মরহুম মাও.ফখরুদ্দীন:এক অনুকরনীয় আদর্শ

    0
    244

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,১৬জানুয়ারী,আহমেদুল ইসলামঃ   উস্তাদদের সাথে সম্পর্কটা হয় হৃদয়ের,যা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। শিক্ষকদের অবদানের সীমা নির্ধারণ করা খুবই কঠিন। আত্মীয়তা দুরে থাক, পুর্ব পরিচয় ছাড়াই শুধুমাত্র ছাত্র হওয়ার কারনে তাঁরা যে মহব্বত করেন তা অতুলনীয়।

    হুজুরের বিদায়-বেদনা বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে আমার কামিলের শিক্ষক,অসংখ্য আলিমের উসতায,সিলেট সরকারী আলিয়ার সাবেক প্রিনসিপাল, শায়খুল হাদীস মাওলানা মরহুম ফখরুদ্দীনের কথা। হাদীসের এত বড় পন্ডিত এখন খুব বিরল।হাদীস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এত গভীরে চলে যেতেন যে,মনে হত উনার ছাত্র হওয়ার যোগ্যতাও বুঝি আমাদের নেই। উনার জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে কয়েকমাস আগে উনার ছাত্র ইংল্যান্ড প্রবাসী,বিশিষ্ট আলিমে দ্বীন,শ্রদ্ধাভাজন ডক্টর আবদুস সালাম আযাদী লিখেছিলেন:” মদীনা বিশ্ব বিদ্যালয়েও ফখরুদ্দীন জনাবের মত হাদীসের এত বড় পন্ডিত আমার চোখে পড়েনি”।

    জনাবের ক্যারিয়ারটা এতটাই সমৃদ্ধ যে, তার অনেক কিছুই জানিনা, আবার যা জানি তা লিখে তার হক আদায় করা যাবেনা, তবুও উনার জীবনের অনুকরনীয় এমন কিছু দিকের স্মৃতিচারন করতে চাই যা আমাদের চলার পথের পাথেয় হতে পারে ইন শা আল্লাহ.

    কঠোর অধ্যবসায়:

    আমি থাকতাম আলিয়ার ছাত্রবাসে আর জনাব থাকতেন উনার জন্য বরাদ্ব কোয়ার্টারে, দু’টোর অবস্হানই ক্যাম্পাসে হওয়ায় ক্লাসের পরেও জনাবের রুমে প্রায়ই যাওয়া-আসা হত। একদিন আছরের পরে গিয়ে দেখি এক জায়গায় জনাবের সার্টিফিকেটগুলো পড়ে আছে, আগ্রহভরে হাতে নিয়ে দেখি উনার দাখিলের রেজালটের সাথে আলিম,ফাযিল এবং কামিলের (হাদীস,ফিকহ) রেজাল্টের বিস্তর ফারাক। দাখিলে দ্বিতীয় বিভাগ পেলেও বাকী পরীক্ষার সব কয়টিতেই উনি ছিলেন মেধা তালিকার শীর্ষে, কারন জিজ্ঞেস করলে বললেন: দাখিলের রেজাল্ট আশানুরুপ না হওয়াতে উনার বাবা খুব রাগ করেন এবং হাটতে বসতে সারাক্ষন উনাকে রেজালট নিয়ে খোঁচা দিতেন,এমনকি খাবার টেবিলে বসলে উনাকে এক টুকরা মাছের অর্ধেক দিয়ে বলতেন: ২য় বিভাগে পাশ করেছ তাই অর্ধেক খাও. জনাব বলেন: পিতার এমন আচরনে আমাকে প্রচন্ড জিদ্ পেয়ে বসল. সিদ্ধান্ত নিলাম ভাল রেজাল্ট আমাকে করতেই হবে, কঠোর অধ্যবসায়ের ফলে আল্লাহর রাহমাতে পরবর্তী সকল পরীক্ষায় অনেক ভাল ফলাফল করলাম”।

    শিক্ষকতা জীবনেও হুজুরের অধ্যবসায়ের এ দ্বারা বিদ্যমান ছিল, অবসরে দেখতাম শুধু কিতাব নিয়ে ব্যস্ত। রাতে কিংবা দিনে যখনই জনাবের রুমে যেতাম তখনই দেখতাম জনাব বসে অথবা শুয়ে কিতাব পড়তেছেন। তাঁর থাকার রুম ছিল এক সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। পায়ের দিক ছাড়া খাটের চতুর দিকে ছিল কিতাবাদির স্তুপ। এত জ্ঞানী হওয়া সত্বেও প্রচুর পড়াশুনা করে ক্লাস নিতেন যা তাঁর পাঠদানে বুঝা যেত।

    পরিচ্ছন্নতা ও নিয়মানুবর্তিতা:

    শত ব্যস্ততার মাঝেও জনাব থাকতেন খুব পরিচ্ছন্ন. তাঁর পরনের কাপড় দেখলে মনে হত যেন এই মাত্র ধুয়ে ইস্ত্রি করে পরে এসেছেন। প্রতিদিন সকালে উনার বারানদার গ্রীলে আয়না লটকিয়ে মুখের দাঁড়ি-গোঁফ গুলো সাইজ করে নিতেন।

