মাগুরছড়া বিস্ফোরণের ক্ষতিপূরণ চেয়ে আদালতে মামলা করলে বাংলাদেশ জিতবে

    0
    275

    “শেভরন ও তার উত্তরসূরি ইউনিকল এবং অক্সিডেন্টাল মৌলভীবাজারের পরিবেশকে যেভাবে ক্ষতি করেছে তার শত চিহ্ন আজো বিদ্যমান যা আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করলে বাংলাদেশের পক্ষে জয় হবে নিশ্চিত। তাছাড়া ক্ষতির বাস্তবতা দেখিয়ে যেহেতু বীমা কোম্পানির কাছ থেকে অক্সিডেন্টাল ক্ষতিপূরণ নিয়েছে, তাই এমনিতেই তা প্রমাণিত। এখানে বলা আবশ্যক অনেকের ধারণা অক্সিডেন্টাল বীমা কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য ছলচাতুরি করে সেখানে আগুন লাগিয়ে দেয়ার বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়া যায় না”

    আমার সিলেট টুয়েন্টি ফোর ডট কম ডেস্ক,২২ আগস্ট : টেংরাটিলা গ্যাসকূপ বিস্ফোরণ ক্ষতিপূরণের মামলা জয়ের মতো মৌলভীবাজারের গ্যাস কূপে মাগুরছড়া বিস্ফোরণের ক্ষতিপূরণ চেয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করলে বাংলাদেশ জিততে পারে। আর জিতলে কমপক্ষে ১৪ হাজার কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব হবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ক্ষতিপূরণের তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়ে অক্সিডেন্টাল তাদের ক্ষতির টাকা বীমা কোম্পানির কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছে।

    মৌলভীবাজার মাগুরছড়া গ্যাস কূপ বিস্ফোরণের ১৬ বছর পূর্ণ হয়েছে গত ১৪ জুন। বিস্ফোরণে ২৪৫.৮৬ বিলিয়ন ঘন ফুট গ্যাস পুড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বন-পরিবেশ-প্রতিবেশের আরো ১০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয় বলে তদন্ত রিপোর্টে প্রকাশ। পানি ও প্রাণিসম্পদেরও অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে এ ক্ষতিপূরণের রিপোর্ট নিয়ে মার্কিন তেল কোম্পানি অক্সিডেন্টাল বীমা কোম্পানির কাছ থেকে অর্থ আদায় করে নিয়েছে। অথচ সমস্ত প্রমাণ থাকার পরও অজ্ঞাত কারণে সরকারি পর্যায়ে আদায় করা হচ্ছে না এ ক্ষতিপূরণ। অক্সিডেন্টাল মৌলভীবাজারের পরিবেশকে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল তার অসংখ্য চিহ্ন আজো বিদ্যমান, যা সম্বল করে আন্তর্জাতিক আদালতে মূল চুক্তি অনুযায়ী মামলা করলে বাংলাদেশের পক্ষে নিশ্চিত জয় এনে দেবে। যেমনটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে শেভরনের করা হুইলিং চার্জের মামলায় বাংলাদেশের জয়লাভ করে। এবং  সর্বশেষ টেংরাটিলা বিস্ফোরণের ক্ষতিপূরণ আদায়ের সরকারের পদক্ষেপের বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মামলা খারিজ হওয়ার মধ্যদিয়ে পেট্রোবাংলা তথা বাংলাদেশ জয় লাভ করে।

     

    মাগুরছড়ায় যে কারণে বিস্ফোরণ হয় 

    বিস্ফোরিত ওই কূপটি ছিল পকেট কূপ। সাধারণত গ্যাস উত্তোলন করতে হয় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার মিটার নিচ থেকে। আর মাগুরছড়ায় ১২০০ মিটার নিচে যেতেই গ্যাস পাওয়া যায় যা বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিকা- ঘটে। পরে ওই কূপ সিলগালা করে প্রায় ৩/৪শ মিটার দূরে মূল কূপ নির্ণয় করে বর্তমানে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। যেখান থেকে প্রতিদিন গড়ে ৬০/৭০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মৌলভীবাজার গ্যাসফিল্ডে সংযুক্ত হয়।

    মাগুরছড়ায় দুর্ঘটনা ক্ষতি

    ১৯৯৭ সালের মধ্য রাত। হঠাৎ প্রচ- শব্দ। ঘুম থেকে চমকে ওঠেন জেলার কয়েক লাখ মানুষ। শুরু হয় চার দিকে ছোটাছুটি। সে কথা মনে হলে আজো এলাকার মানুষ আঁতকে ওঠেন। ওইদিন মধ্যরাতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ মাগুরছড়া গ্যাস কূপে বিস্ফোরণে মুহূর্তে আগুনের লেলিহান শিখা চারদিকে ছড়িয়ে নিমিষেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের গাছপালা জীবজন্তুসহ আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা। বিস্ফোরণে চা বাগান, বনাঞ্চল, বিদ্যুৎ লাইন, রেলপথ, গ্যাস

