মরুভূমির মরুদ্যান থেকে বলছিঃপ্রসংঙ্গ যুক্তফ্রন্ট

    0
    614

    “পাঁচ জনের ফিরিস্তি প্রমান করে উনারা রাজনৈতিক ভাবে সৎ নন। আদর্শচ্যুত মানুষ কখনোই সঠিক গন্তব্যে পৌছাতে পারেনা। উনাদের কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর সাথে কেউ কেউ বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাস খেয়ানত করেছেন”

    ফরহাদ আহমেদ ফাহাদঃ প্রায় বছর দেড়েক ধরে শুনা যাচ্ছিল গনতন্ত্র পুন:দ্ধারে অনেক নাম সর্বস্ব ফ্রন্ট (দল) মিলে যুক্তফ্রন্ট নামে একটা রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্ত হবে।

    এ নিয়ে রুদ্ধদার বৈঠকও হয়েছে অনেক। বৈঠকে অনেক মতবিরোধ, মতানৈক্য যুক্ত হলেও ফ্রন্ট গুলো যুক্ত হতে হোঁচট খাচ্ছে বারংবার। কে নিবেন যুক্তফ্রন্টের প্রভুত্ব। এ নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা ভেস্তে যায় জীবনের সাথে ৮৫টি বছর যুক্ত করে বয়সের ভারে নুয়ে পড়া যুক্তফ্রন্টের দুই উদ্যোক্তা ড. কামাল হোসেন আর ডা: বি চৌধুরীর মতানৈক্যের কারনে।

    একজন বলেন আমি বাংলাদেশের সংবিধান প্রনেতা, আমিই বসব যুক্তফ্রন্টের চুড়ান্ত চূঁড়ায়। তো আরেকজন বলেন আমি সাবেক রাষ্ট্রপতি, যুক্তফ্রন্টের চুড়ান্ত চূড়ায় আমাকেই মানায়। এরকম অনেক মতানৈক্য বুকে চাঁপা দিয়ে শেষ অবধি গত সপ্তাহে যুক্তফ্রন্টের আরেক উদ্যোক্তা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকির অনুপস্থিতিতে ড. কামাল হোসেনের বাসভবনে চা-চক্রের মধ্য দিয়ে নাম সর্বস্ব ফ্রন্টগুলো (দল) যুক্ত হয়ে যুক্তফ্রন্ট আত্মপ্রকাশ করলো। আলোর মুখ দেখলো। তাও আংশিক ভাবে পুরোটা হবে সেপ্টেম্বরে। যুক্তফ্রন্টের জন্য শুভ কামনা।

    বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আরো একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি বেরিয়ে আসার প্রত্যাশা সার্বজনীন। জনগনের এই প্রত্যাশাটা চাতক পাখির মতো। কারন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাধারন জনগন স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি বা স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির সাথে আপোষকারী কোন দলকে আর সরকারে বা বিরোধী দলে দেখতে চায়না।

    ৩০ লক্ষ শহীদের সমুদ্রসম রক্তের বিনিময়ে অর্জিত লাল সবুজের পতাকা কোন স্বাধীনতা বিরোধীর গাড়ীতে দেখতে চায়না। আন্দোলনের নামে হিংস্রতা দেখতে চায়না। মানুষ পুড়ানোর রাজনীতি দেখতে চায়না। কিন্তু নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তফ্রন্টে যুক্ত শীর্ষ নেতৃবৃন্দ সুষ্ট গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কতটা সুষ্ট ভুমিকা রাখবেন, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ নয়কি? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে তাদের নিজ নিজ দলের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে আজ অবধি তাদের দলীয় অভ্যন্তরে কতটা গনতন্ত্র চর্চা করেন বা করেছেন? জনগনের পক্ষে তাদের ভুমিকা কতটুকু? বা জনগনের কাছে তাদের গ্রহণ যোগ্যতা কতটুকু? জনগনের আশা পুরনে তাদের শারীরিক বা দলীয় সক্ষমতা কতটুকু? বা ভবিষ্যতে যুক্তফ্রন্টের ললাটে কি পরিণতি যুক্ত হবে ?

