প্রাথমিক শিক্ষাঃবীজ ভালো হলে ফলনও ভালো হয়

    0
    588

    আমার সিলেট টুয়েন্টি ফোর ডটকম,২৭সেপ্টেম্বর,নজরুল ইসলামঃশিক্ষা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। শিক্ষা জ্ঞানহীন জনশক্তি সমাজের জন্য প্রায়ই বোঝা স্বরূপ। শিক্ষা ছাড়া যেমন একটি জাতির উন্নতি কল্পনা করা যায় না, তেমনি একটি জাতিকে উন্নতির ক্রমবর্ধমান পথে নিয়ে যেতে হলে বা চূড়ায় পৌঁছাতে হলে শিক্ষার বিকল্প আমি দেখছিনা।

    আমাদের আগামীর ভবিষ্যৎ কর্ণদ্বারদের সু-শিক্ষায় শিক্ষিত, নীতি নৈতিকতায় মানবীয় গুণাবলী সম্পন্ন সু-নাগরিক করতে হলে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা ব্যক্তি গোষ্ঠী ও জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের সোনার ছেলেরা আজকে যেভাবে পথভ্রষ্ট হচ্ছে তার একমাত্র কারণ তাদের আদর্শিক নৈতিক এবং মানবিক সু-শিক্ষার অভাব, যা তাদের অর্জনের কথা ছিল সেই ছোট বয়সে প্রাইমারি স্কুলে। তাই বলছি, বীজ ভালো না হলে আপনি ভালো ফসল আসা করতে পারেন না।

    একে অন্যকে দোষারোপ করতে আমরা খুবই ভালোবাসি যা অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সমস্যা ছিল আছে থাকবে, কিভাবে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব তার জন্য কাজ করতে হবে। শুধু সরকার, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ক্যারিকুলামকে দোষারোপ করলেই কি আমাদের সমস্যার সমাধান হবে? শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হলে অভিবাভক, শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গভর্নিং বডি, সবাইকে আধুনিক চিন্তা চেতনার সমন্বয়ে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের কোমলমতি বাচ্চাদের মানবিক, নৈতিক, আদর্শিক, চারিত্রিক, মূল্যবোধ শিক্ষা সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। আধুনিক যুগপোযোগী সময়পোযোগী শিক্ষার প্রসার বিস্তারে আধুনিক চিন্তা চেতনার সমন্বয় ঘটাতে হবে।

    ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না, যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত’। এমন বাক্যগুলো আমরা ছোটবেলা থেকেই বুঝে না বুঝে মুখস্থ করেই এসেছি। বাক্যগুলো সত্য, কিন্তু কতটুকু বোধগম্য উপলব্ধি হয়েছে সেই বয়সে তা বলাই মুশকিল যা আমাকে অনেকটা দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। না বুঝে মুখস্ত বিদ্যা অর্জনই আমাদের প্রধান সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি মানবিক, নৈতিক, আদর্শিক, বা মনুষ্য মেরুদণ্ড তৈরি হয় প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পারিবারিক শিক্ষালয় থেকে।

    একটি শিশু আগামীর ভবিষ্যতে কতটুকু আদর্শবান, চরিত্রবান, ন্যায়নীতি পরায়ণ হবে, দেশ জাতি সমাজের প্রতি কতটুকু দায়িত্বশীল হবে, এটি অনেকাংশেই নির্ভর করে তার প্রাথমিক জীবনের আদর্শিক মানবিক ও নৈতিক শিক্ষার উপর। তাই প্রাথমিক ও পারিবারিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। বিষয়টি দায়িত্বশীলের ভাবিয়া দেখিতে হবে না হলে, ফকির লালন শাহের সেই গানের কথা মালার মত ‘সময় গেলে সাধন হবে না, দিন থাকিতে দিনের সাধন কেন করলে না’। আমরাই আমাদের বাচ্ছাদের অন্ধকারেই নামিয়ে রাখছি।

    আমাদের দেশে বর্তমান শিক্ষার মান উন্নয়নে কি করা উচিত। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সমাজ এবং শিক্ষকের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত। প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে সমস্যা কি এবং তা উত্তরণে কি করণীয়, সে সব বিষয় নিয়ে আলোকপাত ও মত প্রকাশ করার জ্ঞান আমার নেই। এরপরও যতটুকু উপলব্ধি হয়েছে তার উপর অনুমান করেই আমার এই মতামত প্রকাশ। ভাবছি আমাকে কি আবার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় যে, এই শিক্ষাবিদের আবির্ভাব কোথা থেকে?