    পাইপলাইন, গ্যাসকূপ, মৌলভীবাজার স্ট্রাকচার, গ্যাস রিজার্ভ, পরিবেশ, প্রতিবেশ, ভূমিস্থ পানি সম্পদ, রাস্তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আগুনে গলে যায় রেলপথ, জ্বলে ছারখার হয়ে যায় কোটি কোটি টাকার বনজ সম্পদ। মারা যায় হাজার হাজার বন্যপ্রাণী ও পাখি। বিস্ফোরণে পুড়ে যায় ভূ-গর্ভস্থ উত্তোলনযোগ্য ২৪৫.৮৬ বিসিএফ গ্যাস। তদন্তে প্রমাণিত হয় মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টালের খামখেয়ালিপনায় দুর্ঘটনাটি ঘটে। যার ক্ষতির পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আজও মার্কিন কোম্পানিটির কাছ থেকে আদায় করা হয়নি ক্ষতিপূরণ।

    মাগুরছড়া বিস্ফোরণে পুনঃক্ষতি

    আগের ক্ষতিপূরণ তো মিলেনি উল্টো সিসমিক জরিপ করে অক্সিডেন্টালের উত্তরসূরি কোম্পানি ইউনোকল ও শেভরন লাউয়াছড়া ও তার আশপাশ জনবসতির আরো ক্ষতি করেছে। বিস্ফোরণের ১৬ বছরে পুড়ে যাওয়া এলাকায় নতুন করে গাছপালা গজালেও মাগুরছড়ায় কয়েকটি গাছের পুরো চিহ্ন আজো কালের সাক্ষী হিসেবে রয়ে গেছে।

    জানা যায়, অক্সিডেন্টাল সামান্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে ইউনোকল নামে আরো একটি কোম্পানির কাছে ফিল্ড বিক্রি করে বাংলাদেশ থেকে চলে যায়। ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই ৫শ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। যেখানে উল্লেখ্য ছিল মাগুরছড়া বিস্ফোরণে পরিবেশ জীবজন্তু ও প্রতিবেশের ক্ষতি প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা পাশাপাশি গ্যাস পুড়েছে ২৪৫.৮৬ বিলিয়ন ঘন ফুট । আর পানি সম্পদের ক্ষতি হয় আরো বিশাল। যা পরে তদন্ত করার কথা ছিল। অক্সিডেন্টাল তাদের ক্ষতির বিষয় বীমা কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ তুলে নেয়। কিন্তু গ্যাস উত্তোলনের মূল চুক্তি অনুযায়ী সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ তাদেরই দেয়ার কথা। তারা কৌশলে স্থানীয় পর্যায়ে কিছু কিছু ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করে কেটে পড়ে। এখানেই শেষ নয়, এই কূপ দিয়ে আজও গ্যাস বের হচ্ছে। এক বছর আগেও গ্যাস বের হয়ে যাওয়ার তথ্য শেভরনের কাছে ছিল না। গত বছর এ বিষয়টি সম্পর্কে তাদের বক্তব্য জানতে চাইলে তারা এ ব্যাপারে তারা কিছু জানেন না বলে জানান। পরবর্তীতে এর সত্যতা যাচাই করে তারা জানান বন্ধ করার পরও বিস্ফোরণ ঘটা কুপ থেকে একটু একটু গ্যাস বের হয়। এ ছাড়াও ইউনোকল ২য়বারের মতো লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বুক চিড়ে পাইপ লাইন করে বনের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি করে। পরে ইউনোকলও শেভরনের কাছে গ্যাস কূপগুলো বিক্রি করে কেটে পড়ে। শেভরন পুনরায় নতুন কূপ খনন করার আগে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে অনুসন্ধান চালিয়ে সিসমিক জরিপের সময় বনে রেকর্ডিং করে (বম্পিং করে) বন তথা এলাকার ব্যাপক ক্ষতি করে। যার জন্য পুনবার তদন্ত কমিটি গঠন করে এলাকাবাসীর ক্ষতির বিষয়টি নিশ্চিত হয় সরকার। সে সুবাদে সরকার এ যাত্রায় কিছু কিছু মানুষকে আংশিক ক্ষতিপূরণও নিয়ে দেয়। তদন্ত কমিটির মাধ্যমে তারা শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ৭শ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য সংগ্রহ করেন। যাদের কিছু কিছু পরিবারকে প্রায় ১০ লাখ টাকার মতো ক্ষতিপুরণও দেয়া হয় একই সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে বেশকিছু টিউওয়েবল ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও সাহায্য করা হয়। বারবার মার্কিন এ তেল কোম্পানির দ্বারা এলাকার ক্ষতি হলেও সরকার তথা এলাকার মানুষ সঠিকভাবে পাচ্ছেন না সে ক্ষতিপূরণ।

