প্যালেস্টাইন সংকট ও সমসাময়িক বিশ্বের উত্তেজনাময় পরিস্থিতি

    0
    297

    আমারসিলেট  টুয়েন্টিফোর ডটকম,০৩জুনঃপ্যালেস্টাইনসহ কয়েক দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সম্প্রতি তার পুনরাবৃত্তি ঘটল আরেকবার জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের মাধ্যমে। ইরাক ও সিরিয়ার তথাকথিত গৃহযুদ্ধ ও রক্তপাতের আড়ালে প্যালেস্টাইনে নির্যাতন, নিপীড়ন ও রক্তপাত কখনও বন্ধ হয় নি। ইসরাইলীদের প্যালেস্টাইনে ভূমি দখল এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

    হত্যা রক্তপাত প্রতিদিন রুটিন কর্মসূচি হিসাবে ইসরাইলীরা ঘটিয়ে চলেছে। যে বিশ্ব সবসময় প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার জন্য সোচ্চার ছিল আজ জরুরী হয়ে পড়েছে তাকে আবার জাগ্রত করা। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি বিশ্বের সকল নিপীড়িত জনগণের সাথে থাকার আদর্শে বিশ্বাস করে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বমানবতার সমর্থন আমরা পেয়েছি। এই ঋণ আমাদের পরিশোধ করতে হবে প্রতি মুহূর্তে।

    ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যে যে সংঘাত চলে আসছে, তার অন্যতম প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে মানা হয় যুক্তরাষ্ট্রকে। একমাত্র যে দেশ ইসরায়েলের ওপর সরাসরি প্রভাব বিস্তারে সক্ষম, সে হলো এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই দুই দেশ কৌশলগত মৈত্রীতে আবদ্ধ। এই দুই দেশে সরকার বদল হয়, নতুন নেতা আসেন, কিন্তু তাঁদের কৌশলগত আঁতাতের কোনো পরিবর্তন হয় না। যুক্তরাষ্ট্র বরাবর নিজেকে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার নিরপেক্ষ ‘সমঝোতাকারী’ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার অর্থ আগে ইসরায়েলের স্বার্থ, তারপর অন্য কথা। অনেকেই বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই একপেশে নীতি তার নিজের জাতীয় স্বার্থবিরোধী। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী বব গেইটস সরাসরিই বলেছেন, বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের ভেতর যে মার্কিনবিরোধী মনোভাব, তার পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যনীতি। তা সত্ত্বেও ইসরায়েল প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তিত হওয়ার লক্ষণ নেই। বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের দোকানদারী করে বেড়ানো এই রাষ্ট্রটির অবস্থানও সবসময় এ সঙ্গে স্ববিরোধী। ট্রাম্প মুখে বলছেন যে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ফিলিস্তিনের মধ্যে মহান শান্তিচুক্তি করাতে চায়। অথচ কাজটা ঠিক উল্টো। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি সেই বিপরীত মনোভাব স্পষ্ট করে। যদিও ট্রাম্পের এই সমর্থনে বিশ্বের উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্রের সমর্থন নেই। ইইউ, রাশিয়া, চীন ইরান তো নয়, এমনকি সম্প্রতি ভারতও একে সমর্থন করে নি। সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার আমলে গাজায় গণহত্যাকে সমর্থনযোগ্য না বলে উল্লেখ করেও ইসরায়েলের এই আগ্রাসনকে তাদের সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় বলে সাফাইও গান। যুক্তরাষ্ট্র এখনো ইসরায়েলকে প্রতিবছর তিন বিলিয়ন ডলার সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে থাকে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যে কোন মুভমেন্ট ঠেকাতেও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সহায়তা করেছে এমন অভিযোগ পুরনো।

