মাঝরাতে এক পুলিশ কর্মকর্তার স্ট্যাটাস ও আমরা

    0
    291
    “আসুন যে কোন সংকটে আত্মশক্তিতে বলিয়ান হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলি মানবতার কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেই”

    গতকাল ছিল মহান স্বাধীনতা দিবসের ৪৯তম দিন যে দিনে ঘুমন্ত নিরীহ বাঙ্গালীদের উপরে একটি শক্তিশালী আধুনিক অস্ত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হানাদার রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় নির্দেশে একটি প্রশিক্ষিত জালেম খুনি বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের  বাহাদুরিতে খুন করে, আশ্রয়হীন,অস্ত্র ব্যবহারে অজ্ঞ, এমনকি স্বপ্নেও যারা কোনদিন এরকম অস্ত্র দেখেনি। সেইসব নারী পুরুষ শিশুসহ অনেককে নির্বিচারে হাওরের বিলে আসা অথিতি পাখির মত গুলি করে হত্যা করে। কখনো কখনো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে নিরস্র নিরীহ বাঙ্গালীকে।

    সেটি ছিল একটি রাষ্ট্রের সাথে অন্য একটি রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখলের, অধিকার হরণের বাহাদুরী,কিন্তু আজ শুধু বাংলাদেশ নই এবং এর প্রতিপক্ষ কোন রাষ্ট্র বা পাকিস্তান নয়, আজকের প্রতিপক্ষ অজানা, অচেনা, অপ্রতিরোধ্য মনে হলেও অজেয় নয় এই খারাপ, খবিশ শয়তান চরিত্রের একটি শক্তি যাকে শনাক্ত করা হয়েছে মানব বিবেকে দ্বারা কোভিড ১৯ বা করোনা ভাইরাস নামে। কোভিড ১৯ মহামারী-সংক্রান্ত কথা বলার আগে জেনে নেই স্ট্যাটাস দাতার সংক্ষিপ্ত পরিচয়। স্ক্রিনশর্টে দেওয়া স্ট্যাটাস দাতা একজন পুলিশ কর্মকর্তা,তার নাম আশরাফুজ্জামান ডাক নাম আশিক। তিনি মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ এলাকায় সার্কেল এ এস পি নামে সবার কাছে অধিক পরিচিত।  তিনি গত ২৬ মার্চ বৃহস্পতিবার দিবাগত মাঝরাতে ওসি আব্দুস ছালিক ও অন্যান্য পুলিশের সদস্যসহ ডিউটি রত থেকে একটি “স্ট্যাটাস” দেন যা পরের দিন আমার নজরে আসে।

    তখন সম্প্রতি আমার দেখা বিভিন্ন এলাকার লোকদের ছলনার চিত্র ভেসে  উঠে চোখের সামনে অর্থাৎ শিশু সন্তানকে যেভাবে পিতা-মাতা শাসন ও বাঁধা নিষেধ করার পরেও একই কাজ বারবার করে অভিভাবকদের লুকিয়ে লুকিয়ে ফলে একসময় কোন ব্যাথা-কষ্টে আক্রান্ত হলে ভ্যে ভ্যে করে কাঁদতে থাকে। ঠিক একই ভাবে আমাদের আম জনতা হাল জমানায় নিজের নিরাপত্তার কথা না মেনে পুলিশকে ফাঁকি দেন যদিও পুলিশ আমাদের অভিবাবক নয় তবে অভিবাবকদের মতই বন্ধুর  জায়গা দখল করে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করতেই পাহারাই ব্যাস্ত।

    তার এই ছোট্ট স্ট্যাটাস হয়তোই আবেগাপ্লূত ও ভারাক্রান্ত হৃদয়ে লিখেছেন কিন্তু আমার কাছে এর অভিধান বিশাল। পাঠকদের জন্য স্ট্যাটাসটি নিম্নে উল্লেখ করছি ,

    “আমরা রাত জেগে থাকি আপনারা ঘুমাবেন বলে।এখন আমরা বাহিরে আছি আপনাদের ঘরে থাকাটা কি আশা করতে পারি না????”

    আমাদের জন্য লজ্জাজনক হলেও তার এ বক্তব্যে একদিকে কর্তব্যপরায়ণতা এবং সমাজের অসচেতন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষের প্রতি আকুতি অন্যদিকে অসহায়ত্বের বেদনা ফুটে উঠেছে। প্রশ্ন আসতে পারে তা কিভাবে ?

