রাজধানীতে পীর লুৎফর সহ ৬ জনকে জবাই করে হত্যা

    0
    196

    আমারসিলেট24ডটকম,২২ডিসেম্বরঃ ওয়ারী গোপীবাগে ‘আয়না ভবন’ নামের একটি বাসায় ৬ জনকে জবাই করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। নৃশংস এ হত্যার কারণ ও হত্যাকারীদের ব্যাপারে ধারণা দিতে পারেননি নিহতের স্বজন ও প্রতিবেশীরা। শনিবার রাত আটটার দিকে পুলিশ ৬ জনের লাশ উদ্ধার করে। নিহতরা হলেন পীর লুৎফর রহমান ফারুক (৫৮), সানোয়ারুল ইসলাম মনির (২৯), রাসেল (২৪), মঞ্জু (৩০), মজিবুর রহমান (৩০) ও শাহীন (২৪)।

    লুত্ফর রহমান ফারুক নিজেকে পীর পরিচয়ে গত মার্চ মাস থেকে সেখানে বসবাস শুরু করেন। তার পুত্র মনির হোসেন একটি ব্যাংকে চাকরি করতেন। বাসাটিতে পিতা-পুত্র ছাড়াও ৫/৬ জন নারী বসবাস করতেন। তারা পরস্পর আত্মীয় বলেই অন্যরা জানতেন। এদিকে নিহতদের মধ্যে বাড়ির কেয়ারটেকার মঞ্জু রয়েছেন। তিনি পীরের ভক্ত বলে জানা যায়। নিহতদের মধ্যে শাহিন, রাসেল ও মজিবুর রহমান পীরের মুরিদ বলে প্রতিবেশী সূত্রে জানান।

    ওয়ারী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফারুক হোসেন জানান, সন্ধ্যার পর আশেপাশের লোকজন ফোন করে থানায় বিষয়টি অবহিত করে। সেখানে পুলিশ টিম পৌঁছে ৬ জনের মৃতদেহ পায়। কী কারণে ও কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা জানতে উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান।

    প্রতিবেশীদের মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে পুলিশ সন্ধ্যায় ওই ছয় জনের জবাই করা লাশ উদ্ধার করে। কিছুদিন আগে ভাড়া নিয়ে ফারুক এ বাসায় ওঠেন। তিনি নিজেকে পীর দাবি করে মজমা বসাতেন। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব অথবা ডাকাতির কারণে এ ঘটনা ঘটতে পারে। বিষয়গুলো যাচাই করা হচ্ছে। ঐ বাড়ির ৬ বাসিন্দাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

    রাতে গোপীবাগের বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায় পুলিশ, র‍্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক টিম ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছে। সেখান থেকে লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠানো হচ্ছে। উৎসুক জনতার ভীড় সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল পুলিশকে। গোপীবাগ জিয়া মাঠের কাছেই অভয় দাস লেনে বাড়িটি অবস্থিত। ৬৪/৬ রামকৃষ্ণ মিশন রোডের চার তলা ভবনটির মালিক ওয়ালিউর রহমান। তিনি বাড়িটিতে থাকেন না। ‘আয়না ভবন’ নামের এ বাড়ির দ্বিতীয় তলায় হত্যাকাণ্ড ঘটে।

    প্রতিবেশী মসীহ উদ্দিন জানান, পাশের ভবনের ফ্লাট থেকে চিৎকার শুনতে পেয়ে তিনি দ্রুত সেখানে যান। দরজার সামনেই দুটি লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। যাদের একজন বয়স্ক এবং অন্যজন অল্প বয়সী। বয়স্ক লোকটি ছিলেন লুৎফুর রহমান ফারুক। তিনিই কিছুদিন আগে বাসাটি ভাড়া নেন। তার পাশেই পড়ে ছিল পুত্র মনিরের লাশ। হত্যার ঘটনা বুঝতে পেরে প্রতিবেশীরা কেউ আর সেদিকে অগ্রসর না হয়ে পুলিশে সংবাদ দেন। পরে পুলিশ পৌঁছে লাশ উদ্ধারের পাশাপাশি ঐ বাড়ির অন্য বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।

