বীর মুক্তিযোদ্ধা সাজিদের আলোকিত জীবনের নিবেদিত রাজনীতি

    0
    265

    আমারসিলেট24ডটকম,০ডিসেম্বর,এডভোকেট শাহ্জাহান চৌধুরীঃ  বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব সাজিদুল হক (সাজিদ) ১৯৩৯ইং সনের ২রা ডিসেম্বর সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাস্থ তেলিখাল গ্রামে এক সাধারন মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম আছাদ উল্লাহ, মাতার নাম ঃ মরহুম আরফিনা বেগম। মরহুম আছাদ ও মরহুম আরফিনা বেগমের তিন পুত্র ও তিন কন্যার মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাজিদুল হক সাজিদ ছিলেন ৩য় সন্তান। ১৯৭১ইং সালের জানুয়ারী মাসে তিনি একই গ্রামের সৈয়দুন নেছার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ২ ছেলে ও ৬ মেয়ে সন্তানের জনক। যুবক অবস্থাতেই তিনি এলাকার বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন এবং ন্যায়ের জন্য বলিষ্ট ভূমিকা রাখতেন।

    ১৯৭১ সালে ৭ই মার্চে হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে এক ভাষনে যখন ঘোষনা করেন  “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম” এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। “রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরোও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ”।তখন বুক ভরা সাহস নিয়া জনাব সাজিদ বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দীর্ঘ নয় মাস রক্তজয়ী যুদ্ধ শেষে তিনি বীরের বেশে লাল সবুজের পতাকা সমৃদ্ধ বিজয় নিয়ে বাড়ীতে ফিরলেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে তিনি ছিলেন আপোষহীন নেতা, তাই বারবার অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে জেল খেটেছেন।

    ১/১১ এর সময়ে ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারনে তিনি দীর্ঘ দিন কারা বরণ করেছেন। তিনি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা শ্রমিক লীগের সভাপতির দায়িত্ব থেকে দীর্ঘদিন শ্রমিক আন্দোলন করেছেন। ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারীর চাঁদাবাজী বন্ধের জন্য বার বার আন্দোলনের ডাক দিয়ে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী দাওয়া পূরণে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। তিনি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাকে সর্বনিম্ন শিক্ষার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সর্বদা সচেতন ছিলেন। তিনি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাস্থ তেলিখাল নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন। তিনি গরীব রোগীদের টাকা পয়সা ও ঔষধ দিয়ে সাহায্য করতেন। কোন নিরীহ লোক মিথ্যা মামলার শিকার হইলে তিনি তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতেন। কোন ফকির মিছকিন ও এলাকার বিপদ গ্রস্থ মানুষ তাহার কাছ থেকে কখনো খালি হাতে ফিরতেন না। শহরে এসে এলাকার কোন মানুষ অসহায় হয়ে পড়লে তিনি তাকে সর্বাত্মক সাহায্য করতেন। তিনি সম্মেলনের মাধ্যমে বিপুল ভোটের দ্বারা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এলাকার যে কেউ দাবী দাওয়া সংক্রান্ত কোন আবেদন নিয়ে আসলে তিনি হাসি মুখে সেখানে সুপারিশ করে দলীয় সীল মেরে এম,পি মহোদয় বরাবরে পৌছেঁ দিতেন। তিনি নিজের যোগ্যতা বলে বারবার জেলা আওয়ামীলীগের অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

    তিনি যখন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ছিলেন তখন সকল মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়মিত সময় দিতেন এবং তাদের সুখে দুঃখে সর্বদা নিজেকে বিলিয়ে দিতেন। তিনি শিক্ষার জন্য সবচেয়ে বেশি মনোযোগী ছিলেন। উপজেলার প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের সাথে ও ম্যানেজিং কমিটির সাথে তাঁহার সদা সু-সম্পর্ক ছিল। তাই শিক্ষা সংক্রান্ত সকল দাবীতে তিনি একাত্ব্তা পোষন করতেন। এলাকার শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েদেরকে তিনি ব্যক্তিগত ভাবে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতেন। তিনি সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় তাহার নিজের গ্রামে তেলিখাল নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার এস.এস.সি ও এইচ,এস,সি পরীক্ষা সেন্টার হওয়ার উদ্যোগকে তিনি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়া বাস্তবায়ন করতে সহযোগীতা করেছেন।

