ফুলগাজীর চেয়ারম্যান একরাম হত্যার বিনিময় ২কোটি টাকা

    0
    244

    আমারসিলেট24ডটকম,২৪মেঃ একরামকে হত্যার বিনিময়ে দুই কোটি টাকা ‘মূল্য’ পরিশোধ করা হয়েছে।গ্রেফতারকৃতদের দাবি, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা একরামকে হত্যার উদ্দেশ্যেহত্যাকাণ্ডটি ঘটানোর প্রায় এক সপ্তাহ আগে এর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছিলেন।

    একরামুল হক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকায় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে চারজনস্বীকার করেছেন, স্থানীয় আওয়ামী নেতারা ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যানএকরামুল হককে হত্যার জন্য ভাড়া করা পেশাদার গুণ্ডা ও জলদস্যুদের দুই কোটিটাকা দিয়েছেন।

    একরাম হত্যাকাণ্ডের তদন্তে জড়িত ফেনীর বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাজানান, একরাম হত্যার ঘটনায় গ্রেফতারকৃত আনোয়ার, আলাউদ্দিন, ইকবাল ওসাখাওয়াত প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন যে, হত্যাকাণ্ডের ঘটনাঘটানোর এক সপ্তাহ আগে ফেনী শহরের কালাম কমিউনিটি সেন্টারে বসে এক গোপনবৈঠকে পুরো পরিকল্পনাটি করা হয়েছিল।

    গ্রেফতারকৃতরা আরো দাবি করেছেন, ওই বৈঠকে ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মোঃ আদিল, স্থানীয় নেতা জাহিদুল ইসলাম, ওয়ার্ড কাউন্সিলরশিপলুসহ আরো অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।

    গ্রেফতারকৃতরা জানান, একরামকে হত্যা করার জন্য দুই কোটি টাকা খরচ করেএকে-৪৭ বন্দুক এবং অন্যান্য অস্ত্র ব্যবহার করে- এমন সশস্ত্র অপরাধীদেরভাড়া করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল ওই বৈঠকে। হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাবাস্তবায়নের জন্য সশস্ত্র অপরাধী হিসেবে ব্রিঞ্চি ও আশপাশের অন্যান্য এলাকার গুণ্ডাপাণ্ডা ছাড়াও সোনাগাজীর জলদস্যুদের ভাড়া করা হয় এবং হত্যাকাণ্ডেরআগেই অগ্রিম হিসেবে তাদের এক কোটি টাকাও দেয়া হয়।

    এসব তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য একরাম হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাফেনী মডেল থানার পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদের জানান, মামলাসংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়ে গেছে এবংতদন্তের ফলাফল আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই সংবাদমাধ্যমের সামনে পেশ করা হবে।

    এদিকে, ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হককে হত্যার দৃশ্য সম্বলিত একটিভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে মর্মান্তিক এই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সময় ঘটনাস্থলেইউপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা নিজাম উদ্দিনহাজারী।

    শতাধিক স্থানীয় ব্যক্তির সামনেই প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটানো হত্যাকাণ্ডের এইদৃশ্য মোবাইলফোনে ধারণ করেছিলেন প্রত্যক্ষদর্শীরাই। ভিডিও ফুটেজটি বিশ্লেষণকরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুলইসলাম এবং অভিযুক্ত অপরাধী আবিদ, হুমায়ূন ও সোহেল ওরফে রুটি সোহেলসহ অন্ততমোট চারজনের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

    এই বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে জেলা পুলিশ গতকাল শর্শরি এবং মধুয়াই এলাকায়অভিযান চালিয়ে একরাম হত্যাকাণ্ডে জড়িত হিসেবে আনোয়ার ও আলাউদ্দিন নামের দুইসন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক করেছে।

    গ্রেফতারের এই সংবাদ নিশ্চিত করে জেলা পুলিশ সুপার পরিতোষ ঘোষ জানান, গ্রেফতারকৃত দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড আবেদন করা হবে।

    আগেই গ্রেফতার হওয়া ইকবাল ও সাখাওয়াতসহ এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হিসেবেএখনো পর্যন্ত চারজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এদের কেউই রাজনীতিতে জড়িতনন।

    প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভিডিও ফুটেজ দেখে যাদের চিহ্নিত করা সম্ভব তাদের মধ্যে জাহিদুল ইসলামকে দেখা গেছে হামলার নেতৃত্ব দিতে।

    জানা গেছে, নিজাম হাজারীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী জাহিদের সঙ্গে একরামুলেরশত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কারণ নিহত নেতা একরামুল এর আগে উপজেলা পরিষদনির্বাচন চলাকালীন ফুলগাজী আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকেজাহিদকে বহিষ্কার করেছিলেন।

