বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের বামপন্থীদের অনালোচিত ভূমিকা

    0
    212

    সামনে আনলো বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,০৫মার্চঃ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের বামপন্থীদের অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করলো বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। রাজধানীতে আজ অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃবৃন্দ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রথম ভূমিকা নিয়েছিলেন ভারতের বামপন্থীরাই। তারাই স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী সরকারের স্বীকৃতির জন্য ইন্দিরা সরকারের কাছে প্রথম দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কথা যেমন আলোর আড়ালেই থেকে গেছে, তেমনিভাবে ভারতের বামপন্থীদের অবদানের কথাও থেকে গেছে অনালোচিত। এই আলোয় না আসা ইতিহাসকে আজ সামনে আনার জন্য দায়িত্ব নিয়ে কাজ করবে ওয়ার্কার্স পার্টি। অনুষ্ঠানে ভারতের বামপন্থী নেতৃবৃন্দ বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম ও তার সমস্ত অর্জনই বাংলাদেশের মানুষের। ভারতের জনগণ সেখানে সহায়কের ভূমিকা পালন করেছেন। আর ভারতের বামপন্থীরা যে কাজটুকু করেছেন, তা তারা নিজেদের রাজনৈতিক দায়িত্ব থেকেই করেছেন। দেশে দেশে নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে পাশে থাকাই বামপন্থীদের কাজ।

    ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতের বামপন্থীদের ভূমিকা’ শীর্ষক এই আলোচনা সভা আয়োজন করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। আজ ৫ মার্চ সকালে রাজধানীর কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী কমরেড রাশেদ খান মেনন। প্রধান অতিথি ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি-মার্কসবাদী (সিপিআই-এম) এর পলিটব্যুরো সদস্য ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান কমরেড বিমান বসু। বিশেষ অতিথি ছিলেন সিপিআই(এম) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড গৌতম দাস। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা এমপি।

    আলোচনা সভায় কমরেড বিমান বসু বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহান ইতিহাস বাইরে থেকে কেউ গড়ে দেয় নি। বাংলাদেশের মানুষই দীর্ঘদিনের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে সামিল হয়েছেন। বাইরে থেকে অনেকেই হয়তো এই সংগ্রামে সহযোগিতা করেছেন, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষই এই গৌরবময় ইতিহাসের মহান নির্মাতা।

    তিনি বলেন, মুক্তির আকাক্সক্ষা শুরু হয়েছিল একাত্তরের অনেক আগেই। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে তার সলতে পাকানো শুরু, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সেই সলতেয় আগুন জ¦ালানো হয়। মুক্তির মহানায়ক মওলানা ভাসানীর ছাতার নিচে অনেক সৈনিক জড়ো হয়েছিলেন আর সঠিক সময়ে এসে হাল ধরলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

    মুক্তিযুদ্ধে ভারতের বামপন্থীদের ভূমিকার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ২৯ মার্চেই ভারতের বামপন্থীরা প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভারত সরকারের কাছে দাবি তুলেছিলেন। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যদি শুরুতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিতেন, তাহলে হয়তো প্রাণহানির ঘটনা অনেকাংশেই এড়ানো যেতো। তিনি অনেক পরে এসে সেই সত্য উপলব্ধি করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরদিনই সিপিআই(এম) এর পলিটব্যুরোর তরফ থেকে ‘আত্মসন্তুষ্টির সুযোগ নেই, বিজয়কে ধরেই সামনের দিকে এগোতে হবে’Ñ এই বলে বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল।

    ভারতের প্রখ্যাত এই বাম নেতা আরো বলেন, শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রাম, শোষিতের সংগ্রাম, পৃথিবীর তাবৎ বঞ্চিতের সংগ্রামে পাশে দাঁড়ানো বামপন্থীদের নীতি। সে কারণেই সেদিন আমরা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। সেদিন আমরা বলেছিলামÑ বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংগ্রাম চলছে, ভারতের গণতন্ত্রের সংগ্রামকে গলা টিপে ধরা হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সংগ্রামকে ভারতের ইন্দিরা সরকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে, পাশাপাশি ভারতের জনগণের গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামকে অব্যাহত রাখতে হবে।

    বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রয়াত কমরেড জ্যোতি বসুর অবদানকে স্মরণ করে কমরেড বিমান বসু বলেন, ভারতের বামপন্থীরা শুধু সংগ্রামের শিক্ষাই দেয় না, তারা দুনিয়ার তাবৎ মানুষের কাছ থেকে সংগ্রামের শিক্ষা গ্রহণও করে। ওয়ার্কার্স পার্টি আয়োজিত আজকের এই অনুষ্ঠানে ভারতের বামপন্থীদের অবদানের কথা স্বীকার করায় আমরা এ থেকেও শিক্ষা নিলাম।

    তিনি বলেন, সা¤্রাজ্যবাদ ও দক্ষিণপন্থী মৌলবাদের চক্রান্ত ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। এর চরিত্র বাংলাদেশ ও ভারতে ভিন্ন হলেও তাদের মূল উদ্দেশ্য অভিন্ন। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকতামুক্ত শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে চলতে চাইছে। কিন্তু চক্রান্তকারীদের চক্রান্তে এই পথে ভবিষ্যতে ফাঁটল ধরতে চলেছেÑ এটা পরিষ্কার। এই বিপদের কথা মনে করিয়ে দিয়ে এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে তিনি বাংলাদেশের বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, আমরা ভারতে এখনো পারি নি, তবে চেষ্টা করছি। বাংলাদেশের বামপন্থীদেরও পারতেই হবে।