    আমার একটু ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই। লন্ডনে আসার পর আমার মনে প্রায়-ই প্রশ্ন দেখা দিত, কিভাবে এই দেশের মানুষগুলো এত ভদ্র, বিনয়ী, মৌলিক মানবীয় গুণাবলীর অধিকারী। আমি এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেয়েছি তখন, যখন আমার মেয়েকে নার্সারি স্কুলে ভর্তি করলাম এবং তাকে নিয়ে স্কুলে আসা যাওয়া শুরু করলাম। আমি লক্ষ্য করলাম নার্সারি স্কুলে বাচ্চাদের প্রথম Alphabet A B C D আর কিছু সংখ্যাগত ধারণা ছাড়া পাঠ্যপুস্তকের তেমন কিছুই পড়ানো হয় না। এমনকি নির্ধারিত সিলেবাস বা কোনো পাঠ্যবই নিয়েও স্কুল যেতে হয় না। সেখানে শিক্ষকরা বাবা মায়ের স্নেহ, মমতা দিয়ে যা শেখান- তা হলো আদর্শ, নীতি, নৈতিকতা, সততা এবং দায়িত্ববোধ।
    কিভাবে খেতে হয়, খাওয়ার আগে ও পরে কি বলতে হয়, বন্ধুর সাথে শিক্ষকের সাথে কিভাবে আচরণ করতে হয়, রাস্তা পারাপারে কি করণীয়, ফোনে কিভাবে কথা বলতে হয়, মানুষের বিপদে কি ভাবে সাহায্য করতে হয়, পশু-পাখি, ফুল ও গাছপালার সাথে কিভাবে আচরণ করতে হয়, বাস-ট্রেনে চলাচলের সময় কিভাবে থাকতে হয় এসব বিষয়ে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয়ভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়। এই বিষয়গুলো বলতে বলতে শিখাতে শিখাতে শিশুদের মননে চিন্তা চেতনায় এমনভাবে গেঁথে দেয়া হয় যে, বড় হয়ে তারা একদিকে যেমন বিনয়ী হয় অন্যদিকে তারা হয়ে উঠে নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন আদর্শ মানুষ।

    আমাকে ভুল বোঝার কোনো অবকাশ নেই। যুক্তরাজ্যের সাথে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রক্রিয়া নীতিমালা ক্যারিকুলাম বা কোনো কিছুর সাথে তুলনামূলক চার্ট তৈরি করা ঠিক হবে না সেই উপলব্ধি আমার আছে। কিন্তু আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গিয়েছি বাংলাদেশের ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি পরিকল্পনা কিছুটা পড়ে সেখানে ২০১৮ সালের মধ্যে দেশে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা হবে সর্বজনীন বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক এবং সবার জন্য একই মানের। ২০১০-১১ সালের মধ্যে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি ১০০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলা হয় কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি সব ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বাধ্যতামূলক করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর দেশাত্মবোধের বিকাশ ও দেশ গঠনমূলক কাজে উদ্বুদ্ধ করা। শিশুর মনে ন্যায়বোধ, কর্তব্যবোধ, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি মানবাধিকার কৌতূহল, প্রীতি সৌহার্দ্য, অধ্যবসায় ইত্যাদি নৈতিক ও আত্মিক গুণাবলি অর্জনে সহায়তা করা। বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিমনস্ক করা এবং কুসংস্কারমুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে উৎসাহিত করা। শিক্ষার্থীকে জীবনযাপনের জন্য আবশ্যকীয় জ্ঞান, বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা জীবন-দক্ষতা দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যবোধ সামাজিক সচেতনতা অর্জন এবং পরবর্তী স্তরের শিক্ষালাভের উপযোগী করে গড়ে তোলা। কায়িক শ্রমের প্রতি আগ্রহ ও মর্যাদাবোধ এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষা সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা সৃষ্টি। আদিবাসীসহ সব ক্ষুদ্র জাতি সত্তার স্ব স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করা। সব ধরনের প্রতিবন্ধীসহ সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত ছেলে মেয়েদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

