বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিলের নাম প্রকৃতির লীলাভুমি নয়নাভিরাম চলনবিল

0
607
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিলের নাম প্রকৃতির লীলাভুমি নয়নাভিরাম চলনবিল

নাজমুল হক নাহিদ, সিংড়া (নাটোর) চলনবিল থেকে ফিরে: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিলের নাম চলনবিল। এ বিলের যে দিকে চোখ যায় শুধুই জলরাশি। সে বিস্তৃত জলরাশি জুড়ে ঢেউয়ের খেলা। মাঝে মধ্যে দিগন্ত রেখায় সবুজের  আলপনা। এরমধ্যে ঢেউ ভেঙে ছুটে চলেছে শ্যালো নৌকা। আছে মাছধরার নানা আয়োজনও। এটাই বর্ষা মৌসুমের চলন বিল।

চলনবিল নামটা শুনলেই তো চোখের সামনে ভেসে ওঠে থইথই পানির জলে উথালপাতাল ঢেউয়ের দৃশ্য। তবে সবসময় এই রূপের দেখা মেলে না। ষড়ঋতুর এই দেশে চলনবিলও নানা রুপ পাল্টায়। বর্ষায় যেমন এই বিলের বিশালতা বাড়ে, গ্রীষ্মে ততটাই রুক্ষ রূপ ধারণ করে। শরতে শান্ত জলরাশির ওপর ছোপ ছোপ সবুজ রঙের খেলা। হেমন্তে পাকা ধান আর সোঁদা মাটির গন্ধে মৌ মৌ করে চারদিক। শীতে হলুদ আর সবুজের নিধুয়া পাথার যেন অন্য আকর্ষণে রূপ নেয়। তবে যে যাই বলুক বা ভিন্ন রূপেরই প্রেমে পড়ুক, চলনবিলের মূল আকর্ষণ কিন্তু নৌকাভ্রমণ।

দেশের বিস্তৃত এক জলাভূমির নাম চলনবিল। নাটোর-সিরাজগঞ্জ-পাবনা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এ বিলের অবস্থান। শুকনো মৌসুমে বিলের আয়তন অনেক কমে গেলেও তা প্রাণ ফিরে পায় বর্ষাকালে। তাই ভ্রমণ পিপাসুদের এই মৌসুমে চলনবিল হতে পারে উপযুক্ত গন্তব্য। নাটোর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও বগুড়া জেলাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট অনেকগুলো বিলের সমষ্টি এই চলনবিল। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ ও পাবনার চাটমোহর—উপজেলা দুটির অধিকাংশ স্থান জুড়ে বিস্তৃত চলনবিল। এর দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত পাবনার নুননগরের কাছে অষ্টমনীষা পর্যন্ত বিস্তৃত। এ জেলায় চলন বিলের উত্তর সীমানা হচ্ছে সিংড়ার পূর্ব প্রান্ত থেকে ভদাই নদী পর্যন্ত টানা রেখাটি যা নাটোর, পাবনা ও বগুড়া জেলার মধ্যবর্তী সীমানা নির্দেশ করে।

১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘চলনবিলের ইতিকথা বই থেকে জানা যায়, ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় ১৪২৪ বর্গকিলোমিটার। এরপর ১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপের এক প্রতিবেদনে আয়তন দেখানো হয় প্রায় ৩৬৮ বর্গকিলামিটার।

প্রধান ৩৯টি বিলসহ মোট ৫০টির বেশি বড় বিলের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে চলনবিল। ছোট ছোট অসংখ্য বিল খালের মাধ্যমে এসে যুক্ত হয়েছে চলনবিলেল সঙ্গে। পিপরূল, লারোর, ডাঙাপাড়া, তাজপুর, নিয়ালা, মাঝগাঁও, চোনমোহন, শাতাইল, দারিকুশি, গজনা, বড়বিল, সোনাপাতিলা এবং ঘুঘুদহ তেমনি কিছু বিলের নাম। চলন বিলের বুকে মিশে গেছে করতোয়া, আত্রাই, গুড়, বড়াল, মরা বড়াল, তুলসী, ভাদাইসহ বেশ কয়েকটি নদীও।

যেকোনো ঋতুতে চলনবিলের মূল আকর্ষণ নৌকাভ্রমণ। চলনবিলের জলরাশি কখনও স্থির ছিল না। পূর্ব থেকেই এর জলরাশি স্রোতপূর্ণ। বিলের পানি সাধারণত স্থির এবং বদ্ধ হওয়ার কথা। কিন্তু আজও বর্ষাকালে চলনবিলের পানিতে অস্থির স্রোত বয়। এ কারণে বিলটির এই নাম। সরদার আব্দুল হামিদ তার ‘চলনবিলের ইতিকথাথ বইয়ে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

একসময় ‘মাছেদের বাড়ি বলা হতো চলনবিলকে। দেশি প্রজাতির নানা মাছে এই বিল ভরপুর ছিল। বিলের মাছ ট্রেন যোগে যেত বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সেখানকার অভিজাত মানুষেরা চলনবিলের মাছ দিয়ে ভোজে মাততেন। এখন তেমনটি না থাকলে ও বহু প্রজাতির দেশি মাছের দেখা মিলবে বিলে। মাছে সমৃদ্ধ চলনবিলে এখনও পাওয়া যায়- চিতল, মাগুর, কৈ, শিং, বোয়াল, টাকি, শোল, মৃগেল, চিংড়ি, টেংরা, কালিবাউশ, রিটা, মৌসি, গজার, বৌ, সরপুটি, পুঁটি, গুজা, গাগর, বাঘাইর কাঁটা, তিতপুটিসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।