মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও বর্তমান পরিস্থিতি

    0
    655
    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,০৯মে,জাহাঙ্গীর হোসাইন চৌধুরী:  অনেকেই মনে করেন ইচ্ছা করলেই মাদক ছেড়ে দেওয়া সম্ভব বা চাইলেই মাদক মুক্ত হওয়া যায়। এমন ধারণা একেবারেই অমূলক। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে মাদকাসক্তি একটি রোগ, অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হলে যেমন চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, তেমনই মাদকাসক্তি জনিত রোগে আক্রান্ত হলেও চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। মাদকের চিকিৎসার একটা বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি রয়েছে। সেই পদ্ধতিতে মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসার মাধ্যমে মাদকমুক্ত করতে হবে। মাদকের চিকিৎসা একটি দীর্ঘমেয়াদী, সমন্বিত ব্যবস্থাপনা।
    একজন ব্যক্তি যখন মাদকাসক্ত থাকে, তখন সে ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, লাভ-ক্ষতি, বোঝার মতো অবস্থায় থাকে না। মাদক তার মস্তিস্কের স্বাভাবিক বিচার-বিবেচনা বোধ কেড়ে নেয়। অথবা বুঝতে পারলেও আসক্তির ফলে নির্দিষ্ট সময় মাদক না নেয়ায় যে অসহ্য শারীরিক-মানসিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় সে কারনে সে নিজেকে মাদক নেওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনা। একজন আসক্ত ব্যক্তি দীর্ঘদিন মাদক গ্রহনের ফলে শারীরিক, মানসিক ভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, পাশাপাশি তার আচরণিক, আধ্যাত্মিক ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে, চিন্তা-চেতনার নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে, ফলে আসক্ত ব্যক্তির জন্য শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসার পাশাপাশি ও আচরণিক, আধ্যাত্মিক ও মূল্যবোধ জাগ্রত করার পাশাপাশি চিন্তা-চেতনার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানোর জন্য চিকিৎসা ও দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা প্রয়োজন। মাদক নিরাময় কেন্দ্রে আসক্ত ব্যক্তিকে ডিটক্সিফিকেশনের মাধ্যমে শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি নিয়মিত কাউন্সিলিং, অকুপেশনাল থেরাপি ও সাইকো থেরাপির মাধ্যমে সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে সহায়তা প্রধান করা হয়।
    এজন্য একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের এসকল দ্বাপ সম্পন্ন করতে অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও কাউন্সিলরদের তত্ত্বাবধানে নিরাময় কেন্দ্রে ৩ থেকে ৪ মাস আবাসিক ভাবে থাকা আবশ্যক। সঠিক চিকিৎসা সেবা পেলে একজন আসক্ত ব্যক্তির পক্ষে সুস্থ জীবনে ফিরে আসা সম্ভব। তবে অসমাপ্ত চিকিৎসা বা সঠিকভাবে পুর্নবাসন ও চিকিৎসা না পেলে পুনরায় মাদক গ্রহনের সম্ভাবনা থেকে যায়।
    সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী সারাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। তারা ইয়াবা, হেরোইন, ফেন্সিডিল, পেথেডিন, কোকেন, আফিম, বিভিন্ন ধরণের ঘুমের ঔষধ, গাজা, বিভিন্ন ধরণের দেশি-বিদেশী মদ সহ বিভিন্ন ধরণের মাদকে আসক্ত। দেশে বিপুল সংখ্যক মাদকাসক্ত থাকলেও চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছে ১ শতাংশেরও কম। বিশেষ করে সরকারি ভাবে মাদকাসক্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা খুবই সূচনীয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সারা দেশে সরকার পরিচালিত মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা মাত্র ৪টি। এর মধ্যে ১টি হচ্ছে ঢাকায়, অপর ৩টি হচ্ছে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায়। ঢাকার কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দে শয্যা সংখ্যা বর্তমানে মাত্র ১০০টি, তাও গত জানুয়ারী মাসে ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনার সরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্রের প্রত্যেকটিতে ৫টি করে সর্বমোট ১৫টি শয্যা রয়েছে। সরকারিভাবে পরিচালিত দেশের ৪টি মাদক নিরাময় কেন্দ্রের মোট শয্যা সংখ্যা মাত্র ১১৫টি। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ঢাকার কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ১৫,৭০৪ জন মাদকাসক্তকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাকি ৩টি বিভাগীয় শহরের সরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ৮,১৭৫ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। সরকারি ভাবে যখন মাদকাসক্তি চিকিৎসার এই সূচনীয় অবস্থা তখন নিজ উদ্যোগে এগিয়ে এসেছেন কিছু ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্টান, তাদের নিজ উদ্যোগে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলার ১৯৭টি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। তবে বেসরকারি ভাবে গড়ে উঠা
    ১৯৭টি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোর মোট শয্যা সংখ্যা মাত্র ২,৩৮০টি, তবে তাও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা দিনদিন বাড়ায় চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা বাড়ানো জরুরী হয়ে পড়েছে, কিন্তু সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এ পর্যন্ত মাদকাসক্তদের চিকিৎসার জন্য ২ হাজার ৫শ শয্যা অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। উক্ত পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ বেসরকারি ১৯৭টি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে এপর্যন্ত ৪৩,৩৫৩ জন মাদকাসক্তকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে। আর গত ১০ বছরে সরকারি-বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্র মিলে মাত্র ৬০,২৩২ জনকে চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে, যা দেশের মোট মাদকাসক্তের মাত্র শূন্য দশমিক ৮৬ শতাংশ।
    পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ২৭টি জেলায় সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে কোন মাদক নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠেনি, ফলে এসব জেলার মাদকাসক্তরা রয়েছেন চিকিৎসা সেবার আওতার বাহিরে। এসব অঞ্চলের মাদকাসক্তদের চিকিৎসার প্রয়োজন হলেও তারা চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। ফলে এসব অঞ্চলের মাদকাসক্তের সংখ্যা কোন অবস্থতেই কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছেনা। দেশে দিনদিন মাদকাসক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মাদকাসক্তের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মাদক জনিত অপরাধও বেড়ে চলছে, মাদকাসক্তির ফলে তারা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন ধরণের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যা, লুঠ সহ নানা ধরণের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, ফলে দেশের আইন-সৃংঙ্খলা দিনদিন অবনতি হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে এখনো মাদক নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠেনি ঐসব অঞ্চলে মাদকজনিত সমস্যার কারণে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।
    সিলেটে এক আলোচনা সভায় মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন ব্যবস্থার বর্তমান পরিস্থিতি সর্ম্পকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক জনাব জাহিদ হোসেন মোল্লা বলেন, ঢাকার কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রের শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি ঢাকার বাইরে ৭টি বিভাগীয় শহরে ৫০ শয্যার সরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে জমিও অধিগ্রহনের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। সরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্র ছাড়াও কুমিল্লা, যশোর ও রাজশাহী জেলা কারাগার হাসপাতালে মাদকাসক্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা আরও বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্ধিত এ সেবার আওতায় পর্যায়ক্রমে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার সহ দেশের অন্যান্য জেলার কারাগারগুলোও অন্তর্ভুক্ত হবে। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে মাদকাসক্তির চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্প্রসারিত করতে মাদকাসক্তি পরামর্শ কেন্দ্র, নিরাময় কেন্দ্র ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নওয়া হয়েছে, এর ধারাবাহিকতায় গত ৩ মাসে দেশে বেসরকারি মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের সংখ্যা ১৯৭টি থেকে ২১৪টি’তে উন্নীত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারের এ উদ্যোগ যদি বাস্তবায়ন হয়, সরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্রের পাশাপাশি বেসরকারি মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলির শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়, বেসরকারি ভাবে আরো কিছু মাদক নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে হয়তো দেশে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা সংকট কিছুটা দূর হবে। বিশেষ করে যেসব জেলায় এখনো মাদক নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠেনি ঐসব জেলা গুলোতে মাদক নিরাময় কেন্দ্র গড়ে তোলে দেশের সকল মাদকাসক্তকে চিকিৎসা সেবার আওতায় আনার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বেসরকারি পর্যায়ে মাদকাসক্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা সম্প্রসারিত করতে সরকারকে আরো উদ্যোগী হতে হবে। যারা বেসরকারি পর্যায়ে মাদক নিরাময় কেন্দ্র গড়ে তুলতে আগ্রহী তাদেরকে সরকার প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সহায়তা করতে হবে, পাশাপাশি মাদক নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় নতুন উদ্যোক্তা খুজে বের করতে হবে। মাদকাসক্তদের জন্য সরকারি উদ্যোগে চিকিৎসার জন্য এখনো পর্যাপ্ত সুযোগ তৈরী না হলেও বেসরকারি উদ্যোগে দেশের বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে কিছু সংখ্যক মাদক নিরাময় কেন্দ্র গড়ে ওঠায় মাদকাসক্তদের চিকিৎসা সেবা গ্রহণের সুযোগ তৈরী হচ্ছে। তাদের এ উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করছেন সরকারের বিভিন্ন মহল ও দেশের সুশীল সমাজ।
    মাদকাসক্তদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হলে চিকিৎসার কোন বিকল্প নেই। তাই মাদকাসক্তদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি পাগল নয়, খারাপও নয়, কিন্তু সে অসুস্থ। অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের মতো তারও চিকিৎসার প্রয়োজন, সুস্থ জীবনে ফিরে আসা তার অধিকার। তাই মাদকাসক্তদের চিকিৎসা সেবার সুযোগ তৈরি, মাদকাসক্তদের চিকিৎসা সেবা গ্রহনে আগ্রহী করে তোলা ও তাদেরকে চিকিৎসা সেবার আওতায় নিয়ে আসা সরকারের পাশাপাশি ভুক্তভোগী পরিবার ও আমাদের সমাজের সচেতন মহলের সকলের দায়িত্ব বলে আমি মনে করি।লেখকঃ মাদকবিরোধী সংগঠক ও কলামিস্ট।