    প্যারাগ্রাফ পাঁচ এর মধ্যে আপনাদের সাথে আমার যুক্তরাজ্যের যে অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছি তার সাথে আমাদের দেশের শিক্ষানীতি ক্যারিকুলামের অনেক মিল খুঁজে পাই। তাহলে কেন আমাদের বাচ্চাদের এত নৈতিক মনোবিক আদর্শিক অধঃপতন? কেন তারা পথভ্রষ্ট হচ্ছে? সমস্যাটা কোথায়? কারণ উৎঘাটন অনুসন্ধানে প্রথমেই আমার প্রাইমারি স্কুলের সেই স্মৃতির কথা মনে পড়ে গেল।

    ছোট বয়সের আমরা পড়েছি, আম পাতা জোড়া জোড়া মারব চাবুক চড়ব ঘোড়া, হাট্টি মাটিম টিম টিম,আতা গাছে তোতা পাখি। এই ধরণের বিষয়-ভিত্তিক পাঠদান আমরা পড়েছি, বাচ্চাদের পড়ানো হয়েছে, এখন ও বোধহয় পড়ানো হয় যদিও ক্যারিকুলামে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখানে মানবিক, নৈতিক, আদর্শিক শিক্ষা কোথায় আমি খুঁজে পাই না। সমস্যাটা হচ্ছে আমাদের দেশে আইন-কানুন নিয়মনীতি ক্যারিকুলামের কোনো অভাব নেই। অভাব শুধু তার সফল প্রয়োগ বাস্তবায়ন জবাবদিহিতা ও তত্ত্বাবধানের।

    বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা পাঠদান প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের কম বেশি সবারই জানা। যুক্তরাজ্যের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার সাথে আমাদের মৌলিক পার্থক্য হলো আমরা শুরুতেই বাচ্চাদের ঘাড়ে এক বোঝা বইয়ের ব্যাগ চাপিয়ে ভালো রেজাল্ট এর জন্য শিক্ষক অভিভাবক সবাই ছোটাছুটি করি। ফলে ভালো রেজাল্টধারী অনেক ছাত্র/ছাত্রী পাওয়া গেলেও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় তৈরি মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন ভাল মানুষের বড়ই অভাব। আমার মনে হয় দায়িত্বশীলদের এই বিষয়ে চিন্তা করা উচিত।

    এক দশক আগেও বাংলাদেশে স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীর হার ছিল খুবই কম, এবং মেয়েদের হার ছিল আরও কম। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ যেমন সময় মত বই বিতরণ, বিনা বেতনে শিক্ষা, ফ্রি টিফিনের ব্যবস্থা বাল্য-বিবাহ রোধ প্রভৃতি কারণে স্কুলগামী ছেলেমেয়ের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি শিক্ষার হারও প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে শিক্ষার হার বাড়লেই কি আদর্শবান জাতি হওয়া যায়? দেশে আমরা একজন শিক্ষিত মানুষের কাছে যে ধরনের ব্যবহার, সেবা আশা বা প্রত্যাশা করি তা কি আমরা সর্বক্ষেত্রে সব সময় পাই? না, কারণ আমরা কি সেই ছোট বয়সে তাদের শিখিয়েছি তুমি বড় হয়ে সরকারি চাকরি নিয়ে যখন অফিসে যাবে তখন তোমাকে জনগণের মালিক নয় সেবক হিসেবে ভাবতে হবে এবং সেবা দিতে হবে। এই ধরণের অনেক প্রশ্ন আমাদের মনে তাড়া করে। এখনো অনেক গ্রামের স্কুলের শিক্ষক সেই গতানুগতিক ভাবেই পাঠ দান অব্যাহত রেখেছেন।