    এক, তিনি একজন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অধীনস্থ কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে বদ্ধপরিকর এবং বাধ্য,যে জন্য যখন মহামারী আতঙ্ক বা অন্য যে কোন সংকটে দেশের নাগরিক যখন নাক ডেকে ঘুমান তখন তার মত দায়িত্ববান পুলিশের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাত জেগে জীবন বাজি রেখে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকেন আর এমনটাই কর্তব্য এবং জনকাম্য।

    দুই,অন্যদিকে অসহায়ত্বের যে চিত্রটি প্রকাশ হয়েছে তা হচ্ছে গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে কোন মানুষের উপরে তার স্বাভাবিক চলাফেরার উপর পুলিশের কোন বাধা-নিষেধ কাম্য নয় বা জনগণ ভালো চোখে নেই না। যা হিতে বিপরীত ও হতে পারে।

    সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু কর্মকাণ্ডে অত উৎসাহী কিছু কর্তা ব্যাক্তি অতি আবেগ ও অপেশা দারিত্বের ফলে সামাজিক ভাবে হেয় হয়েছেন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আমরা দেখেছি।

    তিন, সর্বশেষ যে চিত্রটি অতি গুরুত্বপুর্ন হিসেবে ফুটে উঠেছে তার নাম আকুতি বা আতংকিত ও সমবেদনা ! তিনি বলতে চেয়েছেন আমরা যদি আরামের বিছানা ছেড়ে ,আদরের স্ত্রী-সন্তান,বৃদ্ধ মাতা-পিতা,ভাই-বোনকে সার্বক্ষনিক আতংকে রেখে আপনাদের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে পাহারা দিতে পারি, আপনারা কি সে পাহারা রক্ষা করে নিজেদেরকে নিরাপদে রাখার চেষ্টা করতে পারেন না ? এই বলে তিনি অনেক গুলো প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন। যা আমার আপনারসহ আপামর জনসাধারণের জন্য যেমন লজ্জাজনক তেমনি সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনাও।

    যেমন হাল জামানায় পৃথিবীব্যাপী অনেক বাঘা বাঘা দেশ যারা বিজ্ঞানের জগতে অনেক অনেক এগিয়ে তারাও আতঙ্কিত শঙ্কিত,নিরাপত্তাহীন।

    সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর ১৯৯ টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। ইতিমধ্যে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া আপাতদৃষ্টিতে উত্তরণের পথে দেখা গেলেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে জানা যায় এই ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো কোনো রোগী দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়েছে।

    আতঙ্কজনক আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে ইরান, যুক্তরাজ্য,স্পেন, ইতালিসহ অনেক দেশেই এর মৃত্যুর কালো থাবায় নাজেহাল। এই আতঙ্কের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে নানা গুজব।

    এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু গুজব না বললেই নয়। যেখানে বিশ্বের মানুষ বিরামহীন লড়ে যাচ্ছে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে। সেখানে কিছু লোক নিজ থেকেই করুণা মুক্তির দোয়া বানিয়ে ফেলেছে। বানিয়েছেন আজগুবি যতসব ঔষধ ! কেহ কেহ বলছে কালিজিরা খেলে করোনা হবে না, কেউ বলছে লাল চা খেলে করো না হবে না, কেউ বা বলছে এক শিশু মৃত্যুর আগে রঙ চা খেতে বলেছে,কেহ বা এক সন্তানের মা রাত ব্যাপী নারিকেল গাছের গোঁড়ায় পানি ঢেলেছে বৈশ্বিক মহামারী করোনা থেকে বেঁচে থাকতে। এভাবেই ডজন ডজন গুজব আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে আর এই গুজবে সাঁতরে বেড়াচ্ছে শিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিত লোকজন।

    সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে গোমূত্র কে ও প্রতিষেধক হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে কোথাও কোথাও। জানতে আগ্রহী এমন লোকদের তথ্যে জানা যায়,নারী লোভীরা আরও এমন অনেক গুজব ছড়িয়েছে যা এখানে লেখার পরিবেশ ও সাহস নেই।

    জেনে রাখা দরকার মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে মহামারী থেকে বেঁচে থাকার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা শিখিয়ে দিয়েছেন আমাদেরকে এই প্রার্থনাকে মহামারী শব্দের স্থলে “করোনা ভাইরাস” এর দোয়া লিখে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

    “কালিজিরা” মানবদেহে ইমিউনিটি তৈরি করে বলে ধর্মীয় ধারণা রয়েছে, বলা হয়ে থাকে মৃত্যু ব্যতীত সর্ব রোগের মহৌষধ কালিজিরা ও মধু, এর যৌক্তিক কারণ ও রয়েছে। কিন্তু এর সূত্র ধরে এক শ্রেণীর ধর্মান্ধ ব্যবসায়ীরা রীতিমত ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে ফলে অন্যান্য দ্রব্যের সাথে পাল্লা দিয়ে কালি জিরা ও আকাশ চুম্বী ধরে বিক্রি হচ্ছে।কেহ কেহ কালিজিরা ফোঁক দিয়ে তুলে দিচ্ছে সমর্থকদের হাতে এবং বলে দিচ্ছে যাও করোনা আর তোমাকে নাগাল পাবেনা অথচ ওই ফোঁক দাতারাই করোনার ভয়ে আতংকিত হয়ে নিয়মিত কথা বলার জন্য ডাক্তারকে “মাই ফ্রেন্ড” এ যোগ করে নিয়েছে।