    আলোচনা সভায় কমরেড গৌতম দাস বলেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও এই গণযুদ্ধের সকল বীরত্বপূর্ণ ঘটনা আমাদের এখনও আলোড়িত করে। সারা দুনিয়ার সংগ্রামী মানুষের লড়াই এক ও অভিন্ন এবং তার প্রতি আমাদের দায়িত্ব আছেÑ এই নীতির ভিত্তিতেই ২৭ মার্চেই আনুষ্ঠানিকভাবে সিপিআই(এম) বাংলাদেশের মুুক্তিযুদ্ধের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছিল। সিপিআই(এম) সহ আমাদের ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি দিতে ইন্দিরা সরকারের কাছে প্রথম দাবি তুলেছিল।

    ত্রিপুরার এই বাম নেতা আরো বলেন, মুক্তির সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের বামপন্থীদের মধ্যে এবং বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের মধ্যে যে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা ভবিষ্যতে আরো দৃঢ় হবে। সা¤্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে উভয় দেশের মানুষের সংগ্রামের মধ্যে মৈত্রী গড়ে তুলতে পারলে এই সংগ্রাম উভয় দেশেই আরো দৃঢ় হবে।

    তিনি বলেন, বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামের একটি বিরাট অধ্যায় এতোদিন অজানা ও অনালোচিত ছিল, ওয়ার্কার্স পার্টি আয়োজিত আজকের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তা আলোয় এলো।

    অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে কমরেড রাশেদ খান মেনন বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা ও ঘোষক নিয়ে এখানে যে বিতর্ক হয়, তা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশ ও ভারতের বামপন্থীদের ভূমিকার কথা কোথাও আলোচিত হয় না। তৎকালীন সিপিআই(এম) নেতাদের অবদানের কথা এবং ভারতের জনগণের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে কমরেড মেনন বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বপ্রথম ভারতের বামপন্থীরাই পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ভারতের অসংখ্য মানুষ আমাদের সহযোগিতা করেছেন, এমনকি বাংলাদেশের মুুক্তিযুদ্ধে জীবনও দিয়েছেন।

    মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, নরসিংদীর শিবপুরকে কেন্দ্র করে বামপন্থীদের মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণ শুরু হয়েছিল। পরে ১৪টি স্থানে আমাদের ঘাঁটি ছিল। মুক্তিযুদ্ধে প্রথম সহযোগিতা করেছিল ত্রিপুরার আগরতলা। সিপিআই(এম) এর ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি দাবি তুলেছিলÑ সীমান্ত খুলে দিতে হবে। এর ফলে সীমান্ত খুলে যায় এবং বাংলাদেশের যুদ্ধাক্রান্ত মানুষ ভারতে আশ্রয় নিতে পারেন।

    ভারতের বামপন্থীদের সহযোগিতার কথা জানতে পেরে এক কাপড়ে সীমান্ত পাড়ি ভারতে চলে গিয়েছিলাম। এখানকার খ- খ- বামপন্থী গ্রুপকে একত্রিত করে সিপিআই(এম) এর সহযোগিতায় কলকাতায় ‘বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়। গণশক্তি, দেশের কথা ও আনন্দবাজার পত্রিকায় সে খবর প্রচারিত হয়েছিল। আমরা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে দেখা করে সহযোগিতা ও ঐক্যবদ্ধ যুদ্ধের প্রস্তাব দিয়েছিলাম।

    কমরেড মেনন মহান মুক্তিযুদ্ধে আপোসহীন নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর অবদানও স্মরণ করেন।

    তিনি বলেন, বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রাম ও অর্জন বাংলাদেশের জনগণের। কিন্তু ভারতের বামপন্থীরা বিশেষ করে সিপিআই(এম) যে অকৃত্রিম সহযোগিতা করেছিলেন, তার জন্য আমরা চিরকৃতজ্ঞ।

    আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্যে কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বামপন্থীদের ভূমিকা ও ভারতের বামপন্থীদের অবদানের ইতিহাস আজ ক্রমাগতই পর্দার আড়ালে চলে যাচ্ছে। কংগ্রেস সে সময় ক্ষমতায় থাকার ফলে তাদের দ্বারা বাংলাদেশকে সহযোগিতা করা সহজ ছিল। কিন্তু ভারতের বামপন্থীদের জন্য তা ছিল অনেক কঠিন। কতো কষ্ট করে তারা আমাদের সেদিন সহযোগিতা করেছিলেন, তা আমরা ভুলতে পারব না। দুই বাংলার মানুষের বন্ধন হলো রক্তের বন্ধন। শরণার্থী শিবিরে ভারতের জনগণের অকৃত্রিম সহযোগিতার জন্য আমরা চিরকৃতজ্ঞ। ভারতের সেনাবাহিনী ও সাধারণ জনগণ এখানে বাংলাদেশের মুক্তির লড়াইয়ে অংশ নিয়ে শহীদও হয়েছিলেন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে কিউবার জনগণ ও তাদের নেতা কমরেড ফিদেল ক্যাস্ত্রোর অবদানের কথাও ভুলতে পারি না। বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দানকারী দেশ ভুটান, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর অবদানের কথাও তিনি তুলে ধরেন।

    কমরেড বাদশা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে শোষণমুক্তির ডাক দিয়েছিলেন, স্বাধীনতার সাড়ে চার দশকেও তা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি নি। সংবিধানে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা উল্লেখ থাকলেও আমাদের এখনো সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাদ দিয়ে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা কায়েমের লক্ষ্যে লড়াই করতে হচ্ছে।

    অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সংবাদপত্র ও সিপিআই(এম)’ শীর্ষক এক সংবাদপত্র ক্লিপিং প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র পলিটব্যুরো সদস্য ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান কমরেড বিমান বসু।

    অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত, আন্তর্জাতিক সঙ্গীত ও গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন গণশিল্পী সংস্থার কেন্দ্রীয় স্কোয়াড।প্রেস বিজ্ঞপ্তি