    প্রাথমিক শিক্ষা পাঠদানে নৈতিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। নৈতিক শিক্ষা বা নীতি কথার চেয়ে আমাদের তাত্ত্বিক শিক্ষার চর্চা হয় বেশি। বাচ্চারা মুখস্ত করে পরীক্ষায় পাশের জন্য পরক্ষণে ভুলেও যায়। আচরণগত শিক্ষা খুবই কম, এমনকি প্রতিদিন লাইনে দাঁড় করিয়ে যে শপথ বাক্য পাঠ করানো হয় তার অর্থ হৃদয় দিয়ে কতজন ছাত্র-ছাত্রী অনুভব করে তা নিয়ে আমি সন্দিহান। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে যুগপোযোগী প্রাথমিক শিক্ষা ক্যারিকুলাম বর্তমানে যা আছে এর সাথে মিল রেখে বাস্তবতার নিরিখে আত্ববিশ্বাসী হয়ে পাঠদান আমাদের বাচ্চাদের আদর্শ, বিনয়ী, নৈতিক, মানবীয় গুণাবলী সম্পন্ন ভবিষ্যত প্রজন্ম তৈরি করতে পারে। যদিও সরকারি-বেসরকারি স্কুলগুলোতে শিক্ষক নিয়োগে শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়নে অনেকটা আন্তরিক সরকার। শিক্ষার আদর্শিক গুণগত মানে পৌঁছানো কখনোই সম্ভব হবেনা যতক্ষণ না পর্যন্ত শিক্ষকরা আধুনিক চিন্তা-চেতনা সমৃদ্ধ হয়। জাতি গঠনে শিক্ষার সাথে সার্থসংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। আমার মনে হয় বিষয়টি দায়িত্বশীল সবাইকে গভীর ভাবে চিন্তা করা উচিত।

    মানসম্পন্ন শিক্ষক ও অনুকূল শিক্ষা পরিবেশের অভাব প্রায়ই অনুপস্থিত। শিক্ষকদের নৈতিক মান নিয়ে খবর পত্র পত্রিকায় প্রশ্ন ওঠে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে শিক্ষকতা পেশাকে অনেক সম্মান করি, সম্মানিত শিক্ষক বৃন্দকে দোষারোপ বা জ্ঞান দিচ্ছিনা। আমার পরিবারের অনেকই শিক্ষক ছিলেন আজ ও আছেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখানোর মহান ব্রত নিয়ে দায়িত্বরত শিক্ষকতা নামক মহান পেশাটি নেহাতই যেন আয় রোজগারের একটি উপায় না হয় সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দকে সেই দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। ভারতের সাবেক মরহুম রাষ্ট্রপতি আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, যদি একটি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত এবং সুন্দর মনের জাতি হতে হয়, তাহলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এক্ষেত্রে তিনজন সামাজিক সদস্য পাৰ্থক্য এনে দিতে পারে। তারা হলেন বাবা, মা ও শিক্ষক।

    আদর্শবান জাতি গঠনের লক্ষ্যে সুস্থ মেধা বিকাশ, পরিবেশ বান্ধব শ্রেণি কক্ষ দরকার যা আমাদের দেশের বিদ্যালয় গুলোতেই অনুপস্থিত। সরকারের ইচ্ছে থাকা সত্বেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সঠিক তত্ত্বাবধান ও বাস্তবায়নের অভাবে অনেক বিদ্যালয়ে বসার বেঞ্চ নেই, টয়লেট নেই, নেই খেলার সামগ্রী। যা প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে অন্তরায়। অভিভাবকদের অসচেতনতা হতাশাজনক। দেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস করে এবং তারা কৃষি কাজে জড়িত। স্বাভাবিকভাবেই তারা তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে তাদের মত কৃষক বানাতে চায় যদিও এই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। তবে এখনো তাদের অনেকের ধারণা পড়ালেখা করে গরীব মানুষের সন্তানদের চাকরি পাওয়া কঠিন। বাংলাদেশে এখনও অনেক পরিবার দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছে। এসব পরিবারের মা-বাবারা মনে করেন তার সন্তান স্কুলে গিয়ে যে বৃত্তি পাবে তার চেয়ে অনেক বেশি আয় করতে পারবে বাসা-বাড়ি বা বাইরে অন্য কথাও কাজ করে। ফলে তারা তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ের চেয়ে জীবন জীবিকার কাজে নিয়োজিত করতেই বেশি পছন্দ করে। তা ছাড়া শিক্ষার গুরুত্ব, সুদূর প্রসারী ফল নিয়ে চিন্তা করার মত কল্পনা শক্তিও তাদের নেই। অভিবাবকদের চিন্তা চেতনার মান উন্নয়নে কাজ করতে হবে।