    ১৫ নভেম্বর ১৯৮৮ সালে আলজিয়ার্স শহরে নির্বাসনে ঘোষিত একটি রাষ্ট্র, যেখানে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন (পিএলও) ও প্যালেস্টাইন জাতীয় পরিষদ (পিএনসি) একপাক্ষিক ভাবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। আমরা সকলেই সংগ্রামী প্যালেস্টাইনের নেতা ও ইয়াসির আরাফাতের ঘনিষ্ট সহযোদ্ধা জর্জ হাবাসের কথা জানি। প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুধুমাত্র মুসলিম জনগোষ্ঠির সংগ্রাম ছিল না। এটা ছিল প্যালেস্টাইন জনগোষ্ঠির নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রাম। ১৯৮৮ ঘোষণার সময়ে কোনো অঞ্চলেই পিএলওর নিয়ন্ত্রণ ছিল না, যদিও তারা যে অঞ্চলগুলি দাবি করেছিল বাস্তবে সেইগুলি ইসরায়েলের দখলে ছিল। আরবরা দাবি করেছিল, ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ দ্বারা প্রস্তাবিত ফিলিস্তিন বিভাগ যেভাবে প্রস্তাবিত হয়েছিল, যেখানে ফিলিস্তিন ভূখন্ড (গাজা ভূখন্ড ও ওয়েস্ট ব্যাংক) ছাড়াও ইসরায়েল শাসনাধিন অঞ্চলও ছিল এর অন্তর্ভূক্ত এবং জেরুজালেমকে ঘোষিত রাষ্ট্রের রাজধানী আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। জাতিসংঘ এখনও প্যালেস্টাইনকে প্রতীকি ও ভবিষ্যতের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বিবেচনা করে।

    ১৯৭৪ আরবলীগ শীর্ষ বৈঠকে স্থির হয়েছিল, পিএলও ফিলিস্তিনের জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি এবং ও তাদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠিত আহবান জানিয়েছিল। ২২ নভেম্বর ১৯৭৪, থেকে প্যালেস্টাইন ও পিএলওকে ‘রাষ্ট্রহীন-সত্তা’ রূপে পর্যবেক্ষক অবস্থায় রাখা হয়েছে। যারা কেবলমাত্র জাতিসংঘে তাদের বক্তব্য রাখতে পারেন, কিন্তু ভোট দেবার কোনো ক্ষমতা নাই। দল ছিল ফাতাহ ও হামাস। কিন্তু রাজনৈতিক মতভিন্নতার কারণে ও ক্ষমতা নিয়ে হামাস ও ফাতাহ এর মধ্যে বিরোধ হয়। যার ফলে ফিলিস্তিনের প্রধান দুই অংশ ওয়েস্ট ব্যাংক ফাতাহ সরকারের অধীনে নিয়ে নেয়। আর অন্যদিকে গাজা ভুখন্ডে হামাস সরকার গঠন করে। হামাসকে ঘিরেই গাজায় সংকট তৈরি করে ইসরায়েল। ইয়াসির আরাফাত চরম সংকটময় অবস্থায় ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। চেষ্টা করেন দেশটিতে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য। ১৯৯৩ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে অসলো শান্তিচুক্তির জন্য তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। দখলদারি ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে মুক্তির সংগ্রামের লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)। ১৯৬৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ইয়াসির আরাফাত ছিলেন এ সংগঠনটির চেয়ারম্যান। তিনি ফিলিস্তিনের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দল ফাতাহরও নেতা ছিলেন। ১৯৯১, ১৯৯৩ ও ২০০০ সালে আরাফাত ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে কয়েক দশকের সংঘাতের অবসান ঘটানোর প্রয়াস নেন। যদিও রাজনৈতিক দল হামাস শুরু থেকে তার এই শান্তিপূর্ণ মনোভাবের বিরোধিতা করে। ২০০৪ সালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দ্বারা গৃহবন্দি অবস্থায় ইয়াসির আরাফাতের রহস্যময় মৃত্যু ঘটে। বলা হয়, তাকে রাসায়নিক বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পুণতদন্ত শুরু হলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ প্রভাবে তাদের অন্যতম মিত্র ফ্রান্স তা মাঝপথে তদন্ত বন্ধ ঘোষণা করে।

    ১৯৮৭ সালে ওই সময় একের পর এক ইসরায়েলি সহিংসতার বিরুদ্ধে তৎকালীন ফাতাহ সরকারের মনোভাব ছিল রক্ষণশীল। অস্ত্রের জবাব অস্ত্রের মাধ্যমে না দিয়ে তারা চাইছিল ইসরায়েলের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে। ফাতাহ সরকারের এই নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ইসরায়েলকে সশস্ত্র জবাব দিতে হামাস গঠন করা হয়। হামাস প্রাথমিকভাবে দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়। প্রথমত এর সামরিক শাখার মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত ফিলিস্তিনে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি পরিচালনা করা। তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক শাখা রয়েছে। ২০০৪ সালে আরাফাতের মৃত্যুর পর হামাস ও ফাতাহর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়। সাম্প্রতিক সময়ে যখন আবার এই দুইপক্ষের মধ্যে ন্যূনতম ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়, ঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়ে চাপ তৈরি করে।

    মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সংকটের আরেকটি বড় উপাদান ইরানের সঙ্গে করা ছয় জাতির পরমাণু চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। ট্রাম্পের ইরান চুক্তি বর্জনের সিদ্ধান্তকে জোরালোভাবে সমর্থন করেছে ইসরাইল, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এ তিনটি দেশই মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র ইরানের ঘোর বিরোধী। তবে বাকি বিশ্ব এই চুক্তির পক্ষে। লক্ষ্যণীয় হলো মুসলিম রাষ্ট্র হলেও সৌদি আরব এ অঞ্চলে বরাবরই ইসরায়েল-মার্কিন স্বার্থে পক্ষে অবস্থান নিয়ে এসেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয় নি। আরব-ইসরাইল সংকট, আইএস’র উত্থান, সিরিয়ায় বিদ্রোহ, ইয়েমেনে মানবিক বিপর্যয়, অভিবাসন ইস্যুসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে যখন মধ্যপ্রাচ্য টালমাটাল, তখনও সৌদি আরব নির্দ্বিধায় মার্কিন স্বার্থের পক্ষে অবস্থান নিয়ে কাতার সংকট ডেকে আনে। যার মাশুল এখন শুধু মধ্যপ্রাচ্যকে গুণতে হচ্ছে তাই নয়, সৌদি আরবের মার্কিন-ইসরাইলের এই সখ্যতা সমগ্র আরবের জনগণই নয় বরং বিশ্বকেই সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

    সিরিয়া সংকট মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতাকে নিঃসন্দেহে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। কিন্তু সেখানেও সেই যুক্তরাষ্ট্র- সৌদি-ইসরায়েল সম্পর্কের ত্রিভূজ বিদ্যমান। রাশিয়া সরাসরি সিরিয়ায় হস্তক্ষেপের আগ পর্যন্ত এই সংকট সুরাহার পথে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবারও প্রয়োজন বোধ করে নি। সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানোর ঘটনার পর থেকে যা যা ঘটেছে, তাকে আগামী বিশ্বের সামরিক লড়াইয়ের জোটদের মহড়া বললেও ভুল হবে না।

    শুধু মধ্যপ্রাচ্যই নয়, যুক্তরাষ্ট্র কোরীয় শান্তি প্রক্রিয়ার পথেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক কোরীয় নেতা উন এর সাথে বৈঠক বাতিলের ঘোষণা আগামীর পথকে বন্ধুর করে তুলেছে। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে যখন দুই কোরিয়ার মধ্যে আলোচনা ও মৈত্রীর সম্ভাবনা তৈরি হলো, ঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্রের এই আচরণ পুরো প্রক্রিয়াটিকেই ক্ষতির মুখে ফেলে এখনও অবশ্য ঐ আলোচনা আবার হবে বলে বলা হচ্ছে। তবে সেটাও অনিশ্চিত। এর প্রধান কারণ ভিন্ন। ২৯ মার্চ ২০১৮, উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন প্রথমবারের মতো চিনে গিয়ে পারস্পরিক সামরিক সহযোগিতার উদ্যোগ নেয়। ফলে উত্তর কোরিয়া, চীন, ইরান, সিরিয়া, তুরস্ক ও রাশিয়া এক বলয়ে চলে আসে। খতিয়ে দেখলে এই সামরিক সহযোগিতা জোটের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইসরায়েল। আর সে কারণেই কোরীয় শান্তি প্রক্রিয়াকে বিঘিœত করতে যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করেছে নতুন মিশন। ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিল ও ম্যাক্সিকো সহ সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।

    এই পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে বিশ্বের কোনোখানেই এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র তথা মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ শান্তির পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে না। বরং বিদ্যমান সংকটকে আরো ঘনীভূত করে তুলছে। যার অর্থ হলো, বিশ্বকে আরো একটা মহাযুদ্ধের মুখোমুখি করার পরিকল্পনায় নেমেছে তারা। আর কে না জানে, এবারের যুদ্ধ শুরু হলে তা পারমাণবিক আঘাত-পাল্টা আঘাতের মাধ্যমে পুরো বিশ্বকেই অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দেবে। তাই আজ আমাদের মত দেশের বৈদেশিক নীতি ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দাবি করে। (সমাপ্ত) লেখকঃফজলে হোসেন বাদশা:সাধারণ সম্পাদক,বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি