বিশ্ব জয়ের নেশা থেকেই যুব বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ

    0
    306

    বিজয়ের আগুন জ্বলেছিল তাদের চোখের  কোনে , বিশ্ব জয়ের এই নেশা চেপে বসেছিল অনির্বাণ হৃদয়ের গভীর গহ্বরে। হ্যামস্ট্রিংয়ের যন্ত্রণা কাতর ইমনদের সঙ্গে চাতকের মতো আবেগ নিয়ে বসে ছিল পুরো দেশ। নতুন আকাঙ্ক্ষা, নতুন সময়, বিশ্বজয়ের মুকুট- পুরোনো নক্ষত্রদের দিন শেষ হয়ে নতুনরা আসবে বলেই আশার ডালি নিয়ে টেলিভিশনের সামনে বসেছিল যে মুখগুলো- তাদের হতাশ করেননি যুবারা। ক্রিকেট ইতিহাসের এক ব্রাহ্মমুহূর্তে ভারতকে ডিএল মেথডে ৩ উইকেটে হারিয়ে যুব ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট এখন বাংলাদেশের। মেধা, প্রজ্ঞা, প্রচেষ্টা, প্রতিভা- সব মিলিয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ভুবনজয়ী এই বাংলাদেশ। বুকে হাত রেখে নতুন এই প্রজন্মের জন্য প্রত্যেক বাংলাদেশিই- ‘আমরা করবো জয় একদিন…’-এর বদলে আজ থেকে গাইতে পারে ‘আমরা করেছি জয়…।’ সেই দিন, যেদিন বিশ্বক্রিকেটকে মোহিত করে যুব বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে লাল-সবুজের বাংলাদেশ।

    ক্রিকেটে সেক্টরে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ব শিরোপা জয়টি সহজে আসেনি। প্রতিপক্ষ ভারতকে মাত্র ১৭৭ রানে গুটিয়ে দিয়ে উদ্বোধনী জুটিতে ৫০ রান তুলে ফেলার পরও না। রবি বিষ্ণয়ের লেগস্পিন ভেলকি আর নিজেদের শট নির্বাচনের ব্যর্থতায় ১০২ রানেই চলে গিয়েছিল ৬ উইকেট। ১৭৮ রানের লক্ষ্যটা তখন বহু দূরের পথ। ব্যাটসম্যান বলতে অধিনায়ক আকবর আলী; সঙ্গে অর্ধেক সুস্থ পারভেজ হোসেন ইমন। পেশির টানে মাঝপথে মাঠ ছেড়ে যাওয়া বাঁহাতি ওপেনার দলের প্রয়োজনে ফেরেন সপ্তম উইকেটে। পেইন কিলার নিয়ে সঙ্গ দেন আকবরকে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দু’জন মিলে দলের স্কোরবোর্ডে মহামূল্যবান ৪১ রান যোগও করেন। তবে ইমন ৭৯ বলে ৪৭ রান করে আউট হওয়ার পরও জিততে দরকার ছিল ৩৫ রান। যুব ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ ১৩ রান করা রকিবুল হাসানকে নিয়ে আকবর তখন প্রায় নিঃসঙ্গ নাবিকের মতো। ওদিকে আকাশে বৃষ্টির চোখরাঙানি থাকায় উইকেট পড়লে ডিএল মেথডে এসে পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা। সব মিলিয়ে প্রতিকূল হয়ে ওঠা মুহূর্তটিতে ধীরস্থির মাথায় টিকে থাকার মন্ত্র নেন আকবর। ইমন আউট হওয়ার পর টানা ১৭ বল তিনি কোনো রান নেননি। এরপর রকিবুলও পিচে কিছুটা গুছিয়ে ওঠার পর আস্তে আস্তে রানের জন্য শট খেলতে থাকেন। কোনো বিপদ ছাড়াই ডিএল মেথডে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। বৃষ্টিতে খেলা বন্ধের মুহূর্তে ৫৪ বলে ১৫ রান দরকার ছিল বাংলাদেশের। কিছুক্ষণ খেলা বন্ধের পর পরিবর্তিত লক্ষ্য দাঁড়ায় ৩০ বলে ৭ রানের। ৭ বল খরচায় তা নিপুণ দক্ষতায় তুলে নেন আকবর-রকিবুল। আনকোলেকারের বল মিড উইকেটে খেলে জয়ের রান নেন রকিবুল। অন্য প্রান্তে আকবর অপরাজিত তখন ৪৩ রানে। ৭৭ বল খেলা যে ইনিংসের মাহাত্ম্য কেবল একটি ম্যাচের বা যুব বিশ্বকাপ ফাইনালেরই নয়, আগামীর বাংলাদেশের আগমনী বার্তারও।