    নিহত লুৎফর রহমান ফারুকের স্ত্রীর বরাত দিয়ে একজন পুলিশ কর্মকতা জানান, বেলা সাড়ে ৫টার দিকে ৮ যুবক দৌড়ে ঐ ভবনে প্রবেশ করে। যুবকরা পুলিশের ধাওয়া খেয়ে সেখানে এসেছে বলে জানায়। নিজেদের রাজনৈতিক কর্মী পরিচয় দিয়ে যুবকরা ফারুকের কাছে আশ্রয় চায়। কিছুক্ষণ পর বাসার ড্রয়িং রুমে তারা একসঙ্গে মাগরিবের নামাজ আদায় করে। ঘরে থাকা মুড়ি খায় সকলে মিলে। এরপরই অকস্মিকভাবে ৮ যুবক ধারালো অস্ত্র বের করে সবাইকে জিম্মি করে ফেলে। আড়াই বছরের শিশুসহ ৫ নারীকে একটি রুমে আটকে রাখে। বাসাটিতে উপস্থিতদের মধ্যে ফারুক ও তার পুত্র মনিরকে আলাদা ঘরে নিয়ে যায়। অন্য চার পুরুষকে পৃথক রুমে আটকায়। এরপর তারা বাড়িটিতে লুটপাট চালিয়ে ও অন্যদের জবাই করে চলে যায়। পুলিশ ঐ ফ্ল্যাটে উপস্থিত নারীসহ প্রতিবেশীদের বক্তব্য যাচাই করে দেখছে।

    প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, লাশগুলোর প্রতিটিই ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করা। নিহতদের মধ্যে ৪ জনের হাত-পা বাঁধা ছিল এবং মুখ টেপ ও কাপড় দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ফারুক ও মনিরকে আলাদাভাবে দরজার সামনে জবাই করে ফেলে রাখে। তাদের জিম্মি করে ঐ বাড়ির অর্থ, আলঙ্কারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করা হয়েছে বলে অনেকে ধারণা করছেন।

    তবে আজ রাত দশটা পর্যন্ত পুলিশসহ অন্যরা নিশ্চিত করতে পারেননি ফ্ল্যাটটিতে হত্যার পাশাপাশি কোনও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে কিনা। সিআইডির টিম ঘটনাস্থল থেকে নানা আলামত সংগ্রহ করেছে। সেগুলোর পর্যালোচনা চলছে।

    উল্লেখ্য,রাজধানীর গোপীবাগে এক সন্তানসহ নিহত কথিত পীর লুৎফর রহমান “হিজবুল মাহদি” নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর অনেক ভক্ত-মুরিদও ছিলেন বলে জানা যায়। ২০০৭ সালের ২৯ জুলাই একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় এসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হলে পরদিন ৩০ জুলাই সূত্রাপুর থানা পুলিশ লুৎফর রহমানকে আটক করে। তিন মাস পর কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে ধূপখোলা মাঠ এলাকা ছেড়ে যাত্রাবাড়ী এলাকায় বাসা নিয়ে থাকতে শুরু করেন লুৎফর। সব মিলিয়ে তিনবার তিনি কারাভোগ করেন। শাহবাগসহ বিভিন্ন থানায় তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননাসহ বিভিন্ন অপরাধে একাধিক মামলা রয়েছে। সর্বশেষ ২০১১ সালে পাঁচ সহযোগীসহ গোয়েন্দা পুলিশ তাঁকে মুগদা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে।

    জানা যায়, ধূপখোলা মাঠের পাশে একটি পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় দুটি ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতেন লুৎফর। একটি ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে থাকতেন। অন্য ফ্ল্যাটে ভক্তদের নিয়ে জিকির করতেন। নিজেকে তিনি কখনো বলতেন ‘ইমাম মাহদী’ আবার কখনো ‘ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি’। তিনি দাবি করতেন, ১১ বছর আগে ইমাম মাহদী প্রাণত্যাগ করেছেন গেণ্ডারিয়ায় এবং ইমাম মাহদী তাঁকে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। লুৎফর রহমান নতুন ধরনের ইবাদত কৌশল রপ্ত করাতেন তাঁর মুরিদদের। তিনি বলতেন, দিনে দুইবার নামাজ পড়লেই চলবে। রোজা রাখা অবস্থায় হালকা খাবার গ্রহণকেও তিনি উৎসাহিত করতেন।এ ছাড়া তিনি দেশের বিভিন্ন ইসলামী দলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতেন।একটি সুত্র থেকে জানা যায় চরমোনাই পীরের মুরিদেরা তার বিরোধিতা করতেন একই ভাবে জামাতের সমর্থকেরা তার পিছনে লেগে থাকত বলে জানা যায়।