প্রধানমন্ত্রী সমীপে যুদ্ধাহত এক মূক ও বধিরের খোলা চিঠি

    0
    240

    আমি শোয়েব এলাহী, মূক ও বধির। মানে কথা বলতে পারি না, আবার কানেও শুনি না।একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শত্রুপক্ষের মর্টার বিষ্ফোরণের প্রচন্ড শব্দে আমার কান ফেটে যায় বলে মা বাবার কাছে শুনেছি। সে সময় আমার বয়স ছিলো মাত্র দশ মাস। ভারতে শরণার্থী হিসেবে বসবাসরত আমার মায়ের কোলে ছিলাম। বাবা ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে গিয়ে শরণার্থী বাঙালীদের রেশন সরবরাহ করতেন ও পাক হানাদারদের গতিবিধি গোপনে পর্যবেক্ষণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দিতেন। মূলত পাক হানাদাররা আমার মাকে লক্ষ্য করে মর্টার ছুঁড়ছিলো।

    ভাগ্যক্রমে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে অদুরে পড়ে মর্টার বিষ্ফোরিত হয়।সে থেকে আজ ৪৬ বছর ধরে মূক ও বধির জীবন কাটাচ্ছি ।আমার বাবা মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান উপজেলা শ্রমিকলীগের সভাপতি প্রয়াত এম,এ, সবুর ও মা প্রয়াত ভাষা সৈনিক কয়েকবারের এম.এন.এ বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইলিয়াছ এমপির বোন শামছুন নাহার।

    যখন যুদ্ধের দামামায় চারদিক সরগরম। রাজনীতিবিদ বাবা এম,এ,সবুর মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করছেন।কমলা খাঁন, কুতুব খাঁন, চেরাগ আলীসহ এলাকার অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে উত্তরভাগ¯’ নিজের বাড়ীর বৈঠকখানায় গোপন সভা করে শলা পরামর্শ করতেন।মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয়  শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকাররা রাতের আঁধারে সে বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দিলো।এলাকার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন আতংকিত হয়ে পড়লো।বাবা কয়েকটি হিন্দু পরিবারকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের হালাহালি শহরে পৌঁছে দিলেন।

    সাথে আমার মা,আমি ও বড় বোন আড়াই বছরের শিশু কন্যা ইশরাত জাহান বীথি। আমাদের নিয়ে মা-বাবা আশ্রয় নিলেন ভারতের থানাবাজার এলাকার পারকুল গ্রামে এক হিন্দু বাড়ীতে।  মায়ের কাছ থেকে জেনেছি, আমাদেরকে জনৈক নগেন্দ্র কাকার বাড়ীতে রেখে বাবা বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সুসংগঠিত করা,ধলাই সীমান্ত পেরিয়ে তাদেরকে ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পৌঁছে দেওয়া এবং পাকিস্তানী সৈন্যদের গতিবিধি গোপনে পর্যবেক্ষণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সরবরাহের কাজে ব্যস্ত হযে গেলেন। এছাড়া আমার বড় মামা মোহাম্মদ ইলিয়াসকে নিয়ে ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে শরণার্থীদের রেশন ও রসদ সরবরাহ করতেন।তখন ছিলো এপ্রিল মাসের কোন এক দুপুর। বাড়ীতে বৃদ্ধ দাদা একা রয়েছেন। এর মধ্যে খবর এসেছে রাজাকাররা জমির পাকা ধান কেটে নিয়েছে।

    স্বদেশ আর নিজের বাড়ীর চিন্তায়  অস্তির মা আমাকে কোলে করে নগেন্দ্র কাকার বাড়ীর উঠানে পায়চারি করছিলেন।হঠাৎ অদুরে হেলমেট মাথায় জলপাই রঙের ইউনিফর্ম পরা কয়েকজন সৈন্য তার  চোখ পড়লো। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই আকাশ ফাঁটানো শব্দে একটি মর্টার এসে বিষ্ফোরিত হলো মায়ের পায়ের কাছে।আমাকে কোলে নিয়েই দৌড়ে পালালেন বাড়ীর আড়ালে। পরদিনই বাড়ী বদল করে আমরা দুই ভাইবোনকে নিয়ে চলে গেলেন হালাহালি গ্রামের মাস্টার শরফ উদ্দিন চাচার বাড়ীতে। কিন্তু আমি নাকি কিছুই শুনতে পাই না,কথাও বলতে পারিনা।আমাকে অনেক ডাক্তার দেখালেন। কোন লাভ হয়নি।মাসের পর মাস অপেক্ষা করলেন।আমিও আর মা ডাকতে পারলাম না। ইশারাতেই বাক্য বিনিময় করি। সবাই বললেন, মর্টারের প্রচন্ড শব্দে আমার কান ফেটে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে মায়ের চোখের জলও শুকিয়ে গেলো।দেশ স্বাধীন হলন্তুকিন্ত মুখের ভাষা ফিরে পেলাম না আমি। সে থেকে আজ আটচল্লিশ বছর ধরে মূক ও বধির হয়ে জীবন কাটাচ্ছি ।

    সিলেট শেখঘাট মূক ও বধির বিদ্যালয়সহ ঢাকা ও ফরিদপুরের বিভিন্ন মূক ও বধির বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছি। এক সময় খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতাম। জীবিকার তাগিদে এখন গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় একটি গার্মেন্ট কারখানায় সামান্য বেতনে কাজ করছি। আমার স্ত্রী পারভীন আক্তারও জন্ম থেকেই মূক ও বধির।

    আমাদের একমাত্র কন্যা মুমতাহিনা এখন ক্লাস ফোরে পড়ে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সমীপে আমার আকুল আবেদন একজন যুদ্ধাহত শিশু হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ে যদি আমার  কিঞ্চিত অবদান থাকে তবে আমাকে আপনার সুদৃষ্টি তেকে  বঞ্চিত করবেন না।