    অবশ্য এর আগে বাংলাদেশের বিশ্বকাপজয়ের স্বপ্নটা উজ্জ্বল করে তোলেন বোলাররা। বিশেষ করে তিন পেসার শরিফুল, সাকিব ও অভিষেক। টস জিতে ভারতকে ব্যাটিংয়ে পাঠানোর পর নতুন বলে প্রথম দুই ওভারই মেডেন নেন শরিফুল ও সাকিব। সেমিফাইনালে পাকিস্তানকে ১০ উইকেটে উড়িয়ে দেওয়া ম্যাচে ভারতকে জিতিয়েছিলেন যশস্বী জয়শাল ও দিব্যান সাক্সেনা। বাংলাদেশের দুই পেসার সুনিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে টিকে থাকতে গিয়ে প্রথম ৬ ওভারে মাত্র ৮ রান নিতে পারেন তারা। শুরুর এই চাপ সামলাতে টার্গেট করেন তৃতীয় পেসার অভিষেককে। আর তা করতে গিয়েই উল্টো সাক্সেনা আউট হয়ে যান। তবে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক যশস্বী তিলক ভার্মাকে নিয়ে পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠেন।

    তবে কোনো পর্যায়েই হোক চ্যালেঞ্জের দ্বিতীয় উইকেটে ৯৪ রান যোগ করেন দু’জন। সাকিব এসে ৬৫ বলে ৩৮ রান করা তিলককে ফেরানোর পর রকিবুলের স্পিনে কাটা পড়েন প্রিময় গার্গ। ১১৪ রানে তিন উইকেট যাওয়ার পর চতুর্থ উইকেটে আবার স্বস্তিতে ফেরে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা। তবে স্কোরবোর্ডে দেড়শ’ রান তুলতে ৩৯ ওভার পেরিয়ে যায়। হাতে উইকেট রেখে শেষ দশ ওভারে চালিয়ে খেলার চিন্তা করলেও চল্লিশতম ওভারে জোড়া ধাক্কা খায় ভারত। শরিফুলের টানা দুই বলে আউট হন জয়শাল আর সিদ্ধেশ ভীর। সেমিফাইনালের সেঞ্চুরিয়ান জয়শাল আউট হন ১২০ বলে ৮৮ রান করে। ৫ উইকেট নিয়ে এরপরের ওভারগুলোয় আর রান বাড়াতে পারেনি ভারত। উল্টো টপাটপ উইকেট হারিয়ে ৪৭.২ ওভারে ১৭৭ রানে গুটিয়ে যায়। ২১ রানের মধ্যে শেষ ৭ উইকেট হারায় দলটি। বোলিংয়ে প্রথম সাফল্য এনে দেওয়া অভিষেক এ সময় নেন আরও দুই উইকেট। ডানহাতি এ পেসার ৯ ওভারে ৪০ রান দিয়ে ৩ উইকেট নিলেও আধিপত্য বিস্তারে ও রান আটকানোয় বেশি সফল শরিফুল আর সাকিব। বাঁহাতি শরিফুল ১০ ওভারে ৩১ রানে নেন ২ উইকেট; সাকিব ৮.২ ওভারে ২ উইকেট নেন ২৮ রানে। এ ছাড়া স্পিনে মাত্র এক উইকেট নিলেও দশ ওভারে মাত্র ২৯ রান দেন। তৌহিদ হৃদয়ও চার ওভারে মাত্র ১২ রান দেন। প্রায় সব বোলারের এই আঁটসাঁট বোলিং আর পেসারদের দুর্দান্ত কিছু ডেলিভারির সুবাদে ভারতকে দুইশ’র কমে বেঁধে রাখে বাংলাদেশ, যা কঠিন-দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে অর্জিত হয়ে যায় ৪২.১ ওভারে।

    অভিনন্দন: অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতায় বাংলাদেশের যুবাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন রাজনীতিবিদ, বিশিষ্টজনসহ অনেকেই। তাদের মধ্যে রয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।