    তিনি সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ রোডের বাস্তবায়নে সালুটিকর ব্রীজ, কাঁটাখাল ব্রীজ, ধলাই ব্রীজ ও অন্যান্য ব্রীজ নির্মাণে সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। জনাব সাজিদ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার তিনটি ইউনিয়নকে ভেঙ্গে ৬টি ইউনিয়নে পরিণত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। একটি কথা না বললেই নয় যে-সর্বোপরী অত্র উপজেলার উন্নয়নের পৃষ্ঠপোষক ও প্রধান সহায়ক ছিলেন আলহাজ্ব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। তিনি আলহাজ্ব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, আবুল মাল আবদুল মুহিত ও ইমরান আহমদ এম,পি সাহেব কে নিয়া কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ১৪৮টি গ্রামে বার বার নৌকার ভোটের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন।

    উপজেলায় এমন কোন গ্রাম নেই, এমন কোন ওয়ার্ড নেই, এমন কোন পাড়া নেই, এমন কোন বাজার নেই, এমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে জনাব সাজিদ নৌকার ভোটের জন্য যান নাই। তাঁহার সুযোগ্য নেতৃত্বে ও নিরলস অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে গত সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে নৌকা মার্কার বিজয় এসেছে। এ বিজয়ে আমরা তাঁহার কাছে চিরঝণী। এ ঝণ কোন দিন শোধ হবার নয়। তিনি ১৯৭১ সালেও বিজয় এনে আমাদের ঋণী করেছেন। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সর্বাত্ত্বক কল্যাণ ও উন্নয়নে অবদান রেখেও তিনি আমাদের চিরঝণী করেছেন। তাঁহার ঋণ তাহার অবদান কোম্পানীগঞ্জবাসী কোন দিন ভূলবে না। তাঁহার বিদায় বেলায় আমাদের দেওয়ার মতো কিছুই ছিল না। তাঁহার জানাজার নামাজে তেলিখাল স্কুল মাঠে হাজার হাজার মানুষের হাহাকারে, আর্তনাদে আকাশ বাতাস কান্নাজড়িত কন্ঠে আওয়াজ তুলেছিল……

    “হে বিজয়ী বীর,

    তুমি মরতে পারোনা,

    তুমি বারবার ফিরে আসবে

    তোমার সকল কল্যাণে, সকল অবদানে

    তোমার রাজনীতির লাখ সৈনিক

    যতদিন বেঁচে থাকবে

    ততদিন তুমিও পৃথিবীতে চির অমর হয়ে থাকবে।

    তুমি বীর মুক্তিযোদ্ধা, তুমি মোদের অহংকার

    তোমার তরে, পেয়েছি মোরা স্বাধীনতার স্বাদ।

    তাই ছালাম ছালাম হাজার ছালাম

    তোমায় চির স্মরণে।

    কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ১৪৮টি গ্রামে আওয়ামীলীগের বেশির ভাগ নেতৃবৃন্দ যেতে পারেন নাই, কারণ অনেকেরই জানা থাকা দরকার অত্র উপজেলার এখনো কোন কোন প্রত্যন্ত অঞ্চল গ্রাম রয়েছে, যেখানে গাড়ীতে এবং নৌকাতে উভয় অবস্থায়ই যাওয়া কষ্টকর। এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলোতে জনাব সাজিদ নৌকা মার্কার প্রত্যেক প্রার্থীকে নিয়া বার বার ভোট ভিক্ষা চেয়েছেন। তাই জনগণ সঠিক মূল্যায়ন করেছেন। ১৯৭০ইং সনের নির্বাচনের মতো এবারও বিশাল ভোটের ব্যবধানে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে মুদ্ধ ছিলেন আমাদের নেতৃবৃন্দ, তাই তিনি অসুস্থ থাকা অবস্থায় হাসপাতালে ছুটে গিয়েছেন আামদের প্রাণপ্রিয় অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত, জনপ্রিয় এম.পি ইমরান আহমদ, আরোও ছুটে গিয়েছেন উপজেলা ও জেলা আওয়ামীলীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। আমি উপজেলা ছাক্রলীগের যুগ্ম আহবায়ক ও পরবর্তীতে সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালনের সময় তিনটি সংসদ নির্বাচনে (সরাসরি) প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম। আমার জানামতে তিনটি সংসদ নির্বাচনের এমন কোন সভা, মিছিল, পথসভা, র‌্যালী বা উৎসব ছিল না যাহাতে জনাব সাজিদ উপস্থিত নেই। প্রতি বৎসর বন্যার সময়ে কোন কোন ক্ষেত্রে নিজের পকেট থেকে ও তিনি রিলিফ বিতরণ করেছেন। প্রতিটি ঈদে ও পুজার অনুষ্ঠানে তিনি গরীব দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াতেন এবং প্রতিটি মসজিদে, মক্তবে ও শীতের মওসুমে সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য করতেন এবং নেতৃবৃন্দের স্মরণাপন্ন হতেন। তিনি একাধারে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, শিক্ষানুরাগী, সমাজ সেবক, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও উদার মনের একজন ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তিনি বিভিন্ন দায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাহার পরিবারবর্গের ও সন্তানদের ঠিকমতো সময় দিতে পারতেন না। হঠাৎ করে ছেলে মেয়েরা তাকে হারিয়ে পাগল প্রায়, ওনার মৃত্যুর সাথে সাথে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। তাঁহার সন্তানদের কান্নায় সেদিন ৯ই ডিসেম্বর ২০১০ইং রোজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে গিয়েছিল। যারাই সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন।