    লক্ষণীয় আমি বলছিনা কালিজিরা মধু কল্যাণকর নয় অবশ্যই এ গুলো নিঃসন্দেহে মহাউপকারী দ্রব্য কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষ চিহ্নিত করে।

    লেখাটি দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে তাই বলতে হচ্ছে সাবধানের মার নেই যদি মহান আল্লাহ আমাদের হেফাজত করেন।

    পরিশেষে বলতে চাই,আমাদের মসজিদ গুলো অনিরাপদ যা আমি নিজে একা একা ঘুরে ঘুরে দেখেছি।যেই লোকেরা থানায়,হাসপাতালে,মার্কেটে গিয়ে মাস্ক আছে কিনা প্রচার করে ওদের ঘরের সামনের মসজিদে হাত দোয়ার সাবান নেই বাকি নিরাপত্তার কথা নাইবা বললাম।

    সবচেয়ে মজার কথা হচ্ছে, সারা বছরে যাকে মসজিদের বারান্দায় দেখা যায়নি তিনি বর্তমানে সিজনের টানে করোনা মুসুল্লি হিসেবে বেশ সক্রিয় ফলে রীতিমত ফতুয়া দিয়ে যাচ্ছে মসজিদে গেলে করোনা হবে না ! এমনি ফতুয়া দিয়ে পাকিস্থান-ভারতে তাবলীগ জামাতের সদস্যরা মসজিদে মসজিদে চিল্লা দিতে অবস্থান ত্যাগ করেনি ফলে আজ ওই জামাতের অসংখ্য কর্মি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত!

    প্রার্থনা করি মহান আল্লাহ যেন আমাদের দেশ ও জাতিকে হেদায়েত দান করেন।শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, যুদ্ধে যেমন ঢাল ও তলোয়ারের সাথে বাহনের প্রয়োজন জরুরী,তেমনি স্রষ্টার দয়া সদা কাম্য। তাই যে কোন ক্লান্তিলগ্নে প্রতিরোধক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি দূরারোগ্য ব্যধি কিংবা মহামারী থেকে প্রিয় নবীর দেখানো পদ্ধতিতে একমাত্র আল্লাহর কাছে আত্মশক্তিকে শক্তি শালী করে আশ্রয় চাওয়াটাই সর্বোত্তম পন্থা।

    প্রসঙ্গত, সাড়া বৎসর ঘুষ দুর্নীতি করে সিদ্ধ হস্ত,এবং সিণ্ডিকেট করে অতিরিক্ত মূল্যে দ্রব্য বিক্রয় কারী ও হালে দিব্বি ফতুয়া দিয়ে যাচ্ছে আর বলছে, মসজিদ খোলা থাকবে নামাজ চলবে ! আরে করোনা মুসুল্লি মসজিদ বন্ধের কথা মুসলিমরা বলে না বলে আপনার মত করোনা সমাজ সেবীরা। এ ক্ষেত্রে প্রধান মন্ত্রী বলেছেন অসুস্থরা মসজিদে নয় বাড়ীতেই নামাজ পড়ুন আর এটাই ইসলামী বিধান।আপনি এত জানেন বুঝেন, কই আপনার মসজিদকে তো ৫ ওয়াক্ত নামাজের পর ১০ বার জীবাণু মুক্ত করতে আর্থিক বা শারীরিক সহযোগিতা করতে সাহস পাচ্ছেন না ?

    যাই হোক করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে এর বিস্তার ঠেকাতে সাড়া পৃথিবীর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা সোশ্যাল ডিসটেন্সিং তথা সামাজিক দূরত্বের কথা বারবার বলছেন।আর আমরা এর পাত্তা না দিয়ে উল্টো ফতুয়াবাজি করে অন্ধকার ছড়িয়ে যাচ্ছি অথচ আজ থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ বৎসর পূর্বে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম আমাদের বলেছেন সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে কথা বললে কতটুকু দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

    জানা যায়,আল্লাহর রাসুল (দঃ) মহামারী এলাকা থেকে পালাতে এবং প্রবেশে নিরুৎসাহিত করেছেন।আরও জানা যায়,”হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর পিতা হযরত আলী কারামাল্লাহ ওয়াজহু থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন যে, হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেন, তোমরা যখন কোন কুষ্ঠরোগী তথা মহামারীতে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে কথা বলবে তখন তোমাদের মাঝে এক ‘বল্লম বা বর্শা’ পরিমাণ দূরত্ব নিশ্চিত করবে।(মুসনাদ আহমদ ইবনে হাম্বল, হাদীছ নং ৮৫১)” বল্লম বা বর্শার দৈর্ঘ্য কতটুকু হবে ? তা অনুমেয়। আর সে জন্যই যেহেতু আক্রান্ত ব্যাক্তি অজানা তাই সামাজিক দূরত্ব কাম্য এবং তখনই এই পুলিশ কর্মকর্তার স্ট্যাটাসের গুরুত্ব অর্থবহ হবে।মায়াসসালাম।  এম এ ইসলাম আশরাফীঃলেখক ও গবেষক।