    এরকম হাজারো প্রশ্ন যুক্ত হচ্ছে দেশের জনগণের সামনে।

    যুক্তফ্রন্টে যুক্ত অন্তত শীর্ষ পাচঁজন নেতা তাদের বিশেষ কর্মের কারণে তাদের নামের সাথে বিশেষ নামের তকমা সেঁটে দিয়েছে বাংলাদেশের জনগণ। তাদের দীর্ঘ রাজনীতির সালতামামী জনগনের মনোজগতে বিশেষ ধারনার জন্ম দিয়েছে। তবে তা ইতিবাচক না। ধারণাটা নেতিবাচক। যেমন গনফোরাম সভাপতি-ড. কামাল হোসেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য এই প্রবীন রাজনীতিক মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে উনাকে পাকিস্তান চলে যাওয়া এবং যুদ্ধের শেষ ভাগে পাকিস্তানে এ্যারেষ্ট হওয়ার কারন এখনো উদঘাটিত হয়নি। সেই থেকেই বিতর্ক উনার পিছু নিয়েছে আজ অবধি তিনি এই বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি।

    বরং বিতর্কের নতুন তকমা সংযোজিত হয়েছে, মৌসুমী রাজনীতিক, কাগুজে বাঘ, সিআইএর এজেন্ট আরো কত কি! উনার বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে বাংলাদেশের কোন ক্রাইসিসে জনগণ উনাকে পাশে পায়নি। হয় আত্মগোপনে চলে যান, না হয় বিদেশ ভ্রমনে বেরিয়ে পড়েন। গনফোরাম সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন ২৫ বছর। কিন্তু জনগন জানেন না উনার সাধারন সম্পাদক কে?

    বাংলাদেশের রাজনীতির আরেক রহস্য পুরুষ বিকল্প ধারা সভাপতি ডা: বি. চৌধুরী। প্রচন্ড বাকপটু এই প্রবীন রাজনীতিক প্রয়াত আওয়ামীলীগ নেতার সন্তান হলেও ডা: বি. চৌধুরীর কিন্তু চরম আওয়ামীলীগ বিদ্বেষী একজন রাজনীতিবিদ। মহান মুক্তিযুদ্ধে উনার নীরবতা স্বাধীনতাকামী বাংলার জনগনের সন্দেহের চোখ এড়ায়নি। যুদ্ধের নয়টি মাস উনি ঢাকাতে অবস্থান করলেও স্বাধীনতাকামী কারো সাথে যোগাযোগ রাখেননি। এমনকি আওয়ামীলীগ নেতার সন্তান হওয়া সত্ত্বেও হানাদার বাহিনীর দ্বারা উনার কোন সমস্যাই হয়নি। কিন্তু স্বাধীনতার পর উনার বাবাকে বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠিয়ে জাতীয় অধ্যাপকের পদটি ভাগিয়ে নেবার চেষ্টা ঠিকই করেছিলেন।

    ৭৫ এর বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফিসিয়ারী মেজর জিয়ার জাগোদলের সারথী হয়ে রাজনীতিতে পদার্পন করলেও পরবর্তীতে মেজর জিয়ার সহযোগিতা সমর্থনে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। তারপরের সব ইতিহাস। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে ব্রাসফায়ারে মেজর জিয়ার দেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হলেও পাশের রুমে জনাব বি চৌধরীর গভীর ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটলেও ২০০১ সালে জামাত-বিএনপির ম্যান্ডেটে রাষ্ট্রপতি হতে বেগ পেতে হয়নি। সাত মাসের মাথায় পদত্যাগ করে বঙ্গভবন থেকে বিতাড়িত হন তা ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু আজ তার নবগঠিত দল বিকল্প ধারা নিয়ে যুক্তফ্রন্টে যুক্ত হয়ে তিনি যুদ্ধাপরাধীর দল জামাতের বিরুদ্ধে নৈতিক অবস্থান নেন। প্রশ্ন হচ্ছে ২০০১ সালে যখন জামাত বিএনপি সহ চারদলীয় জোট সরকারের সমর্থনে রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নেন তখন কোথায় ছিল উনার ঐ নৈতিকবোধ? নাকি ক্ষমতার সামনে সব নস্যি?

    আ.স.ম আব্দুর রব ডাকসাইটের সাবেক ছাত্রনেতা। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ইতিহাসের অংশ হয়ে যান প্রবীন এই রাজনীতিক। যদিও এর সম্পুর্ণ ক্রেডিট সাবেক ছাত্রনেতা খসরু সাহেবের (পুরো নামটা মনে নেই)। কিন্তু ৭২রের পরবর্তী সময়ে জনাব রব সাহেবের হটকারী সিদ্ধান্ত, মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে ইতিহাস বিকৃতি আর দাম্ভিকতা উনাকে ঠেলে দিয়েছে সূর্যগ্রহনের দিকে। হয়েছেন ভেজা বিড়াল। বর্তমানে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে জাসদের একাংশের সভাপতি হয়ে মাঝে মধ্যে টকশোতে এসে ইতিহাস বিকৃতির দুর্গন্ধ ছড়ান। আন্দোলনের ধমকি দিয়ে সরকার উৎখাত করার দিবা স্বপ্ন দেখেন সত্তরর্ধো বয়সে এসে উনার অহমিকা। দম্ভোক্তি পাড়ার বখাটে যুবকের কথাই মনে করিয়ে দেয়। যা একজন প্রবীন রাজনীতিকের সাথে বেমানান নয়কি?

    মেজর (অব:) আব্দুল মান্নান,(বিএনপি থেকে বিতাড়িত) বিকল্প ধারা মহাসচিব। মহান মুক্তিযুদ্ধে মাতৃভূমির সাথে যুদ্ধ করা ৮১ সেনা সদস্যের একজন হচ্ছেন এই আব্দুল মান্নান। ১৯৭১ সালে ১৬ই ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির সাথে সারেন্ডার করে পাকিস্তান চলে যান। এবং ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান। ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগষ্ট জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকা-ের পরে বাংলাদেশে এসে মেজর জিয়ার সারথী সেজে টিসিবির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হোন। প্রশ্ন হচ্ছে জনাব বি চৌধুরী হঠাৎ করে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামাতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে উনার মহাসচিবের বেলায় নীরব কেন?

    মাহমুদুর রহমান মান্না। আমার দেখা সবচেয়ে অস্হীর এক রাজনীতিবিদ। ছাত্র রাজনীতিতে সফলতা আর জাতীয় রাজনীতিতে ব্যর্থতা উনার অস্থিরতার কারণ নয়কি? চার ঘাটের পানি ঘোলা করে সর্বশেষ উনার কপট মানসিকতার কারনে আওয়ামীলীগ থেকেও বিতাড়িত হোন। গঠন করেন নাগরিক ঐক্য। হঠকারী মানসিকতা পরিত্যাগ করতে না পারায় বাংলার সাধারন জনগন উনার নামের সাথে একটা ইউনিক তকমা জুড়ে দিয়েছে। ’ভাইবার যার জন্য উনাকে দুই বছর জেলও খাটতে হয়েছিল। মূল ঘটনা সবার জানা। উনার লাশ চাওয়ার আকাংখা উল্লেখ করে লেখা আর দীর্ঘায়িত করতে চাইনা।

    উপরোল্লেখিত পাঁচ জনের ফিরিস্তি প্রমান করে উনারা রাজনৈতিক ভাবে সৎ নন। আদর্শচ্যুত মানুষ কখনোই সঠিক গন্তব্যে পৌছাতে পারেনা। উনাদের কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর সাথে কেউ কেউ বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাস খেয়ানত করেছেন। রাজনীতিতে নুন্যতম নৈতিকতা থাকা খুবই জরুরী। নির্বাচন সামনে রেখে গনতন্ত্রের বোল আওড়াচ্ছেন। এতদিন কোথায় ছিল আপনাদের গণতান্ত্রিক ভাবনা? নির্বাচন সামনে রেখে রুদ্ধদার বৈঠকে সরকার উৎখাতের নীল নকশা প্রণয়ন কোন গণতান্ত্রিক চরিত্র বহন করেনা। বাংলাদেশের মানুষ এখন অনেক বেশী সচেতন। তারা সবাই জানে নবগঠিত যুক্তফ্রন্ট প্রধানের আরেকজন প্রধান আছে। যিনি দেশের বাইরে থেকে কলকাঠি নাড়ছেন। প্রেসক্রিপসন দিচ্ছেন, রশদ যোগান দিচ্ছেন। যা অচিরেই দীর্ঘশ্বাসে পতিত হবে।

    জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের বিগত শাসনামল শতভাগ সফল না হলেও বাংলাদেশের ইতিহাসে তা স্বর্নযুগ বলা যায়। মানুষের জীবনমান তিনগুন বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত। বিগত দশ বছরে তিন কোটি মানুষকে দারিদ্রসীমা থেকে বের করে এনেছে। পার ক্যাপিটাল ইনকাম দ্বীগুন করে ১৬০০ ডলারে নিয়ে গেছে। সেন্ট্রাল ষ্টোক এক্সচেঞ্জ $৩০০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে গেছে। রপ্তানী আয় ৪৫ বিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। প্রযুক্তি খাতে অভাবনীয় উন্নয়ন সাধন হয়েছে। পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রজেক্ট নিজেস্ব অর্থায়নে নির্মাণ হচ্ছে।

    সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সতের হাজার মেগাওয়াটে নিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। ত্রুটিবিচ্যুতিও কিছুটা আছে। কারণ চল্লিশ বছরের ভংগুর কাঠামো আর জমাটবাঁধা আবর্জনা তো আর একদিনে সচল আর সাফ করা যায় না। তাই আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগন এসব দিকে বিবেচনা করেই তাদের রায় দেবে।

    লেখক : সভাপতি, সৈয়দ মহসীন আলী স্মৃতি সংসদ, সংযুক্ত আরব আমিরাত।