    ২০০০ সালে যুবলীগ নেতা বশির হত্যার অভিযুক্ত আসামি এই জাহিদ ফুলগাজীআওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সে সময় বহিষ্কৃত হলেও পরেস্থানীয় সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর সহায়তায় ওই পদটি আবার ফিরেও পেয়েছিলেন।

    ভিডিও ক্লিপ থেকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে এমন আরো একজন ব্যক্তি হলেনআবিদ। ফেনী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লায়লা জেসমিনের ছেলেআবিদ সম্পর্কে আবার নিজাম হাজারীর ভাইও হন।

    প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, একরামের ওপর হামলা চালানোর সময়ে আবিদ মুখোশ পরেথাকলেও তার শরীরি অঙ্গভঙ্গি এবং হাঁটার ধরন দেখেই তার পরিচয় সম্পর্কেপরিষ্কারভাবেই নিশ্চিত হওয়া গেছে। নিজামের হয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নঅপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য অভিযুক্ত এই আবিদই একরামের ওপরে প্রথমগুলিটি চালিয়েছিলেন।

    এদিকে ফেনী পুলিশের অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী জানিয়েছে যে ঢাকা থেকে এরই মধ্যে আবিদকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।কিন্তু পুলিশ সুপার পরিতোষ দাবি করেন, তিনি নিজে এই ধরনের কোনো তথ্য পাননি।

    ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যাকাণ্ডে জড়িত আরো দুই ব্যক্তিকেও চিহ্নিত করা হয়েছে।তারা হলেন- সোহেল এবং হুমায়ূন। অভিযোগ আছে, বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত এইদুই ব্যক্তি ফেনীর স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর শিপলুর সমর্থক হিসেবেই এলাকায়পরিচিত।

    এমনকি একরামকে যে এলাকায় হত্যা করা হয়েছে সেই এলাকাও শিপলুইনিয়ন্ত্রণ করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

    একরাম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হিসেবে বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিরসঙ্গে সম্পর্ক থাকার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ফেনী-২ আসনের সংসদসদস্য নিজাম হাজারী জানান, প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি’র সমর্থক এমনব্যক্তিরাই এসব দাবি করছেন।

    হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলে নিজের সহযোগীদের উপস্থিতি সম্পর্কে নিজাম জানান, তার দলের কোনো নেতা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তারবিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

    এই ঘটনার সঙ্গে নিজাম নিজে কিংবা তার আত্মীয় জয়লান হাজারী জড়িত কি-না এমনপ্রশ্নের জবাবে ফেনী পুলিশ সুপার পরিতোষ জানান, প্রয়োজন হলে তাদের দুজনকেইজিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

    এদিকে অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি’র পরিদর্শক মোহাম্মদ ইব্রাহিম হোসেনেরনেতৃত্বে চট্টগ্রামে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট সিআইডি’র একটি দলও এই হত্যাকাণ্ডেরবিষয়ে প্রমাণ যোগাড় করেছে। এসব প্রমাণের মধ্যে পুড়ে যাওয়া একটি ৭.৬২ এমএমপিস্তল, একটি নতুন ছুড়ির অংশবিশেষ, একরামকে বহনকারী গাড়ির পুড়ে যাওয়াধ্বংসাবশেষ এবং একটি ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার রয়েছে।

    একরামকে গুলি করার আগে এবং তাকেসহ গাড়িটি পুড়িয়ে দেয়ার আগে হামলাকারীরাতার গাড়িতে এবং তাকেও ধারালো অস্ত্র দিয়েও আঘাত করেছিল বলে জানা গেছে। কারণগাড়িতে এবং আসনগুলোতেও ধারালো অস্ত্রের কোপানো হয়েছে এমন সাত থেকে আটটিদাগ পাওয়া গেছে।

    সিআইডি আরো জেনেছে যে, যখন নিহত ফুলগাজী চেয়ারম্যানের ‘সমর্থক’ শিপলুহামলা চালানোর সময় তার নিজের নিবন্ধিত একটি শটগান দিয়ে গুলি ছুঁড়তে শুরুকরেন তখন একরাম নিজেও তার নিবন্ধিত ৭.৬২ এমএম পিস্তলটি দিয়ে একবার গুলিকরেছিলেন।

    সিআইডি ইন্সপেক্টর ইব্রাহিম বলেন, “হত্যাকাণ্ডের পরে পুরো ঘটনাস্থলইঅপরাধীরা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলায় প্রমাণ খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়েছে।”

    এদিকে, একরামের দেহের ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক ডা. প্রদীপ কুমার নাথ জানান, যে গুলিটি একরামের দেহে বিদ্ধ হয়েছিল সেটি তার দেহ ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে এবংসেটা উদ্ধারও করা যায়নি। ফলে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

    প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার ফেনীর ফুলগাজী উপজেলায় দুবারের নির্বাচিতচেয়ারম্যান ৪৭ বছর বয়স্ক একরামুল হককে ফেনী জেলা সদরের একাডেমি এলাকায়প্রথমে গুলি করে এবং পরে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।