    তাঁহার মৃত্যুর খবর শুনার সাথে সাথে তাঁহার পীর মহল্লাস্থ বাসায় জনতার ঢল নামে, ৯ই ডিসেম্বর সন্ধ্যাটা সেই বাসায় সিলেটের শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ সহ সর্বস্থরের জনতার পদভারে আকাশে বাতাসে শুধু কান্না আর কান্নার শব্দ শুনা যাচ্ছিল। কোন মানুষই সেদিন কান্না ধরে রাখতে পারে নি। সেদিন তাঁহার পরিবারবর্গকে সান্তনা দেওয়ার ভাষা সবাই যেন হারিয়ে ফেলেছিলেন।

    প্রতি বৎসর আমাদের মধ্যে ৪ঠা জানুয়ারী ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, ২১শে ফেব্র“য়ারী মাতৃভাষা দিবস, ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস এবং ১৫ই আগষ্ট জাতীয় শোক দিবস এলে সর্ব প্রথম জনাব সাজিদ সাহেব এগিয়ে এসে আমাদেরকে সর্বাত্ত্বক সহযোগিতা করে রাজনীতির একজন সুযোগ্য অভিভাবক হিসাবে দিবস কে স্বার্থক করে তুলতেন। তিনি সত্যিকার অর্থে রাজনীতি জগতের একজন সুযোগ্য গার্জিয়ান হিসাবে দায়িত্ব পালন করতেন। তাইতো সমবেত স্বরে আজ উচ্ছারিত হচ্ছে-

    “হে’ ৭১ এর বীর সৈনিক                                     লও, লও, হাজার ও সালাম

    কিভাবে পূরণ করবো আমরা, তোমার শূন্যতা।           হে’ ৭১ এর বীর সৈনিক।

    কিভাবে ভুলবো আমরা তোমাকে হারানোর ব্যথা।       তোমার অবদানে আমরা আজ বীরের জাতি।

    তুমি বার বার ফিরে আসিও আমাদের মাঝে,                        ‘৭১-এ তোমার কৃতিত্বকে আমরা নতশীরে শ্রদ্ধা করি।

    তোমাকে সারা জীবন দেখতে চাই,                                        চির অবনত চিত্তে আমরা তোমার বিদেহী

    লাল সবুজের পতাকার মাঝে।                        আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

    আমরা তাঁহার শূন্যতা আজ অক্ষরে অক্ষরে অনুভব করছি। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগ পরিবারে বর্তমানে কোন একতা নাই, রয়েছে নানা দ্বিধাদ্বন্দ। বিধায় আমরা যারা কোম্পানীগঞ্জের রাজনীতির সাথে জড়িত, তাঁরা আজ দিশেহারা হয়ে মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে আমাদের কীর্তিমান বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব সাজিদুল হক সাজিদের শাহাদত বার্ষিকিতে গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে তাঁহার আত্মার চির শান্তি কামনা করছি।