    বিভিন্ন জনের বক্তব্য 

    এ ব্যাপারে তেল গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির অন্যতম নেতা মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংশের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আমিরুজ্জামান জানান, আন্তর্জাতিক আদালতে শেভরনের করা হুইলিং চার্জের মামলায় ও টেংরাটিলা বিস্ফোরণ বিষয়ে নাইকোর করা মামলায় পেট্রোবাংলার বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে এখন জরুরি হয়ে পড়েছে ১৯৯৭ সালে শেভরনের উত্তরসূরী অক্সিডেন্টালের ওপর গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ চেয়ে মূল চুক্তি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করা। যার মাধ্যমে আদায় করা যেতে পারে তাদের দ্বারা অপূরণীয় ক্ষতির কিছুটা অংশ।

    এ ব্যাপারে পরিবেশ সংরক্ষক সীতেশ রঞ্জন দেব জানান, বিস্ফোরণে এ বনের যে ক্ষতি হয়েছে তা কখনও পূরণ করার মতো নয়। ওই সময় বনের যে সকল পশুপাখি মারা গেছে তা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। আগুন লাগার পরে লাউয়াছড়া ও মাগুরছড়ার পাহাড়ি ছড়াগুলো শুকিয়ে ছিল, আজো আগের অবস্থায় ফিরে আসেনি। তিনি লাউয়াছড়া বনে বিগত ১৬ বছরে কয়েক হাজার বন্যপ্রাণী অবমুক্ত করেছেন।

    একই সঙ্গে মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংশের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটির সভাপতি জাহেদুর রহমান জানান, অক্সিডেন্টাল বাংলাদেশের সম্পদ নষ্ট করে বীমা কোম্পানির কাছ থেকে যে অর্থ আদায় করেছে তার নায্য দাবিদার বাংলাদেশ তাদের কাছ থেকে তা আদায় করতে প্রথমে নোটিশ ও পরে মামলা করা প্রয়োজন। যা আদায় হলে দেশে গড়ে উঠতে পারবে বড় বড় স্থাপনা। পদ্মা সেতু কিংবা বিদ্যুৎ প্লান্ট। এ বিষয়ে আরো একটি বিষয় উল্লেখ্য, বাংলাদেশের গ্যাস উত্তোলনে দেশের পাইপ লাইন ব্যবহার করে টাকা না দেয়ার জন্য খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে শেভরন আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আদালত তাদের এই আনকোড়া যুক্তিকে নাচক করে রায় দেয় পেট্রোবাংলার পক্ষে। আর সে মামলা চালাতে বাংলাদেশ সরকারের খরচ হয় প্রায় ৫ কোটি টাকা আর রায় অনুযাযী বাংলাদেশ সরকার শেভরনের কাছ থেকে পাচ্ছে প্রায় বছরে দুই হাজার ৭শ কোটি টাকা জানালেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংশের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আমিরুজ্জামান ।

    সুনামগঞ্জের টেংরাটিলায় অনুসন্ধান কূপ খননের সময় ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি ও ২৪ জুন এ দুদফা বিস্ফোরণ ঘটায় নাইকো। এতে বিপুল পরিমাণ গ্যাস পুড়ে যাওয়াসহ ক্ষেত্রটি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের পরিবেশেরও বেশ ক্ষতি সাধিত হয়। এ দুটি বিস্ফোরণে ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকার নাইকোর কাছে সাড়ে ৭শ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করে। তবে নাইকো বাংলাদেশের দাবির বিষয়ে কোনো সাড়া দেয়নি। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে একটি পরিবেশবাদী সংগঠন ঢাকার উচ্চ আদালতে নাইকোর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ এবং দুর্ঘটনার কারণে ক্ষতিপূরণ দাবিতে নাইকোর বিরুদ্ধে একটি মামলা করে। পরবর্তী সময়ে নাইকো ইকসিডে দুটি মামলা দায়ের করে। নাইকোর মামলাগুলো হচ্ছেÑ গ্যাসের বকেয়া বিল আদায় সংক্রান্ত (আরবি/১০/১৮) মামলা। অন্যটি টেংরাটিলা বিস্ফোরণের ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিরুদ্ধে মামলা (আরবি/১০/১১)।

    শেভরন ও তার উত্তরসূরি ইউনিকল এবং অক্সিডেন্টাল মৌলভীবাজারের পরিবেশকে যেভাবে ক্ষতি করেছে তার শত শত চিহ্ন আজো বিদ্যমান যা আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করলে বাংলাদেশের পক্ষে জয় হবে নিশ্চিত। তাছাড়া ক্ষতির বাস্তবতা দেখিয়ে যেহেতু বীমা কোম্পানির কাছ থেকে অক্সিডেন্টাল ক্ষতিপূরণ নিয়েছে, তাই এমনিতেই তা প্রমাণিত। এখানে বলা আবশ্যক অনেকের ধারণা অক্সিডেন্টাল বীমা কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য ছলচাতুরি করে সেখানে আগুন লাগিয়ে দেয়ার বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

    এ অবস্থায় মৌলভীবাজারবাসী সরকারের কাছে জোর দাবি করেন আর বিলম্ব নয় যতো দ্রুত সম্ভব এ বিষয়ে ফয়সালায় আসা।