ত, ছিনতাইকারী ও চোর। ৪/৫ বছর আগেই তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। ওকে বলেছি যাতে সে আমার বাসার ধারেকাছে না আসে। বহুবার রিফাতকে ধরে পুলিশে দিয়েছি। জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান, সাবেক এমপি হিসেবে নিজে প্রভাব খাটাই না, ওর (রিফাত ফরাজী) মতো তিন নম্বর আত্মীয় আমার নাম ব্যবহার করে কী প্রভাব খাটাবে?’ দেলোয়ার হোসেন আরও বলেন, ‘নয়ন বন্ডের গডফাদার তো সুনাম দেবনাথ। এলাকায় তার মাধ্যমে মাদক ঢুকেছে। এলাকায় আমি জনপ্রিয় ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আমাকে ভালোবাসে বলে একটি গ্রুপ ঈর্ষাণ্বিত হয়ে আমার সুনাম নষ্টের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।’

    কেন খুনিরা এতটা বেপরোয়া ছিল- এমন প্রশ্নের উত্তরে এলাকাবাসী জানান, বিভিন্ন সময় নানা অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়ায় নয়ন ও রিফাত ফরাজীরা দিনদুপুরে একজনকে খুন করতেও দ্বিধা করেনি। তাদের বিশ্বাস ছিল, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছায়া তাদের মাথার ওপর তো রয়েছেই। কে তাদের টিকিটি স্পর্শ করবে। আর যারা এ হত্যায় জড়িত তাদের অধিকাংশ মাদক কারবারি ও মাদকাসক্ত। সুস্থ ও স্বাভাবিক চিন্তা করার ক্ষমতা অনেক আগেই তাদের লোপ পেয়েছে।

    স্থানীয় সূত্র সমকালকে জানায়, বরগুনায় মাদক এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা, গাঁজাসহ নানা ধরনের নেশা। এর মূল হোতা নয়ন বন্ড। পুলিশের সোর্স হিসেবে নয়ন কাজ করে আসছিল। পাইকারি মাদক কারবারি হিসেবে নয়ন খুচরা কারবারিদের কাছে মাদক বিক্রির পর পুলিশকে খবর দিত। সে নিজে মাদক বিক্রি করে পুলিশকে জানিয়ে দিত- খুচরা কোন বিক্রেতার কাছে মাদক রয়েছে। সেখানে গিয়ে পুলিশ অভিযান চালানোর নামে অনৈতিক বাণিজ্য করত। এভাবে খুচরা মাদক কারবারিদের ব্যাপারে তথ্য দিয়ে পুলিশকে ঘুষ খাওয়ার পথ তৈরি করে দিত নয়ন বন্ড। এ জন্য নয়ন পুলিশের কাছেও প্রিয় ছিল।

    বরগুনার নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন কামাল বলেন, মাদক বরগুনায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। সম্প্রতি একটি গার্লস স্কুলের ১৪ ছাত্রীর কাছে গাঁজা পাওয়া যায়। নয়ন বন্ড ও তার সঙ্গীরা এলাকায় মাদক কারবারি হিসেবে পরিচিত। পুলিশের সঙ্গে তাদের এক ধরনের সখ্য ছিল।

    বরগুনার সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি অ্যাডভোকেট আনিছুর রহমান বলেন, মাদক নির্মূলে জনপ্রতিনিধিদের যে ধরনের ভূমিকা রাখার কথা, সেটা বরগুনায় অনুপস্থিত। এ ব্যাপারে সোচ্চার না হলে তরুণ প্রজন্ম আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সমকাল