পা দিয়ে লিখে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে তামান্না 

    0
    324
    এম ওসমান: পা দিয়ে লিখেই জিপিএ-৫ পেয়েছে তামান্না নূরা। যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় সে। পরীক্ষায় কৃতিত্বের মাধ্যমে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নপূরণে একধাপ এগিয়ে গেলো তামান্না। সোমবার (০৬ এপ্রিল) পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর তামান্নাকে ঘিরে তার পরিবার, প্রতিবেশী ও শিক্ষকরা আনন্দের জোয়ারে ভাসছেন। তবে আগামীতে স্বপ্নপূরণের নানা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে দুশ্চিন্তা ও হতাশা ভর করেছে তামান্নার মনে। যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া ইউনিয়নের আলিপুর গ্রামের রওশন আলীর মেয়ে তামান্না নূরা।
    জন্মগতভাবে হাত ছাড়া মাত্র একটি পা নিয়েই দুনিয়ার আলো দেখে সে। তবে ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার প্রতি অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মানতে বসেছে প্রতিবন্ধিত্ব। তারই প্রমাণ এসএসসিতে জিপিএ-৫ অর্জন। এর মাধ্যমে তামান্নার বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন আরও একধাপ এগিয়ে গেলো।
    সরেজমিন তামান্নার গ্রামে গিয়ে জানা যায়, এসএসসি পরীক্ষায় ঝিকরগাছার বাঁকড়া জে কে হাই স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলো তামান্না। স্থানীয় বাঁকড়া ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসেই পরীক্ষা দেয় সে। তামান্নার শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবন্ধিত্বকে পেছনে ফেলে তামান্না বিদ্যালয়ে কেজি, প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণির প্রতিটি ফলাফলে মেধাতালিকায় প্রথম হওয়ার পাশাপাশি এডাস বৃত্তি পরীক্ষায় প্রতিবছরই বৃত্তি পেয়েছে। এছাড়াও ২০১৩ সালে পিএসসি এবং ২০১৬ সালে জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে কৃতিত্বের সাক্ষর রাখে। তামান্নার বাবা রওশন আলী বলেন, জন্মের পর থেকে আর্থিক সমস্যার পাশাপাশি সামাজিকভাবে অনেক প্রতিকূলতার মোকাবেলা করতে হয়েছে। তবে কখনো আমরা ভেঙে পড়িনি। সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা করেই ওর মা তাকে একটি পায়ের উপর ভর করে সব শিক্ষা দিতে থাকে।
    তামান্না অক্ষর জ্ঞান তার মায়ের কাছ থেকেই শেখে। সে সময় বাড়ি থেকে দূরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে এবং নিয়মিত স্কুলে পাঠানো আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না, ফলে স্থানীয় আজমাইন এডাস স্কুলে তাকে নার্সারিতে ভর্তি করানো হয়। তামান্না শ্রবণ ও মুখস্থ শক্তি এতো ভালোছিল যে একবার শুনলে তা আয়ত্ত্ব করতে পারতো। অক্ষর লেখা, পায়ের আঙুলের ফাঁকে চক ধরিয়ে লেখা, তারপর কলম ধরিয়ে লেখা আয়ত্ত্ব করে সে, বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টানো, পায়ের আঙুলের ফাঁকে চিরুনি, চামচ দিয়ে খাওয়া, চুল আঁচড়ানো সহজেই সে রপ্ত করে। এক পর্যায়ে নিজের ব্যবহৃত ঠেলাগাড়িটি এক পা দিয়ে চালানোও শেখে। আর তার দক্ষতা সবার নজরে আসে। বাবা রওশন আলী আরো বলেন, মেয়ের পরীক্ষার ফলাফলের কৃতিত্বের আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। তবে রয়েছে নানা দুশ্চিন্তাও।
    কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, নিজে স্থানীয় একটি ননএমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনা বেতনে চাকরি করেন, তবে টিউশনির আয়ের টাকায় তামান্না ছাড়াও তার ছোট বোনের পড়ালেখা, চার বছরের ছেলেসহ সংসারের খরচ টানতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এরমধ্যে তামান্নাকে লেখাপড়া করে কতোদূর নিতে পারবেন সেই সংশয় থেকেই যায়। তামান্না নূরা বলে, ফলাফল ভালো হয়েছে, কিন্তু শুধুমাত্র বাংলায় ‘এ’ গ্রেড পাইনি বলেই গোল্ডেন হয়নি। আর পা দিয়ে লিখে শেষ হয়নি বলেই হয়তো খারাপ হয়েছে। আগামীর স্বপ্ন প্রসঙ্গে তামান্না বলে, ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন মেডিকেল পড়ে বিসিএস’র মাধ্যমে ভালো চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করবো। কিন্তু এক পা দিয়ে কি এতো বড় কাজ সম্ভব? এজন্য মনোবল কমে যাচ্ছে।
    তবুও আমি মেডিকেলে না পড়তে পারলেও ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা সম্পন্ন করে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি কর্মকর্তা হতে চাই। নিজের হতাশা উল্লেখ করে তামান্না বলে, এসএসসিতে ভালো হলেও আমার স্বপ্নপূরণ করতে হলে এখন ভালো কলেজে ভর্তি হয়ে ভালোভাবে পড়াশোনা করতে হবে। কিন্তু নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা এবং বাবার আর্থিক অনটনে তা সম্ভব হবে কিনা চিন্তা হয়। সবার কাছে দোয়া প্রার্থনা করে তামান্না বলে, আমার জন্য দোয়া করবেন যেন আমার স্বপ্নপূরণ হয়, যেন মানুষের সেবা করতে পারি। পাশাপাশি এতোদূর আসতে পেরে শিক্ষক, বাবা-মা, সহপাঠী, সহযোগী সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তামান্না।