    অন্যতম লক্ষণীয় বিষয় হল স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির দুর্বলতা। স্কুল গভর্নিং কমিটিতে প্রয়োজন একজন শিক্ষিত মার্জিত ভদ্র শিক্ষানুরাগী সম্মানিত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি যার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হবে শিক্ষার মান, ও স্কুলের সামগ্রিক উন্নয়নে কাজ করা। বাস্তবতার নিরিখে দেখা যায় স্কুল কমিটির অনেক সদস্যই শিক্ষার গুরুত্ব বা গুনগত মান বৃদ্ধির বিষয়ে মোটেও জ্ঞান রাখেন না সচেতন ও নয়। অনেকেই এসএমসির সদস্য বা সভাপতি হওয়ার বিষয়টিকে সন্মান বৃদ্ধি, ক্ষমতা আধিপত্য বৃদ্ধি, আয় রোজগারের উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হওয়ার ক্ষেত্রে শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শকে বিবেচনায় না এনে যিনি সভাপতি হবেন তার শিক্ষাগত যোগ্যতা শিক্ষার প্রচার প্রসারে তার অবদানকে বিবেচনায় নিয়ে আসা জরুরী এবং এই ব্যাপারে একটি সুস্পষ্ট সরকারি নীতিমালার বিষয় দায়িত্বশীলদের চিন্তা করতে হবে।

    শুধুমাত্র সিলেবাসযুক্ত পড়াশোনা না করিয়ে আদর্শভিত্তিক নীতি-নৈতিকতা সম্পন্ন মানসিকতা তৈরির শিক্ষা প্রদানে পদক্ষেপ নিতে হবে। চার বছর বয়সে স্কুলে গমন বাধ্যতামূলক কিনা আমার জানা নেই, না থাকলে তা বাধ্যতামূলক করে ছয় বছর বয়স পর্যন্ত শুধু নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। ৬ বছর প্লাস হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান শুরু করতে হবে। ছাত্র শিক্ষক অনুপাতিক হার কমিয়ে আনতে হবে। প্রত্যেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাসে অন্তত ১ দিন একজন সফল ব্যক্তিত্বকে দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ভবিষ্যৎ তৈরির জন্য স্বপ্ন দেখাতে হবে এবং জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। সর্বপরি সুস্থ মেধা বিকাশে শিক্ষার পরিবেশ তৈরির জন্য যা যা প্রয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য তা নিশ্চিত করতে হবে।

    শেষ করার পূর্বে আশাবাদ ব্যক্ত করতে চাই বিনয়ী সৎ ও যোগ্যতা সম্পন্ন একটি জাতি গঠনের পথে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো অবশ্যই একদিন দূর হবে। যে স্বপ্ন সাধ নিয়ে এই জাতির পথ চলা শুরু হয়েছিল তা পূর্ণ হবে নিকট ভবিষ্যতে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধ এবং সেবাধর্মী একটি জাতি গঠনে আমরা সবাই কাজ করব স্ব স্ব অবস্থান থেকে এটাই প্রত্যাশা।

    লেখক পরিচয়ঃ নজরুল ইসলাম,ওয়ার্কিং ফর ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিস, লন্ডন। মেম্বার, দি ন্যাশনাল অটিষ্টিক সোসাইটি ইউনাটেড কিংডম।