    পরিচছননতার পাশাপাশি জনাবের মধ্যে আরেকটি গুন ছিল নিয়মানুবর্তিতা। যার পুর্ণ প্রাক্টিস ছিল জনাবের প্রাত্যহিক জীবনে। সময়মত সব কাজ করা তাঁর নিয়মিত অভ্যাসে পরিনত হয়েছিল। একা থাকতেন তবুও কোনদিন নিজের কাজের জন্য ক্লাসে আসতে দেরী হয়নি।

    বিনয় ও শ্রদ্ধাবোধ:

    জ্ঞানের দিক দিয়ে তার সমকক্ষ লোক খুবই কম ছিল তাছাড়া তিনি এত বড় একটা মাদরাসার অধ্যক্ষ তবুও তাঁর মধ্যে বিনয়ের কমতি ছিলনা। মত- পথ ভুলে তিনি আহলুলল্ ইলমদেরকে শ্রদ্ধা করতেন। প্রসংগক্রমে ক্লাসে বিভিন্ন সময় ফুলতলি মাসলাকের শায়খুল হাদীস মরহুম মাও. রঈছ উদ্দিন এবং মাও.হাবিবুর রহমান সহ সম সাময়িক আলিমদের ইলমের প্রশংসা করতেন।

    একবার তাঁকে ক্লাসে বললাম: হুজুর, আপনি বর্তমানে সিলেটের সবচেয়ে বড় আলিম, তিনি মুচকি হেসে বললেন: ( ﻛﺒﺮﻧﻲ ﻣﻮﺕ ﺍﻷﻛﺒﺮ ) কাববারানী মাউতুল আকবার অর্থাৎ আমি আসলে বড় নই বড়রা মারা (তোমাদের সামনে অনুপস্থিত) গেছেন তাই আমাকে তোমাদের বড় মনে হইতেছে, তিনি তাঁর পুর্বে আলিয়া মাদ্রাসা থেকে অবসর নেয়া মাও. জিল্লুর রহমান জনাবকে সিলেটের শ্রেষ্ঠ আলিম বলে অক্পটে স্বীকার করতেন।

    রসিকতা:

    জনাব কিছুটা রাগী লোক হলেও প্রচুর রসিকতা করতেন, তবে তার রাগ নিমিষেই চলে যেত, কামিল পরীক্ষার আগে প্রতিদিন বিকালে জনাব আমাদের এক গ্রুপকে পরীক্ষার প্রস্তুতিমুলক কিছু টিপস দিতেন. কোন কারনে জনাব একদিন রেগে গিয়ে যখন পড়াতে আসলেন না তখন সবাই জনাবের রুমে গিয়ে “হুজুর আমাদের মাফ করে দাও” বলে পায়ের উপর পড়লে জনাব এমন হাসি শুরু করলেন সাথে সবাই হাসিতে ফেটে পড়লো, রাগ নিমিষেই আনন্দের উপাদানে পরিনত হলো।

    জনাবের ইলমের খ্যাতি সিলেটের চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল তাই লোকেরা বিভিন্ন শরয়ী মাসয়ালার সমাধান নিতে আসত, তেমনি একদিন একজন এসে ফতওয়া চাইলে জনাব বললেন: আপনি ওই পাশের একচালা ঘরে মুফতি জিন্নাত আলীর কাছে চলে যান, লোকটি ঘরের সামনে গিয়ে যখন “মুফতি সাব, মুফতি সাব” বলে ডাক দিল তখন ঘর থেকে একজন দাড়িহীন, হাফ শাট আর লুংগী পরা লোক বেরিয়ে এসে বললো আমি এই মাদরাসার নৈশ প্রহরী জিন্নাত আলী আর এখানে তো কোন মুফতি থাকেনা, আপনি কোন মুফতির কাছে এসেছেন ? লোকটি বললো: ভাই আমাকে ঐ রুমের হুজুর মুফতি জিন্নাত আলীর কাছেপাঠিয়েছেন। ঘটনা পরিস্কার হলে পরে লোকটা আবার জনাবের কাছ থেকে ফত্ওয়া নিয়ে বাড়ী ফিরলো।

    জনাবের ইলমের কারনে কোন প্রতিষ্ঠানের শুভাকাংখীরাই চাইতেন না জনাব অন্যত্র বদলি হোন,তাই দেখতাম জনাবের ট্রান্সফার অর্ডার আসার পর থাকে সিলেট আলিয়া মাদরাসায় রাখার জন্য মাদ্রাসা প্রেমী নেতাদের দৌড় ঝাপ শুরু হ্য়ে যেত, কিন্ত এ নিয়ে জনাবকে কোন দিন অহংকার করতে দেখিনি।

    এভাবে অনেক স্মৃতি হয়ত বলা যাবে কিন্ত আসল কথা হলো জনাব তো আজ আর আমাদের মাঝে নেই,

    তিনি ২০১১ সালের ২৭শে মার্চ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

    পরিশেষে বলি: হে আল্লাহ , তোমার এই বান্দাহর ইলম প্রচারের সিলসিলা কিয়ামাত পর্যন্ত অব্যাহত রাখ. মানুষ হিসাবে কৃত সকল ভূল-ত্রুটি মাফ করে তাঁকে সহ আমাদের সকল উসতাদদেরকে জান্নাত বাসী করো। লেখক ও গবেষক।